Sat. Jul 12th, 2025
ঈদ আসিল অ্যালাও নয়া কাপড় হইল নাঈদকে ঘিরে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা অসহায় মানুষজন যাকাতের কাপড়ের আশায় বাসাবাড়িতে যাচ্ছেন। নগদ কিছু টাকা পেলেও এবারের কাপড় জুটছে নাা কপালে। রংপুর নগরীর সেন্ট্রাল রোড এলাকা। ছবি : স্বপন চেীধুরী

স্বপন চৌধুরী : ঈদ আসিল অ্যালাও নয়া কাপড় হইল না। ‘ঘরোত খাবার না থাকলেও পত্যেক বছর সেমাই খাওয়া ঈদোত নয়া কাপড় (শাড়ী) পিন্দি বেড়াই। বড় মাইনসের (ধনী মানুষ) কাছ থাকি দুই-চাইরখান করি যাকাতের কাপড় পাই, তাকে দিয়া বছরটা চলি যায়। ঈদ তো আসিল, কিন্তুক এইবার এ্যালাও কায়ও কোনো কাপড়-চোপড় দেইল না। ঈদোত হামার গাওত (শরীরে) বুজি নয়া কাপড় চইড়বার নয়।’ সারাদিন রংপুর শহরের বাসায় বাসায় ঘুরে যাকাতের কাপড় না পেয়ে এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন পঞ্চাশোর্ধ মনছুরা বেওয়া। ঈদ সমাগত হওয়ায় তিস্তার চর থেকে ১৫ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে যাকাতের কাপড়ের আশায় শহরে এসেছিলেন তিনি। শুধু তিনিই নন, বিভিন্ন এলাকা থেকে শহরে আসা অভাবি লোকজনকে পাড়া-মহল্লায় দলবেঁধে বাসাবাড়িতে ঘুরতে দেখা যায়। তবে কিছু টাকা সংগ্রহ করতে পারলেও যাকাতের কাপড় জোটেনি কারো ভাগ্যে।

বিগত বছরগুলোর তুলনায় এ বছর রমজান মাসে জাকাতের কাপড়সহ অন্যান্য কাপড়ের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যান্য পোশাকের দামও আকাশছোঁয়া। এছাড়া বিভিন্ন কারণে আয় কমে যাওয়ায় রংপুরের অনেক ধণী ব্যক্তি যাকাত হিসেবে কাপড়ের পরির্বতে নগদ টাকা দিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এ কারণে এবারের ঈদে নতুন জামা-কাপড় ছাড়াই অভাবি পরিবারগুলোর ঈদ করতে হবে। রংপুর অঞ্চলের অন্তত দুই লাখ হতদরিদ্র মানুষ ঈদে যাকাতের নতুন কাপড় থেকে বঞ্চিত হবেন-এমনটাই শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।   

আরও পড়ুন- কোন দোষে রংপুরাঞ্চলবাসী বিশেষ ট্রেন বঞ্চিত

রংপুরের পাইকারি কাপড় ব্যবসায়ীরা জানান, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনার শাহাজাদপুর, উল্লাপাড়া, আতাইকুলাসহ কাপড়ের বিভিন্ন পাইকারি বাজারে সর্বনিম্ন একটি যাকাতের শাড়ি বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৩০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকায়। অথচ গত বছরেই যাকাতের শাড়ির সর্বনিম্ন দাম ছিল ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা টাকা। আগের তুলনায় প্রতিটি শাড়ির দাম বেড়েছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত। লুঙ্গির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। যাকাত হিসেবে দেওয়ার মত প্রতিটি লুঙ্গিতে দাম বেড়েছে কমপক্ষে ১০০ টাকা। একটি  যাকাতের লুঙ্গি বিক্রি হচ্ছে সর্বনিম্ন ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা। কম দামের এসব তাঁতের কাপড়ের দাম বেড়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে নিম্নআয়ের মানুষজন। রংপুর শহরের সেন্ট্রাল রোডস্থ জনতা ট্রেডিং, আলিফ ট্রেডিং, আল মদিনা, জমজম ট্রেডিংসহ যাকাতের কাপড়ের বিভিন্ন পাইকারি দোকানে গিয়ে দেখা যায়, আগের মতো জমজমাট বিক্রি নেই। প্রতিবছর ২০ রমাজানের মধ্যে রংপুরে কয়েক কোটি টাকার যাকাতের কাপড় বিক্রি হলেও এবার অনেক ব্যবসায়ী যাকতের কাপড় নিয়ে হাত গুটিয়ে বসে আছেন।

