আমাদের কথা’র একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তার্জিত ‘চুয়ান্নতম বিজয় দিবস’ উপলক্ষ্যে বিজয়ের মাসের শেষ প্রান্তে পৌঁছে আমাদের ছোট্ট আয়োজনের বিজয় দিবস সংখ্যার শুরুতে যাঁদের জীবনদান, যাঁদের ত্যাগ, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন মরণযুদ্ধের মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশ গ্রহণ করে বিজয় নিশ্চিত করেছেন যে জনগণ, সেই জনগণসহ সকলকে বিনম্র শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাচ্ছি এবং সকলকে আমাদের কথার মাধ্যমে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। সকল শহীদের আত্মবলিদানের বিনিময়ে দেশের আপামার মানুষের জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক এবং শোষণমুক্ত-বৈষম্যমুক্ত সমাজের সুখী-সমৃদ্ধশালী দেশে হিসেবে হোক আমাদের এই মাতৃভূমি বাংলাদেশ। এই কামনা বা চাওয়া হৃদয়ে নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ১৯৮১ সালের ১লা মে আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে আজকে সম্মানিত পাঠকদের মুখোমুখি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করার মাধ্যমে ইতিহাসের শিক্ষায় ও বাস্তবতার আলোকে করণীয় বিষয়ে দিক-নির্দেশনামুলক মতামতসহ শহীদদের আত্ম্যাগকে স্বার্থক করতে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে চলার আহবান জানাতে সচেষ্ট রয়েছে। তদসত্বেও কোনো পাঠকের দৃষ্টিতে ত্রুটি বিচ্যুতি পরীলক্ষিত হলে নিজগুনে ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে বিবেচনার অনুরোধ থাকলো। লক্ষ্য অর্জনে অবিচল থাকায় বানিজ্যিক ক্ষেত্রে তেমন কোনো সহায়তা না পাওয়ায় পাঠকের চাহিদামতো তাঁদের হাতে যথাসময়ে পত্রিকা তুলে দিতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করছি। আবার বর্ষ গননার নতুন বছরে এবং প্রকাশনার নতুন বছরে আবার হয়তো এমন অপরিহার্য বিষয়াদি তুলে ধরতে বাধ্য হবো। সেই সময়কাল পর্যন্ত সুস্থ্য থাকুন এবং মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে চলতে সক্ষম হোন।
সর্বজন স্বীকৃত ‘বিজয়’ সেটা ব্যক্তিগত হোক, পারিবারিক হোক, খেলাধুলায় হোক বা নির্বাচনেই হোক তা অবশ্যই আনন্দের। কিন্তু একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বিজয় দিবসের চলতি সংখ্যায় আমাদের কথার মাধ্যমে স্মরণ করিয়ে দিতে চাইÑ ভারতের মুক্তিকামী বীর জনগণ প্রতিবেশী বন্ধু হিসেবে তাঁদের চাওয়া মতে, ভারত সরকার বন্ধু হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা পালন করায় ধন্যবাদ ভারতের জনগণকে এবং সরকারকে। অথচ সেই ভারত তার সম্প্রসারণবাদী চরিত্র ভিত্তিতে উগ্র-হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের চাওয়ায় শেখ হাসিনা সরকার দেশকে অনুগত রাষ্ট্রে পরিণত করে বটে। কিন্তু কর্তৃত্ববাদী শাসনে অতিষ্ঠ ছাত্র-জনতা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে জুলাই-আগস্টে পরিচালিত ছাত্র-জনতার আন্দোলন-গণঅভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে আবারো রক্তার্জিত বিজয় অর্জন করতে হয়েছে।
পাঠক, আমাদের আনিচ্ছাকৃত ক্রুটি বা অপারগতার জন্য ক্ষুদ্র আয়োজনে বিশদ আলোচনা ও বিশাল পরিসরে প্রকাশনা সম্ভব না হওয়ায়, দুঃখ প্রকাশ করছি। তবে যে কথাটি বলে শহীদদের আত্মার প্রতি ‘সন্মান পরিদর্শন করা’ বুঝাতে চাই, তাহলো তেপ্পান্ন বছর মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য যেমন অর্জিত হয়নি। তেমনি পাঁচ মাস হতে চললো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের নেতৃত্বে পরিচালিত গণঅভ্যূত্থানে বিজয় হলেও জনগণ যেভাবে যে প্রক্রিয়ায় শাসিত-শোষিত হয়ে আসছিলেন, আজও সেভাবেই হচ্ছেন। অর্থাৎ শোষনমুক্ত বা বৈষম্যহীন সমাজকামী-মুক্তিকামী মানুষের সামনে তাঁদের আকাঙ্খা পূরণের খোলা কোনো পথ দেখছেন না, উপভোগতো দূরের কথা।
এ ক্ষেত্রে ইতিহাসের যে শিক্ষা শান্তনা দেয় মানুষকে, তা হলো-একদিনে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, একদিনে কোনো গণঅভ্যূত্থান হয়নি। এভাবে এক সময় শোষিত-শাষিত-বঞ্চিত-অধিকারহারা মানুষ অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হলে মুক্তি তাদের হবেই-ইনশাহআল্লাহ; সৃষ্টিকর্তার কৃপায়। এপর্যায়ে গণপ্রহরী পরিবার পক্ষে কামনা করছি, শহীদদের অত্মত্যাগ স্বার্থক হবেই।
সন্মানিত পাঠক, এমূহুর্ত পর্যন্ত সময়ে শহীদদের আত্মত্যাগ স্বার্থক না হওয়ায় দুঃখ থাকলেও দুঃখের মাঝেও একাধিক আনন্দ বার্তা দিয়েই আমাদের কথা’র সমাপ্তি টানতে সচেষ্ট হবো। যদিও আনন্দ উপভোগের সুযোগটা নির্ধারিত একটা বড় অংশের মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায়, ইচ্ছা ও সুযোগ-দুটোই থাকা সত্বেও কিছু সংখ্যক মানুষ, সেই সুযোগ নিতে পারেননি; বিশেষত তাদের মধ্যে কর্মজীবি-শ্রমজীবিদের একটা অংশ। তাহলো বিজয় দিবস উদযাপনে ভিআইপিদের জন্য সময় ও রাস্তা ব্যবহার ইত্যাদি নির্ধারিত ছিল। এবার উম্মুক্ত ছিল সবার জন্য। এটা জাতিগতভাবে আনন্দের। তবে দুর্ভাগ্যবশত: পূর্বাপর ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকায় সর্বজনীন হয়ে ওঠেনি।
দ্বিতীয়ত: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উগ্রহিন্দুত্ববাদী বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের মদদপুষ্ট উগ্র-হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন সংগঠন এবং ভারতে আশ্রিত শেখ হাসিনার বিগত সরকার ও তার অনুগতরা এদেশের উগ্রবাদীদের নেতৃত্বে পরিচালিত ইসকোনসহ অন্য হিন্দু উগ্রবাদী সুবিধাভোগীদের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর পরিকল্পিত অপচেষ্টা স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের জন্য যেমন হুমকি ছিল। তেমনি খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের ‘শুভ বড়দিন’ খ্যাত প্রধান ধর্মীয় উৎসবের দিন-ধর্মপ্রবর্তক যীশু খ্রিষ্টের পবিত্র জন্মতিথি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানাদির জন্যও হুমকি ছিল বটে। কেননা, অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসবের মতই এই বড়দিনের উৎসবেও বাস্তবদৃষ্টে ধর্মীয় সীমানা থাকে না। এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে থাকে ও ছিল সরকারি ‘ছুটির দিন’। দেশের রাজধানীসহ দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গির্জায় নির্বিঘ্নে নিরাপদে-উৎসবমুখর পরিস্থিতিতে প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত খাদ্য তালিকায় কেক ও নানা প্রকার বিশেষ খাবার শুধু পরিবার ও স্বজনদের মধ্যে নয়; ভিন্ন ধর্মের প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধবরাও পেয়েছেন-অংশ নিয়েছেন। একইভাবে কীর্তনসহ আয়োজিত বিশেষ বৈচিত্রময় গানের অনুষ্ঠানাদি উপভোগ করেন সকল ধর্মের মানুষ। যেন বড়দিন খ্যাত খ্রিষ্টধর্মের এবারের এই ধর্মীয় উৎসব সম্প্রতির এই দেশে আবারো স্বাক্ষ্য দিচ্ছে-‘ধর্মীয়ভাবে দিনটি খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের হলেও, উৎসব ছিল সকলের’।
তৃতীয়ত: গণমাধ্যম জগতে অর্থাৎ বিশ্বের প্রভাবশালী ‘দ্যা ইকোনমিস্ট’ নামীয় সাময়িকী ২০২৪ সালে বর্ষসেরা তালিকায় আমাদের সবার প্রিয় দেশ রক্তার্জিত ‘বাংলাদেশ’কে রেখেছে সবার শীর্ষে অর্থাৎ এক নম্বরে। কারণ ইকেনামিস্ট যে যৌক্তিক বিবেচনায় বিশ্বসেরা করেছে বাংলাদেশ, তাহলো ছাত্র-জনতার আত্মদান-রক্তদানের গৌরবময় অভ্যূত্থানে কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন নিপীড়ক শাসকের পতন ঘটিয়েছে। পতিত কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনা ১৫ বছর একটানা সতেরো কোটি মানুষকে শাসনকালে বিরোধীদের ওপর-অত্যাচার-নির্যাতন, দমন-পীড়ন চালিয়েছেন। তিনি গণঅভ্যূত্থানের মুখে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। দ্য ইকোনমিস্টের তাৎপর্যপূর্ণ মূল্যায়নে ছাত্র-জনতার রক্তার্জিত সফল অভ্যূত্থানে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটানোকে গুরুত্ববহ এবং বিশ্বের ক্ষেত্রে উদাহরন হিসেবেও ইঙ্গিত দিয়েছে বিশ্বের প্রভাবশালী ‘সাময়িকীটি’।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান-বিশ্বের একমাত্র সরকার প্রধান যিনি অর্থনীতিেিত শান্তিতে নোবেলজয়ী-অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস মেধায়-গবেষণায় নোবেলজয়ী হলেও তিনি ও তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের উপদেষ্টাবৃন্দ, যার যার কর্মক্ষেত্রে মেধার স্বাক্ষর রাখলেও প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা না থাকায় এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বাস্তব অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকায় চতুর্মুখী সংকটে। তবে আমরা আশা করছি, শহীদদের আত্মত্যাগকে প্রাধান্য দিয়ে আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের সাথে এবং বিশেষজ্ঞজনদের সাথে নিয়মিত আলোচনা-পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে সম্ভাব্য প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় সংষ্কার করে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। এবং দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধিরোধ, আইনের শাসন এবং ভারতীয় চক্রান্ত ও আওয়ামীলীগসহ তার দোসরদের অপতৎপরতা প্রতিরোধে কোঠর পদক্ষেপ নিবেন-এই আশা দেশের শান্তিকামী মানুষের। এ আশাবাদ শহীদি আত্মার এবং মুক্তিকামী মানুষের। বৈষম্যের জগদ্দল পাথর সরিয়ে নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করবেনÑ ‘গণপ্রহরী পরিবার পক্ষে সরকারের কাছে এটাই কামনা’।
পরিশেষে, ২০২৪- এর গণঅভ্যূত্থানের সফলতায় অর্জিত অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে এবং তার উপর নির্ভর করে ইংরেজি নববর্ষ ‘২০২৫’-কে বরণ করে প্রতি ধাপে ধাপে সফলতার মধ্য দিয়ে হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে এগিয়ে যাই সর্বক্ষেত্রে সামন থেকে আরও সামনে। নতু বছর সবার জন্য শুভ হোক।
