সম্পাদকের টেবিল থেকে: ঐতিহাসিক মুক্তাঞ্চল নিয়ে গঠিত সেক্টরের কমান্ডার স্মরণে। আজকের এই লেখাটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী-ফ্যাসিবাদ বিরোধী-গণতন্ত্রকামী এবং দেশী-বিদেশী শোষণ-শাসন থেকে মুক্তিকামী সচেতন পাঠকবৃন্দের সম্মানে, দু’ভাগে তুলে ধরছি। তার আগে পাঠকের সদয় অবগতি ও আন্তরিকভাবে বিবেচনার্থে দু’ভাগ প্রাসঙ্গিক বিষয়েও দুটি কথা তুলে না ধরলে নিজেদের কাছে এবং পাঠক শ্রোতাদের কারো কাছে অকৃতজ্ঞ মনে হতে পারে। তাই কথা দুটো লিখে নিতে হচ্ছে। কেননা, দু’ভাগের লেখার একভাগের শিরোনাম- ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা হামিদুল্লাহ খানের জন্য সশ্রদ্ধ সালাম’ শীর্ষক শিরোনামে ড. মাহবুব উল্লাহর তাৎপর্যপূর্ণ লেখা। অপরটির অত্র ‘শিরোনাম’ কেন্দ্রিক আলোচনা চলমান।
পাঠক, কারণ হিসেবে নির্দ্বিধায় বলত হচ্ছে-‘গণপ্রহরীর প্রধান সম্পাদক-প্রকাশক ও আমার প্রচার বিমুখ গর্বিত স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা-সাংবাদিক এসকে মজিদ মুকুল। যিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনায় গঠিত সেক্টরের মধ্যে ১১নং সেক্টরের অধীন ‘রৌমারী মুক্তাঞ্চল’ খ্যাত ঐতিহাসিক মুক্তাঞ্চলের সংগঠক এবং তাঁর নেতৃত্বে নির্মীত শহীদ মিনারেই আনুষ্ঠানিকভাবে ঐতিহাসিক রৌমারী মুক্তাঞ্চলের ‘ঘোষক’ বীর মুক্তিযোদ্ধা এসকে মজিদ মুকুল। তিনিই প্রথম মুক্তিযোদ্ধা-বাহিনী গড়ে নিজ মাতৃভূমিতে অবস্থান করে এবং জনগণের উপর নির্ভর করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য রৌমারীকে কেন্দ্র করে ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বপারের চরাঞ্চল নিয়ে গড়ে তোলেন রৌমারী মুক্তাঞ্চল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যের শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠাসহ ন্যায়-বিচার, সাম্য ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় তাঁর ভূমিকার জন্য গর্ব করার তেমন কিছু নেই; তাই তিনি এসব নিয়ে প্রচার বিমুখ হয়ে পড়েন। যদিও ইতিপূর্বে যৌক্তিক ও প্রাসঙ্গিক কারণে বিভিন্ন সময়ে কিছু তথ্য লেখালেখিতে প্রকাশ পেয়েছে; নিতান্ত পরিবারের তাগিদ ও তাঁর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের কেন্দ্র করে। সেহেতু লিখতে হচ্ছে ও হবে।
‘ঐতিহাসিক মুক্তাঞ্চল নিয়ে গঠিত সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার স্মরণে দুই ভাগের লেখার দ্বিতীয় ভাগের লেখাটি গণপ্রহরীর মার্চ সংখ্যায় বেশী গুরুত্ববহ ও তাৎপর্যপূর্ণ বটে। কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধে এসকে মজিদ মুকুলকে কৃষক-শ্রমিক-ছাত্রজনতার সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করার অনুপ্রেরণায় ছিলেন এশিয়া আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। একইভাবে তাঁকে (এসকে মজিদ মুকুল) জীবনদানে বলিয়ান হয়ে মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী এবং ঘাঁটি এলাকা হিসেবে মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলার ক্ষেত্রে (?) আজকের দ্বিতীয় ভাগের তাৎপর্যপূর্ণ লেখাটির লেখক-শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি এবং ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা কায়েমের কর্মসূচী ঘোষণার ঘোষক ও পূর্ববাংলা ছাত্র ইউনিয়নের দূরদর্শী ত্যাগী রাজনীতিক ছাত্র নেতা অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহর ভূমিকা গুরুত্ববহ। যিনি (ড. মাহবুব উল্লাহ) আজকের লেখার দ্বিতীয় ভাগে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা হামিদুল্লাহ খানের জন্য সশ্রদ্ধ সালাম’ শিরোনামে তাৎপর্যপূর্ণ লেখাটির লেখক। পাশাপাশি যাঁকে কেন্দ্র করে লেখা- তিনি আলোচিত ‘ঐতিহাসিক রৌমারী মুক্তাঞ্চল’ নিয়ে ভারতের আসাম সীমান্তের মানকার চর ও রৌমারী কেন্দ্রিক গঠিত সেক্টরের বীর প্রতিক খেতাব প্রাপ্ত সেক্টর কমান্ডার-বিমান বাহিনীর উইং কমান্ডার (অব:) বীর মুক্তিযোদ্ধা হামিদুল্লাহ খান। আমরা গণপ্রহরী পরিবার ও প্রধান সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা এসকে মজিদ মুকুলের সহযোদ্ধাদের পক্ষে প্রয়াত সেক্টর কমান্ডার হামিদুল্লাহ খানের আত্মার প্রতি অগ্নিঝরা মার্চ উপলক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদনের সাথে মরহুমের আত্মার শান্তি কামনা করছি। এবং তাঁর গর্বিত পরিবারের সদস্যদের গর্বিত অভিভাবক হারানোর জন্য (যদিও মৃত্যুই স্বাভাবিক) সমবদেনা জ্ঞাপন করছি।

সম্মানিত পাঠক, স্বাধীনতার মাস (মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাস) তথা অগ্নিঝরা মার্চ কেন্দ্রিক আজকের লেখায় স্বাধীনতার ঘোষক, জেডফোর্স অধিনায়ক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তম-এর আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের সাথে সকল শহীদদের আত্মর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। ইতিহাসের বিপক্ষে দাড়িয়ে নয়। ইতিহাসে সত্যটা পুরোপুরি না থাকলে বা পাশ কাটিয়ে লিখলেও আক্ষেপ ও দু:খ থেকেও নয়। এমনকি আবেগ বশত নয়। বাস্তবতার নিরিখে-সত্যতার আলোকে দৃঢ়তার সাথেই বলছি, গণপ্রহরীর প্রধান সম্পাদক প্রচার বিমুখ বীর মুক্তিযোদ্ধা এসকে মজিদ মুকুলের ঘোষিত ও সংগঠিত মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত ‘রৌমারী মুক্তাঞ্চল’ মূলত : ‘ঐতিহাসিক মুক্তাঞ্চল’ অর্থাৎ ঐতিহাসিক রৌমারী মুক্তাঞ্চল। আর সেই ইতিহাসের স্বাক্ষী হচ্ছে জেড ফোর্স অধিনায়ক ও স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানের প্রস্তাব ও উদ্যোগে মুক্তাঞ্চল ভিত্তিক ‘ডাক যোগাযোগের ব্যবস্থা’ এবং রৌমারী মুক্তাঞ্চল থেকে ‘শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা’ হয় আনুষ্ঠানিকভাবে। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে স্বাধীনতার ঘোষক বীর মেজর জিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে ডাক বিভাগ উদ্বোধন করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এবং একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে দায়িত্ব অর্পনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কার্যক্রম চালু করেন। এবং মাননীয় মন্ত্রী এম কারুজ্জামান, সরকারের আয় বৃদ্ধিকল্পে আবগারি ও শুল্ক বিভাগ (কাষ্টামস এণ্ড এক্সাইজ) উদ্বোধন করেন। শিক্ষক নিয়োগের মধ্য দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানীর উপস্থিতিতে ও তাঁর আদেশে উদ্যোক্তা হিসেবে শিক্ষা কার্যক্রম উদ্বোধন করেন জিয়াউর রহমান। এভাবেই বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের যাত্রা শুরু হয় ‘ঐতিহাসিক রৌমারী মুক্তাঞ্চল’ থেকে।
পাঠক, ভাবনায় হয়তো প্রশ্ন জমা হয়েছে, বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল তারাতো তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহন করেনি? রৌমারী মুক্তাঞ্চল নিয়ে গঠিত সেক্টরের কমাণ্ডার জীবদ্দশায় ঐতিহাসিক রৌমারী মুক্তাঞ্চলকে (সাবেক রংপুর জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বপাড়ের কুড়িগ্রামের রৌমারী (রাজিবপুর যুদ্ধকালে ইউনিয়ন ছিল) কেন্দ্র করে উলিপুর, চিলমারীর চরাঞ্চল, গাইবান্ধা সদররের মোল্লার চর, ফুলছড়ি-সাঘাটার চরাঞ্চলসহ জামালপুরের আংশিক চরাঞ্চল নিয়ে বৃহৎ চরাঞ্চল ভিত্তিক বৃহৎ মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলা হয়। অথচ সেই বিশাল মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধারাই কেনো স্বীকৃতি পাননি; সে নিয়ে সেক্টর কমাণ্ডার হামিদুল্লাহ খান কি ভূমিকা রেখেছেন? হ্যাঁ, পাঠক তা বলতেই পারেন। তবে আমাদের কথায়ও আছে এমন প্রশ্ন। যেমন, যে শহীদ মিনারে শপথ নিয়ে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা ও মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী গঠন; সেই শহীদ মিনার আড়াল করতে ঐতিহাসিক ‘চানমারী’কে করা হয়েছে আড়াল, যা দৃষ্টিকটু।
আরও পড়ুন- মুক্তিযুদ্ধের বিজয় কি সত্যিই দূরে (?)
মূলত: আমারও জানামতে কোনো সরকার এবং সেক্টর কমাণ্ডার কর্তৃক এ ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ গৃহীত হয়নি। যদিও ঐতিহাসিকভাবে যে অঞ্চল ও যে অঞ্চলের মানুষের মূল্যায়নসহ মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি মেলেনি, সবমিলে ‘দুর্ভাগ্য’ বলেই উল্লেখ করতে হচ্ছে মাত্র। শুধু মুক্তাঞ্চল রক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা এবং ভারতের সহযোগীতা না নিয়ে, ভারতে না গিয়ে জনগণের উপর নির্ভর করে বিজয় অবধি যুদ্ধা করা নিয়ে দুটো কথা বলেই দ্বিতীয় ভাগের লেখার দিকে যাবো। ‘কথায় কথা আসে’-প্রবাদের মতো কথা এসে গেলো। স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলার কর্মসূচী ঘোষণাকারী ড. মাহবুব উল্লাহর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রিয় কমিটির প্রতিনিধি হিসেবে কেন্দ্রীয় আরেক ত্যাগী পরীক্ষিত নেতা সামসুজ্জোহা মানিক রংপুর অঞ্চলের দায়িত্ব দিয়েছিলেন, আমার গর্বিত স্বামী এসকে মজিদ মুকুলকে। এবং মুক্তিযুদ্ধের রণনীতি-রণকৌশল হিসেবে রৌমারীকে চিহ্নিত করে সেখানেই ঘাঁটি এলাকা গড়ে তুলতেই ঐতিহাসিক রৌমারী মুক্তাঞ্চল এবং প্রথম মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী গড়ে তোলা। এবার মুক্তাঞ্চল ও মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী গঠন প্রসঙ্গ।
ঐতিহাসিক মুক্তাঞ্চল নিয়ে গঠিত সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার স্মরণে’ শীর্ষক প্রথমভাগের লেখার শেষ পর্যায়ে পাঠক অবগতির জন্য বলতে চাই, লেখক-শিক্ষাবিদ মাহবুব উল্লাহ ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলার কর্মসূচী ঘোষণার পর পূর্ব প্রস্তুতি মতে ষাট দশকের শেষ দিকে আমার গর্বিত স্বামী এসকে মজিদ মুকুলের নেতৃত্বে নির্মিত শহীদ মিনারেই সম্ভবত: ২৭ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন, এশিয়া-আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার স্বীকৃত মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী নেতৃত্বাধীন কৃষক সমিতি, শ্রমিক সংগঠন ও ন্যাপের সমন্বয়ে ভাসানী বাহিনী নামে (তাঁর অনুমোদিত) অপ্রকাশ্যে গড়ে তোলা মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী (অনেকেই বলতেন মজিদের বাহিনী বলে শুনেছি)’র বেশ ক’জন নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে, শহীদ মিনারে বায়ান্ন-উসত্তর এবং সেদিনটি পর্যন্ত আত্মবলিদানকারী বীর শহীদদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে; ‘মুক্তাঞ্চল ঘোষণার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর আত্মপ্রকাশ’ ঘোষণা করেন। এই ঘোষণা উপলক্ষ্যে সতর্কতা অবলম্বনে কিছুটা প্রতিকী স্বরূপ বাহিনীর সদস্যদের (অল্প সংখ্যক) শপথ করান এসকে মজিদ মুকুল। শপথে ছিল-‘জীবন দিয়ে হলেও মুক্তিযুদ্ধকে সফল করা এবং মুক্তাঞ্চল টিকিয়ে রেখে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার’। ২৬ মার্চ চট্টল বেতার থেকে মেজর জিয়ার ঘোষণার পর প্রকাশ্যে বিভিন্ন নদীর চর, বিল ও ফাঁকা মাঠে প্রশিক্ষন চলমান থাকে এবং মুক্তাঞ্চল রক্ষায় ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বপাড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পাহারা বিদ্যমান থাকে।
মে’৭১-এর ২ তারিখের দিকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের থার্ড বেঙ্গলের বীর সেনানীদের গ্রুপ লিডার সুবেদার আফতাব আলী (সুবেদার আলতাফ নামে বহুল পরিচিত)’র নেতৃত্বে একটি দল পূর্বযোগাযোগ সূত্রে রৌমারী মুক্তাঞ্চলে পৌঁছেন। পরিচয় পর্বের পর অনুষ্ঠিত দীর্ঘ সময় আলোচনা-পর্যালোচনান্তে ভাসানী বাহিনী নামে মজিদ মুকুলের বাহিনী বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। বিশাল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাদের পেয়ে বীর সেনা সদস্যরা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। সবাইকে নিয়ে গঠিত হয় সুবেদার আলতাফ কোম্পানী এবং সর্বসম্মতভাবে কোং অধিনায়ক হন সুবেদার আফতাব আলী (যিনি যুদ্ধের কৃতিত্বের জন্য অনারারি ক্যাপ্টেন আফতাব আলী বীর উত্তম, বীর প্রতীক খেতাব পান)। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে যুদ্ধের নীতি-কৌশল নির্ধারক উপদেষ্টা নির্বাচিত হন এসকে মজিদ মুকুল এবং সিদ্ধান্ত মতে, তিনি যে সম্মুখ ও গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিবেন, সে যুদ্ধের নেতৃত্বও দিবেন তিনি। এই মহতি যৌথ আলোচনায সার্বিক বিষয় আলোচিত হয় এবং মুক্তাঞ্চল থেকে মুক্তাঞ্চলবাসীর সার্বিক সহযোগিতার উপর নির্ভর করে (ভারতে না গিয়ে) মুক্তিযুদ্ধে আত্মনিয়োগ করতে একামাত্র সেই শহীদ মিনারে একইভাবে শপথ গ্রহন করা হয়। সুবেদার আফতাবের সভাপতিত্বের যৌথ আলোচনায় প্রতিনিধিত্ব করেন বীর সেনাদের পক্ষে নায়েক (অব: সুবেদার) শেখ আব্দুল মজিদ, নায়েক রেজাউল ইসলাম (অব: অনারারি ক্যাপ্টেন, বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত), সিপাহী (সিনিয়র) আবুল কাশেম ও মফিজুল্যাহ প্রমুখ এবং মুক্তিযোদ্ধা গেরিলাদের পক্ষে শাহ আব্দুল মান্নান, কবি আব্দুর রাজ্জাক, নুরুজ্জামান সর্দার, কিশমত আলী, ফজলুর রহমান ফজলু, মতিউর রহমান মজনু, আব্দুল আজিজ গাজী ও হারুন অর রশীদ প্রমুখ।
এক পর্যায়, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের লক্ষ্যে যুদ্ধকে তরান্বিত করতে ১১টি সেক্টর গঠিত হলে জেড ফোর্সের অধীনস্থ থার্ড বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিশেষ কোং হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং ঐতিহাসিক রৌমারী মুক্তাঞ্চল রক্ষায় দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে সম্মুখ যুদ্ধ ও গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে বহুল আলোচিত ২ এম এফ কোম্পানী। ঐতিহাসিক কোদালকাটি যুদ্ধের পর চিলমারী যুদ্ধ ছাড়া তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো যুদ্ধ করতে হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এক পর্যায় বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্ণেল তাহের ১১ নং সেক্টরে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যোগদানের পর তিনি ময়মনসিংহের কামালপুর যুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দূরপাল্লায় গোলায় আহত হয়ে একটি পা হারান-‘আমরা তাঁর আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি’। আবারও সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্বে পুনর্বহাল হন উইং কমাণ্ডার হামিদুল্যাহ খান বীর প্রতিক।
আরও পড়ুন- মওলানা ভাসানী স্বাধীনতার প্রবক্তা