বিশেষ করে যাকাতের কাপড়ের বিক্রি আগের বছরগুলোর তুলনায় অনেক কম উল্লেখ করে কাপড়ের পাইকারি ব্যবসায়ী আলমাস উদ্দিন জানান, সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় যাকাতের কাপড়সহ সব ধরণের কাপড়ের দাম কিছুটা বেড়েছে। এছাড়া ধণাঢ্য মানুষ যারা যাকাত দেন তাদেরও আয় কমেছে। বিশেষ করে মন্ত্রী-এমপিসহ জনপ্রতিনিধি না থাকার কারণে যাকাতের কাপড় বিক্রি কমে গেছে। জি এল রায় রোডে যাকাতের কাপড়ের একটি দোকানের মালিক সামছুজোহা জানান, একজন জনপ্রতিনিধি প্রতিবছর তার কাছ থেকে কয়েক’শ পিছ যাকাতের কাপড় কিনতেন। এ বছর ওই জনপ্রতিনিধি কাপড়ের পরিবর্তে গরীব-দুঃখীদের নগদ টাকা দিচ্ছেন। তাই এবার তার আগাম আনা কয়েক’শ পিছ যাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি অবিক্রিত থেকে যাবে বলে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি জানান, প্রতিবছর যাকাতের কাপড় যে পরিমান বিক্রি হত, এবার তার অর্ধেকে নেমে এসেছে। বিক্রি নেই বললেই চলে।

আরও পড়ুন- পানি সংকট : দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্পে

এদিকে, ঈদ সমাগত হওয়ায় যাকাতের কাপড়ের আশায় রংপুর শহরে প্রতিদিন ভিড় করছেন বিভিন্ন এলাকার অসহায় নারী-পুরুষ (কোনো রকমে খেয়ে বেঁচে থাকলেও বর্তমান বাজারে যাদের কাপড় কেনার সামর্থ্য নেই)। গ্রাম থেকে শহরে আসাদের মধ্যে সেন্ট্রাল রোডের একটি বাসা থেকে বের হচ্ছিলেন অসহায় কয়েকজন নারী-পুরুষ। তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় ব্যাগ হাতে ঘর্মাক্ত-ক্লান্ত শরীরে সেখানে যোগ দেন গঙ্গাচড়ার তালুক হাবু এলাকা থেকে আসা আছিয়া খাতুন (৫৫) ও মনির উদ্দিন (৬৫)। দু:খ করে তারা বলেন, ‘আগোত ঈদের সময় দুই-চাইরটা কাপড় (শাড়ি-লুঙ্গি) জুটতো। আইজক্যা সকাল থাকি সারাদিন বাড়ি বাড়ি বেড়াইনো, একখান কাপড়ও দেইলনা কায়ও। এইবার মনে হয় নয়া (নতুন) কাপড় ছাড়াই হামাক ঈদ করা নাগবে।’ যদিও সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শহরের বাসাবাড়িতে ঘুরে একেকজন যাকাতের মাত্র ১৫০ থেকে ২০০ টাকা করে পেয়েছিলেন। যা দিয়ে শাড়ি বা লুঙ্গি কোনটাই কেনা সম্ভব নয়।

এ ব্যাপারে যাকাত দেন রংপুর নগরীর এমন বিশিষ্ট ব্যবসায়ীসহ ধণীক শ্রেণির কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, ‘নিজেদের আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি এবার কাপড়ের দাম বেড়েছে তা ঠিক। তবে যাকাতের কাপড় দিলে ঈদের দিন পর্যন্ত স্বস্তিতে বাড়িতে থাকা দায় হয়ে যায়।’ তাছাড়া সময়সহ ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে যাকাত হিসেবে অভাবি লোকজনকে এবারে নগদ টাকাই দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *