স্বপন চৌধুরী: আলু নিয়ে বিপাকে তিস্তা পাড়ের উৎপাদনকারী কৃষক। কৃষকরা শৈতপ্রবাহ উপেক্ষা করে অধিক আলু উৎপাদন করলেও দাম নেই। কৃষকদের কাছ থেকে কৃষিপণ্য কেনার ব্যবস্থা না থাকায় সিণ্ডিকেটের কাছে নতুন আলু নিয়ে কৃষক ধরা খেলো। বিপাকে আলু উৎপাদনকারী তিস্তা পাড়ের কৃষকরা। গণপ্রহরীর এই বিশেষ প্রতিনিধির মুখোমুখি হলে তাঁদের আক্ষেপের ডালি খুলে দেন।
‘আলু আবাদ করি এবার হামার কোমর পড়ি গেইল বাহে। ৫২ টাকা কেজিদরে বীজ কিনি আলু গাড়নো (রোপন করা), সেই আলু বেচা নাগোচে ১৫ টাকা কেজিদরে। এই লোকসান পূরন হবার নয়। মরণ ছাড়া হামার কৃষকের কোনো পথ নাই।’ রংপুরের তিস্তার চরে আগাম রোপনকৃত আলু ১৫ টাকা কেজিদরে বিক্রির প্রাক্কালে অপূরনীয় ক্ষতি হওয়ায় এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন গান্নারপাড় এলাকার কৃষক অহেদুল ইসলাম। শুধু তিনিই নন, আগাম আলুর বাজারে ধ্বস নামায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে এ বছর আলুর দাম রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। উৎপাদনের এলাকা রংপুরেই ভোক্তাদের আলু কিনে খেতে হয়েছে ৮০ টাকা কেজি দরে। যদিও কৃষকরা ক্ষেত থেকে উত্তলনের পর গত বছরের শুরুতে সেই আলু ২০ টাকা কেজিতে বিক্রি করেছেন। এ বছর রোপন মৌসুমে বেশি দামে বীজ কিনে একবুক আশা নিয়ে কৃষকরা আলু চাষ করেন। কিন্তু আগাম নতুন আলুর বাজারে হঠাৎ ধ্বস নামায় বিশাল অঙ্কের টাকা লোকসান শুনতে হচ্ছে তাদের।
কৃষকরা জানান, বীজের দামসহ সার, কীটনাশকের দাম বেড়ে যাওয়ায় এ বছর আলু চাষে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে। ভরা মৌসুমে আলুর দাম কমে যাওয়ার ভয়সহ চলতি শৈত্যপ্রবাহের কারণে রয়েছে ক্ষতির শঙ্কাও। সে কারণে আগাম রোপনকৃত আলু বিক্রি না করে উপায় নেই। কিন্তু হঠাৎ দাম কমে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ তো উঠছেই না, বরং বিঘাপ্রতি প্রায় ২২ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলায় এ বছর এক লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে আলুর চাষ হয়েছে। এর মধ্যে তিস্তার চরাঞ্চলসহ রংপুর জেলাতেই আলু চাষ হয়েছে ৫৫ হাজার ৪৩৫ হেক্টর জমিতে। যার মধ্যে আগাম আলুর চাষ হয়েছে অন্তত ১২ হাজার হেক্টর জমিতে। সব মিলে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৫ লাখ মেট্রিক টন আলু।
সরেজমিনে তিস্তার চরাঞ্চল রংপুরের মহিপুর, গান্নারপাড়, পূর্ব ইছলী ও ছালাপাক এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পুরোপুরি আলু উত্তলনে সময় লাগবে আরও মাসখানেক। তবে মাঠজুড়ে আলু ক্ষেতের মাঝে মাঝে আগাম রোপনকৃত আলু উত্তোলনের ধুম পড়েছে। নারী-পুরুষ মিলে চলছে ক্ষেত থেকে আলু উত্তোলনের কাজ। ক্ষেতেই রয়েছেন ক্রেতারা (পাইকার) ওই আলু বস্তায় ভরে ট্রাকযোগে পাঠাবেন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়।
পূর্ব ইছলী এলাকার নাদের আলী তিন বিঘা জমিতে গ্রানুলা জাতের আলু লাগিয়েছেন। ১৫ টাকা কেজি দরে সমুদয় আলু স্থানীয় পাইকারের কাছে বিক্রি করেছেন তিনি। তার ক্ষেতের আলু তুলছিলেন একদল নারী শ্রমিক। খরচের হিসাব কষে নাদের আলী জানান, এক বিঘা (৩৩ শতক) জমিতে ৫২ টাকা কেজিদরে ২০০ কেজি বীজ লেগেছে ১০ হাজার ৪০০ টাকা, সার, কীটনাশক, ছত্রাকনাশ, সেচসহ আলু উত্তোলন পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা। এছাড়া ৩ মাসের জন্য জমি লিজ বাবদ দিতে হয়েছে আরো ৬ হাজার টাকা।
সব মিলে খরচ হয়েছে ৫১ হাজার ৪০০ টাকা। প্রতি শতকে এক বস্তা (৬০ কেজি) আলু হিসেবে বিঘায় উৎপাদন হয়েছে ১৯৮০ কেজি। ১৫ টাকা কেজি হিসেবে যার মুল্য দাঁড়ায় ২৯ হাজার ৭০০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি বিঘা আলুতে লোকসান হয়েছে তার ২১ হাজার ৭০০ টাকা। মহিপুর চরের সোনা মিয়া ও আব্দুল হামিদ বলেন, ‘আগাম আলুতে প্রত্যেক বছরে ভালো লাভ হয়। এইবারে পরথম ধরা খাইনো।’ সপ্তাহখানেক আগেও তারা ৪০ টাকা কেজিদরে ক্ষেতে আলু বিক্রি করেছেন, এখন ১৫ টাকায় নেমেছে। আগাম এই আলু হিমাগারে রাখা যায়না। সবজি হিসেবেই বিক্রি করতে হয় বলেও জানান তারা। হঠাৎ আলুর বাজার পড়ে যাওয়ায় লোকসানের ভয়ে অনেক কৃষক ক্ষেতেই রেখে দিয়েছেন, আলু উত্তোলন করছেন না। ছালাপাক চরের আবুল কালাম ও জয়েন উদ্দিন জানান, ক্ষেতে রাখলে শৈত্যপ্রবাহে আলুর ক্ষতির শঙ্কাও রয়েছে।
তিস্তা সেতু এলাকার দুই পার্শ্বে আলুর বস্তা স্তুপ করে রাখা হয়েছে ট্রাকযোগে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানোর অপেক্ষায়। মহিপুর এলাকার স্থানীয় পাইকার আজিজার রহমান, সুরুজ আলী ও নয়া মিয়া জানান, প্রতিদিনই তারা বর্তমানে চরাঞ্চলে ১৫ টাকা কেজি দরে আলু কিনে ঢাকার পাইকারদের কাছে ১৭ থেকে ১৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন। তবে ৬০ কেজি ধারণ ক্ষমতার প্রতিটি চটের বস্তার দাম ৪০ টাকা ও প্রতি বস্তা আলু শ্রমিক দিয়ে পরিষ্কার করতে আরো ২৭ টাকা খরচ করতে হয় তাদের। আলুর বস্তা প্রস্তুত হলে প্রতি ট্রাকে ২২০ বস্তা আলু (১৫ টন) তুলে দেওয়া হয়। খরচ বাদ দিয়ে প্রতিকেজি আলুতে ৫০ পয়সা থেকে এক টাকা লাভ হয় বলেও জানান তারা। স্থানীয় পাইকাররা আরো জানান, ঢাকার পাইকাররা এলাকায় আসেননা। প্রতিদিন মোবাইলফোনে চুক্তি অনুযায়ী টাকা দিলে তাদের কাছে আলু পাঠানো হয়।
আরও পড়ুন- তিস্তা নদী মৌসুমের শুরুতেই শুকিয়ে কাঠ