প্রাসঙ্গিকভাবে আলোচিত ২ এম এফ কোম্পানীতে ছিলেন মেডিকেল কোরের সেনাসদস্য ও আমার সেজো ভাই মকবুলার রহমান বাদল তিনি নিজেও সম্মুখযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সেকশন-প্লাটুন কমাণ্ডার ছিলেন। আমার মেজো ভাই আর্টিলারি কোরের বীর সেনানী (ক্যাপ্টেন মাহবুব নামে বহুল পরিচত) আলী মাহবুব প্রধান ভাই ছিলেন মানকার চর সীমান্তে কাকড়িপাড়া ইয়থ ক্যাম্পের ইনচার্জ। ২ এম এফ কোম্পানীর দখলকৃত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর লঞ্চ ও স্পীডবোটগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে সেগুলো নিয়ে মানকারচরে অবস্থান করতেন ২ এম এফ কোম্পানীর নৌবাহিনী সেনানী বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজিউল ইসলাম কাজিউল ভাই। আমরা স্বপরিবারে রৌমারী মুক্তাঞ্চলে ছিলাম। ফলে উপরোল্লিখিত তথ্যাবলীর অনেকটাই জানা ছিল এবং আমার সাহেব প্রচার বিমুখ হলেও মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন লেখা আমাকে এসব বিষয়ে নিশ্চিত করেছে।
এতদসঙ্গে আরও উল্লেখ্য, গণপ্রহরী সম্পাদকের ব্যক্তিগত সহকারী ও পরীক্ষামূলক ওয়েবসাইটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কেএস মৌসুমীর সহায়তায় গণপ্রহরীর পুরনো ফাইল থেকে প্রথম ভাগের লেখাটিতে উল্লেখিত তথ্যাবলী সংগৃহীত।
দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)-এর উদ্যোগে এবং বিএনপি ও আওয়ামীলীগসহ সর্বদলীয় কমিটির পক্ষে ঐতিহাসিক রৌমারী মুক্তাঞ্চলের ঘোষক-প্রথম মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর নেতা, গাইবান্ধা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ইউনিট কমাণ্ডার, গাইবান্ধা প্রেসক্লাবের সভাপতি ও জাতীয় সাংবাদিক সংস্থার কেন্দ্রীয় মহাসচিব এসকে মজিদ মুকুলের সংবর্ধণা অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে আয়োজিত, ২০০৪ সালে অতদঞ্চলের স্মরণকালের বৃহৎ মুক্তিযোদ্ধা জনসভায় উপরোক্ত বর্ণনাদি আলোচনায় এনে তার সত্যতা যাচাই করা হয়েছে, যা সমর্থিত হয়েছে। যে মুক্তিযোদ্ধা সভায় অংশ নিয়েছিলেন-মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রিয় কমাণ্ড কউন্সিলের সাবেক মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা নঈম জাহাঙ্গীর, ক্যাপ্টেন আব্দুর রশীদ এবং মুক্তিযুদ্ধকালে উক্ত মুক্তাঞ্চলে অবস্থানকারী গাইবান্ধা অঞ্চলের এমএনএ ও ভাষা সৈনিক লুৎফর রহমান, কুড়িগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম ও শওকত আলী বীর বিক্রম, কেন্দ্রীয় জাতীয়তাবাদী শ্রমিকদলের নেতা মুক্তাঞ্চলে মুক্তযুদ্ধে যোগদানকারী নরুল ইসলাম খান নাসিম, নজির হোসেন ও গরীবি হটাও পার্টির নেতা ভাষা সৈনিক কমরেড নুরুল হক মেহেদী প্রমুখ।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে পতিত সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী প্রধান অতিথি, অনারারি ক্যাপ্টেন (অব:) আফতাব আলী বীর উত্তম-বীর প্রতিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এসকে মজিদ মুকুল বিশেষ অতিথি হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা জনসভায় বক্তব্য রাখেন। প্রধান অতিথির বক্তব্যে মন্ত্রী উপরোল্লিখিত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্ত করার কথা দিলেও অজ্ঞাত কারণে তা করা হয়নি। যদিও অনেকেই এখনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন।
এবার ‘ঐতিহাসিক মুক্তাঞ্চল নিয়ে গঠিত সেক্টরের সেক্টর কমাণ্ডার স্মরণে’ শীর্ষক লেখায় দ্বিতীয় ভাগে একাত্তরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার পল্টন ময়দানে পূর্ববাংলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা কায়েমের কর্মসূচীর ঘোষক দেশের খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ-অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহর ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা হামিদুল্লাহ খানের জন্য সশ্রদ্ধ সালাম’ শীর্ষক তাৎপর্যপূর্ন লেখাটি পাঠকের সম্মানে তুলে ধরছি।
উল্লেখ্য, ‘১৯৭১ সালের অগ্নিঝড়া মার্চে শুরু হওয়া মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই হোক আমাদের চিন্তা-চেতনার ভিত্তি’। ফাতেমা মজিদ জুঁই, সম্পাদক, গণপ্রহরী।
বীর মুক্তিযোদ্ধা হামিদুল্লাহ খানের জন্য সশ্রদ্ধ সালাম

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডার উইং কমান্ডার (অব:) হামিদুল্লাহ খাঁন গত ডিসেম্বর ২০১১ সালে আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেছেন। উচ্চ রক্তচাপজনিত জটিলতা নিয়ে তাকে সমিরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্তু চিকিৎসকরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেও তার জীবন রক্ষা করতে পারেননি। ৭০-উর্ধ্ব বয়সে তার মৃত্যু ঘটলো। তার অসুস্থতার সংবাদ জাতীয় প্রেস ক্লাবে একটি সেমিনারে যোগদান করতে যাওয়ার পথে জানতে পারলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই জানা গেল তিনি আর ইহলোকে নেই। বিভিন্ন সময়ে তার সঙ্গে আলাপ চারিতার সুযোগ আমার হয়েছিল। জাতীয় প্রেস ক্লাবে একাধিক সেমিনার ও রাউন্ড টেবিল অনুষ্ঠানেও আমরা এক সঙ্গে কথা বলেছি। সুঠামদেহী এই যোদ্ধার বয়স বোঝা যেতো না।তাহলেও বর্কমান সময়ের বিচারে তার এমন কোনো বয়স হয়নি যে কিনি আমাদের ছেড়ে চলে যেতে পারেন। তারপরও মুসলমান হিসাবে আমাদের বিশ্বাস করতে হবে, হায়াত-মউত ও রিজিকের মালিক আল্লাহ। স্রষ্টার অমোঘ নিয়ম থেকে আমরা কেউই ব্যাতিক্রম নই। আমার দুর্ভাগ্য, সেক্টর কমান্ডার উইং কমান্ডার (অব.) হামিদুল্লাহ খানের স্মারণে শহীদ মিনারে যে শোক সভার আয়োজন করেছিল সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ তাতে নগরীর দুঃসহ যানজটের কারণে সময়মত পৌছাতে না পারায় আমি যোগ দিতে পারিনি। এই মনোকষ্টের বোঝা আমাকে আমৃত্যু বহন করতে হবে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যার জন্য অনুশোচনা আজীবন করতে হয়। আমার জীবনে সেরকম একটি অনুশোচনা যোগ হলো।

হামিদুল্লাহ খান সাহেব মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বীর প্রতীক উপাধিও পেয়েছিলেন। পাকিস্তান বিমান বাহিনির একজন বিদ্রোহী কর্মকর্তা হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। একজন বিপ্লবী রাজনৈতিক নেতার মতে কিছু সময়ের জন্য কেউ বিপ্লবী হতে পারে, কিন্তু চিরজীবনের জন্য বিপ্লব হওয়া অত্যন্ত কঠিন। আমরা ঠিক একইভাবে বলতে পারি, ‘৭১ সালে একবার মুক্তিযোদ্ধা হয়েও অব্যাহতভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করা প্রকৃত প্রস্তাবে অত্যন্ত বিরল। কিন্তু হামিদুল্লা খান ছিলেন সেসব বিরল মুক্তিযোদ্ধার একজন, যিনি স্বাধীনতার চেতনাকে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার সময় পর্যন্ত অত্যন্ত দৃঢ়তায় সঙ্গে ধারণ করেছিলেন। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতার শত্রু ছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। সেই সময় এদেশের হাজার হাজার তরুণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আত্মসংরণের তাগিদ থেকে। এই মুক্তিযুদ্ধ কোনো দল বা গোষ্ঠিীর ব্যক্তিগত সম্পদ নয়। যখন মুক্তিযুদ্ধকে দলবিশেষের একচেটিয়া মালিকানা বলে দাবি করা হয় তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটিই নিহত হয়। জাতি হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, কেউ যদি বিশেষ দলভুক্ত হয়, তাহলে যুদ্ধের ময়দানে না গিয়েও, মুক্তিযোদ্ধার ময়দানে না গিয়েও মুক্তিযোদ্ধার সনদ পেতে পারে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে নানাভাবে বিতর্কিত করে তোলা হয়েছে। এই বিতর্কের সূত্র ধরে জাতির মধ্যে খাড়াখাড়িভাবে দুটি ভাগ করে ফেলা হয়েছে। একটি হলো স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। বাংলাদেশের বয়স ৪০ বছরে তিনি বিদায় নেন। বর্তমানে ৬৪। জন্মমৃত্যুর নিয়মে বিদ্যমান জনগোষ্ঠীতে কোটি কোটি মানুষের যোগ হয়েছে যারা ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি অথবা জন্মগ্রহণ করলেও সেই সময়ে তারা ছিল শিশু। যার ফলে এদের পক্ষে সেই সময়কার ঘটনাবলী সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা সম্ভব নয়। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হলো তারা এবং তাদের অন্ধ অনুসারীরা এমন একটি আবহ সৃষ্টি করল যে মুক্তিযুদ্ধের সময় সীমান্ত অতিক্রম করে যারা ভারতে যায়নি বা যেতে পারেনি তারা সবাই কলাবরেটর। তাহলে ব্যাপারটি কী দাঁড়াল? সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। এর মধ্যে ১ কোটির মতো মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে চলে যায় এবং সীমান্ত সংলগ্ন ভারতীয় রাজ্যগুলোতে শরণার্থী হয়। ভারতীয় ভুখণ্ডে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সামরিক প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে থেকে গেল সাড়ে ৬ কোটি মানুষ। এই সাড়ে ৬ কোটি মানুষ যেহেতু সীমান্তের ওপারে যায়নি, সেহেতু তাদের কপালে কলাবরেটরের তিলক পরানো হলো। কী ভয়াবহ কথা। যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন হয়েছে। সেই দেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের মধ্যে সাড়ে ৬ কোটি কলাবরেটর। তাহলে মুক্তিযুদ্ধের মহিমা কোথায় গেল? এজন্যই সাপ্তাহিক হলিডের প্রয়াত সম্পাদক এনায়েতউল্লাহ খান যে বহুল আলোচিত কলামটি তার পত্রিকায় লিখেছিলেন তার শিরোনাম ছিল (Sixty five million Colaborators ) এনায়েতউল্লাহ খানের বিখ্যাত এই কলমটি জাতির চৈতন্যে বিশাল আঘাত হেনেছিল। জাতিকে বিভ্রান্ত এবং আশাহত করে মুষ্টিমেয় ফন্দিবাজরা যে সুবিধা লুণ্ঠন করতে চেয়েছিল তার ওপর বিশাল এক চপেটাঘাত হানা হয়েছিল এই কলামটির মাধ্যমে। সাংবাদিকতা পেশায় মহত্ত্ব এখানেই। এরকম সাংবাদিকতাই পারে বিভ্রান্ত ছত্রভঙ্গ জাতিকে দিশার পথ দেখাতে। আজও এ ধরনের সাংবাদিকতার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি। বরং বলা চলে, এর প্রাসঙ্গিকতা বেড়েছে বহুগুণ।
‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত আমাদের মিত্র ছিল। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্য-সহযোগিতা আমরা পেয়েছিলাম। এই সাহায্য-সহযোগিতার কথা অস্বীকার করলে ইতিহাসকে অস্বীকার করা হবে। কিন্তু পাশাপাশি এই প্রশ্নটিও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক যে, ভারতের সাহায্য-সহযোগিতার পেছনে কি নিছক পরার্থপরতাই কাজ করেছিল?
আন্ত:রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরার্থপরতার কোনো স্থান নেই। প্রত্যেক রাষ্ট্রই তার রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় স্বার্থের নিরিখে অন্য রাষ্ট্রের প্রতি নীতি নির্ধারণ করে থাকে। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর জন্য একটি ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। ভারত তার চিরশত্রু পাকিস্তানকে চিরতরে কাবু করে ফেলার জন্য সুযোগটি খুঁজে পায় পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার জনগণের বিদ্রোহে। এদেশের নির্যাতিত মানুষ হিসেবে আমাদেরও কোনো দ্বিধা ছিল না ভারতীয় সাহায্য-সহযোগীতা গ্রহণ করতে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে দৃশ্যপট সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। যুদ্ধের মিত্র ভারতের আচরণ এদেশের মানুষকে ক্ষুব্ধ করে ফেলে। ভারতীয় সৈন্যরা এদেশে থেকে পাকিস্তান সমর্পিত সমুদয় অস্ত্রশস্ত্র কনভয় বোঝাই করে ভারতে নিয়ে যায়। ভারতীয়রা তাদের স্বার্থ ঠিকই বুঝেছিল। তারা যথাযথই অনুধাবন করতে পেরেছিল, এসব অস্ত্র যদি বাংলাদেশ বাহিনীর হাতে থাকে তাহলে বাংলাদেশ বাহিনী তাৎক্ষনিকভাবে একটি শক্তিশালী বাহিনী রূপে আত্মপ্রকাশ করবে। যে বাহিনী তাদের দৃষ্টিতে স্ট্র্যাটেজিক এনিমিতে পরিণত হতে পারে। এজন্য তারা কোনো দুর্নামের তোয়াক্কা না করেই War butty হিসেবে এসব অস্তশস্ত্র এবং অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী নিজ দেশে নিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমাণ্ডার মেজর (অব:) জলিল তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। সমরাস্ত্র ও মূল্যবান সামগ্রী নেওয়া ছাড়াও পরবর্তীকালে ভারত সরকার বাংলাদেশের প্রতি ক্রমাগত বৈরিতা প্রদর্শন করে এসেছে। অভিন্ন নদীর পানি প্রত্যাহার, অসম বাণিজ্য, সীমান্তে বাংলাদেশীদের হত্যা, পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র বিদ্রোহের উস্কানী, তালপট্টি দ্বীপ দখলসহ ভারতীয় বৈরিতার অজস্র দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। তাহলে ব্যাপরটি কী দাঁড়াল? আমরা পাকিস্তানি শাসন ও শোষণ থেকে মুক্ত হলাম বটে; কিন্তু আমাদের পড়তে হলো ভারতীয় শোষণ ও লুণ্ঠনের কবলে। আমরা একটি পতাকা ও ভুখন্ড পেলাম। কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিরঙ্কুশ হলো না। হাঙরের চোয়াল থেকে বের হয়ে এসে আমরা কুমিরের চোয়ালে আবদ্ধ হয়ে গেলাম। সুতরাং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ থেকে গেল অসমাপ্ত। একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার জন্য কর্তব্য হলো অসমাপ্ত এই মুক্তিযুদ্ধের সফল সমাপন ঘটানো। বীর মুক্তিযোদ্ধা উইং কমাণ্ডার হামিদুল্লাহ খান মুক্তিযুদ্ধকে এই বাস্তবতার নিরিখেই মূল্যায়ন করতেন। তিনি ছিলেন ভারতীয় শোষণ-লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে এক অকুতোভয় লড়াকু সৈনিক। অর্থাৎ তিনি ছিলেন একজন আপদমস্তক চিরন্তন মুক্তিযোদ্ধা। সেরকম একটি মানুষকে হারিয়ে জাতি যে কত বড় ক্ষতির সম্মুখীন হলো তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। সেক্টর কমাণ্ডার্স ফোরাম নামে একটি সংগঠন আছে। সেক্টর কমান্ডার ও সহযোদ্ধা হয়েও ওরা সেক্টর কমান্ডার হামিদুল্লাহ খানের মৃত্যুতে শোক প্রকাশের সৌজন্য বোধ করেনি। এদের এই অসৌজন্যমূলক আচরণের নিন্দা করার ভাষা আমাদের জানা নেই।- ড. মাহবুব উল্লাহ। (গণপ্রহরীর পুরাতন ফাইল থেকে)
