Sun. Jul 6th, 2025
অধ্যাপক আবদুল কাদিরের চিন্তায় পারিবারিক শিক্ষাঅধ্যাপক আবদুল কাদিরের চিন্তায় পারিবারিক শিক্ষা

গণপ্রহরী ডেস্ক : অধ্যাপক আবদুল কাদিরের চিন্তায় পারিবারিক শিক্ষা। অধ্যাপক আবদুল কাদির বিবাহ কিংবা জন্মগতসূত্রে সম্পর্কযুক্ত অভিন্ন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত জনসমষ্টিই পরিবার। পরিবার ও শিক্ষা অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে সম্পর্কযুক্ত। কারণ উত্তম পরিবার থেকে শিশুরা যত সহজে শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান মানুষে পরিণত হয়, অনুত্তম পরিবার থেকে ডিগ্রিধারী হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষিত ও সাংস্কৃতিবান মানুষে পরিণত হতে পারে না। কারণ পরিবার হলো শিক্ষার বুনিয়াদ। পরিবার থেকে শিশুর শুভ ও অশুভ শিক্ষার সূচনা ঘটে। পরিবার শিশুর ভবিষ্যত নির্ধারণে প্রথম ও প্রধান নিয়ামক শক্তি হয়ে কাজ করে। শিশুর বুদ্ধিমত্তা ব্যক্তিত্ব কেমন হবে তা মূলত পরিবার দ্বারাই নির্ধারিত হয়। পরিবার হলো সমাজের ক্ষুদ্রতম একক। পারস্পরিক সহযোগিতা সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু। উল্লেখ্য, মানুষের সাথে মানুষের সর্বোচ্চ সাত ধরনের সম্পর্ক তৈরি হতে পারে। যেমন-ভালোবাসার সম্পর্ক, সহযোগিতা, প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অধীনতা, স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতার সম্পর্ক। পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও এই সম্পর্ক বিদ্যমান ।

পরিবার শুধু সমাজের ক্ষুদ্রতম একক নয়; রাষ্ট্রেরও ক্ষুদ্রতম একক। তবে পরিবার হলো রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্র। কারণ রাষ্ট্র যে বৈশিষ্ট্য বা উপাদানসমূহ বহন করে পরিবারও সে উপাদানসমূহের অধিকারী। যেমন-রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ড, জনসমষ্টি, সরকার, সার্বভৌম ক্ষমতা আছে, পরিবারেও নির্দিষ্ট ভূ-খন্ড, জনসমষ্টি সরকার (পিতা-মাতা, স্বামী) ও সার্বভৌম ক্ষমতা আছে।

উল্লেখ্য, পরিবারে অন্তভূক্ত সার্বভৌম ক্ষমতাকে কেউ রদ করতে পারে না। রাষ্ট্রে যেমন শাসন-শোষণ, দন্ডদান আছে, পরিবারেও তা আছে। যেমন স্বামী স্ত্রীকে, ক্ষেত্র বিশেষে স্ত্রী স্বামীকে, ভাই-বোন ভাই-বোনকে শাসন-শোষণ ও দন্ডমান করতে পারে। রাষ্ট্রের যেমন সংবিধান আছে, তেমনি পরিবারেও একটি করে অলিখিত সংবিধান আছে। রাষ্ট্রে যেমন রাজনীতি আছে, পরিবারেও অনুরূপ পরিবারিক রাজনীতি আছে। এই পারিবারিক রাজনীতি দ্বারা পারিবারিক ক্ষমতার ভারসাম্য সংরক্ষিত হয়। পরিবার বহু ও বিচিত্র কাজের লীলাভূমি। যেমন-দাম্পত্যমূলক কাজ (প্রণয়, পরিণয়, যৌনতা, জন্মদান, সন্তান প্রতিপালন, পরিবার পরিকল্পনা, রান্না ও খাদ্যগ্রহণ) উৎপাদন ও সৃষ্টিশীল কাজ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাজ, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কাজ, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সংক্রান্ত বিনোদনমূলক, সামাজিক ও সেবামূলক কাজ, আধ্যাত্মিক কাজ, শাসন-শৃঙ্খলা বিচার ও শোষণমূলক কাজ ইত্যাদি অন্তহীন কাজের লীলাভূমি পরিবার।

অধ্যাপক আবদুল কাদিরের মত- আমরা জানি, মূলত পরিবারই মানুষের বর্তমান লেখক ও গবেষক, বিজ্ঞান-দর্শন ও সমাজ ও ভবিষ্যতকে নিয়ন্ত্রণ ও গতিশীল করে। পরিবার যদি উত্তম হয়, তবে তার ফল যেমন সুদূরপ্রসারী, তেমনি পরিবার যদি অনুত্তম হয়, তবে তার পরিণতিও সুদূরপ্রসারী। প্রশ্ন কোন পরিবারকে আমরা উত্তম পরিবার বলবো? পরিবারকে কুশিক্ষা, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও খন্ডিত শিক্ষামুক্ত হতে হবে। পারস্পরিক মমত্ববোধ, আপনবোধ, পারস্পরিক সহযোগিতা, স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতামূলক সম্পর্ক থাকতে হবে।

পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য সচেতন হতে হবে। প্রয়োজনীয় আর্থিক সঙ্গতি ও কর্মসংস্থান থাকতে হবে। কর্মমুখি ও কর্মতৎপর হতে হবে। সমাজের প্রতি দায়িত্বনিষ্ঠ ও সামাজিক অবদান থাকতে হবে। গতি ও প্রগতিশীল দাম্পত্য সম্পর্ক থাকতে হবে। পরিবারকে শ্রমমুখি ও কর্মভিত্তিক জীবনযাপন ও জীবনানুশীলন করতে হবে। অর্থাৎ পরিবারের সদস্যদের সুদখোর, ঘুষখোর, মুনাফাখোর, খাজনাখোর ও বেতনখোর (কাজ ও দায়িত্ব এড়িয়ে বেতন গ্রহণ) হওয়া যাবে না। পরনির্ভরশীলতা কাটিয়ে স্বনির্ভর হয়ে উঠতে হবে। সমাজের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। উত্তম জীবনের অনুশীলনে আত্মনিয়োগ করতে হবে। পারিবারিক শোষণ- শাসন ও বৈষম্য ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনতে হবে।

অধ্যাপক আবদুল কাদিরের চিন্তায়- আমরা যে-পরিবারে জীবন-যাপন করি, তা প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় দাস ও সামন্ততান্ত্রিক আইন-কানুন দ্বারা সজ্জিত। কুশিক্ষা ও কুসংস্কার দ্বারা সমাচ্ছন্ন। এ জন্য আমাদের পরিবারগুলো অন্তহীন সমস্যায় জর্জরিত। বিশৃঙ্খলা ও দুঃখ-কষ্টে ভরপুর। উল্লেখ্য, যে মানুষের পরিবারে ও কর্মস্থলে স্বস্তি-শান্তি নেই, জীবন ও জগতে তার শান্তি নেই ।

প্রশ্ন আসে যে, আমাদের পারিবারিক সমস্যাগুলো কী? আমাদের পারিবারিক সমস্যাগুলো হচ্ছে-অশিক্ষা, কুশিক্ষা, খন্ডিত শিক্ষা, অন্ধ বিশ্বাস, কুসংস্কার, বাল্যবিবাহ, বয়স্ক বিবাহ, বৃদ্ধবিবাহ, দাম্পত্য অমিল, অবনিবনতা, ঝগড়াঝাটি, মামলা-মোকদ্দমা, ত্যাগ-বিচ্ছেদ, ষড়যন্ত্র, হত্যা, পরকীয়া, অবৈধ সন্তান, শিশুমৃত্যু, বৈধব্য, বিপত্নীক, দারিদ্র্য, ভূমিহীনতা, বেকারত্ব, রোগব্যাধি, অচিকিৎসা- কুচিকিৎসা-অপচিকিৎসা, নিরাপত্তাহীনতা, পুরুষতন্ত্র, নারীবাদী কর্মকান্ড, গুরুবাদিতা, গুরুবাদী শাসন-শোষণ, শিশু-বৃদ্ধদের প্রতি অনাদর-অবহেলা, আলস্য, শ্রমবিমুখতা, প্রাচুর্য, আরাম-আয়েশ, বিলাসিতা, ভোগবাদিতা, নেশাগ্রস্ত, গৃহপলায়ন, পারিবারিক সন্ত্রাস, বিষাদ-ব্যর্থতা, হতাশা, অবসাদ, মানসিক মৃত্যু, অকাল মৃত্যু ও অপূর্ণাঙ্গ ভবলীলার অবসান। এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য যা করণীয় তাহলো শিক্ষা ও যোগ্যতার্জন, কুশিক্ষা ও কুসংস্কার বর্জন।

প্রাচীন, মধ্য ও পুঁজিবাদী সমাজের সম্প্রদায়গত জড়বাদী আইন- কানুনের বিপরীতে অভিন্ন প্রগতিশীল পারিবারিক আইন ও কার্যবিধি প্রবর্তন। পুরুষতন্ত্র ও নারীবাদী কর্মকান্ডের অবসান। উল্লেখ্য, বর্তমান পৃথিবীতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে পুরুষতন্ত্র বিদ্যমান কিন্তু পরিবার বিশেষে পারিবারিক রাজনীতির (পারিবারিক ক্ষমতা ও সংরক্ষণের সংগ্রাম) দ্বন্দ্বে পরিণতিস্বরূপ পারিবারিক নারীতন্ত্রের উন্মেষ হয়। এইরূপ ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে পুরুষ পরাভূত জীবনের গ্লানিসহ ব্যর্থ ও বিষাদময় জীবনযাপন করে। এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য পারিবারিক শাসন-শোষণ ও বৈষম্যের অবসান এবং বৈজ্ঞানিক জীবনধারার শুভ সূচনা করতে হবে।

লেখক: লেখক ও গবেষক, বিজ্ঞান-দর্শন ও সমাজ। প্রয়াত লেখক স্মরণে প্রকাশিত।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *