রংপুরে পাঁচ শতাধিক ক্যান্সারযোদ্ধাদের নিয়ে ব্যতিক্রমী আয়োজন
মৌসুমী শঙ্কর : ক্যান্সার মানেই জীবন শেষ নয়। ‘লিভারে পানি জমেছিল আমার। ১৩ বছর ধরে ক্যান্সারে ভূগছি, থেরাপি দেই। ঢাকা ও রাজশাহীতে চিকিৎসকরা আমাকে ফেরত দেওয়ায় মরণের ভয় কাজ করছিল ভীষণভাবে। শেষ চেষ্টা হিসেবে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. জাহান আফরোজ লাকী’র স্মরণাপন্ন হই। তার পরামর্শে নিয়ম মেনে চলায় আল্লাহর কৃপায় আমি এখন ভালো আছি। এভাবে ক্যান্সার আক্রান্ত প্রত্যেকে যেন আমার মতো সুস্থ্য হয়ে যায়।’ রংপুরে আয়োজিত ক্যান্সার যোদ্ধাদের মিলনমেলা এবং সচেতনতা কর্মসূচিতে এভাবে নিজের অভিজ্ঞতা ও সফলতার গল্প শোনান নগরীর উত্তম এলাকার লাইলি বেগম। এই মিলনমেলায় রংপুর বিভাগের ৮ জেলার পাঁচ শতাধিক ক্যান্সার যোদ্ধা অংশ নেন।
‘ক্যান্সারের নেই এনসার’ সমাজে প্রচলিত এমন বাক্যকে ভূল প্রমাণিত করেছেন রংপুর বিভাগের ক্যান্সার যোদ্ধারা। সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার নজির গড়েছেন তারা। দূরারোগ্য ব্যাধি থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসায় তাদের নিয়ে ব্যতিক্রমী এই আয়োজন করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগ। নগরীর একটি কমিউনিটি সেন্টারে গত ২৬ এপ্রিল আয়োজিত মিলনমেলায় ‘ক্যান্সার মানেই জীবন শেষ নয়, এটি একটি যুদ্ধ। আর প্রতিটি যোদ্ধাই একেকজন বীর’-এই মন্ত্রকে ধারণ করে দিনব্যাপী আয়োজনে আগত ক্যান্সার যোদ্ধাদের নিয়ে সচেতনতামুলক আলোচনা, র্যালি, র্যাফেল ড্রসহ বিভিন্ন খেলাধুলা ও পুরষ্কার বিতরণ করা হয়। এতে অংশ নিয়ে ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকার গল্প শোনান যোদ্ধারা। এসময় গাইবান্ধার সামছুল হক, তহমিদা বেগম, লালমনিরহাটের সহিবার রহমান, কুড়িগ্রামের ইছাব উদ্দিন, সৈয়দপুরের শাহিদা খাতুন, রংপুরের মিঠাপুকুরের হাসিনা পারভেজ, বুড়িরহাটের নার্গিস বেগমসহ ক্যান্সার যোদ্ধারা নিজেদের চিকিৎসা, অভিজ্ঞতা ও নিয়ম মেনে ভালো থাকার গল্প সম্পর্কে আলোকপাত করেন।
গাইবান্ধার তহমিদা বেগম বলেন, ‘৫ বছর আগে আমার ক্যান্সার ধরা পড়ে। পরিবারের লোকজন প্রথম দিকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতো। সময়মত চিকিৎসা গ্রহণসহ চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলায় এখন আমি সুস্থ্য। পরিবারের সদস্যদের সেই ভয়টাও কেটে গেছে।’ রংপুরের রানীপুকুরের হাসিনা পারভেজ বলেন, ক্যান্সার এমন একটি ব্যাধি, একজন আক্রান্ত হলে গোটা পরিবারকে তছনছ করে দেয়। নিজেকে দিয়ে প্রমাণ পেয়েছি, ক্যান্সার মানেই মৃত্যু নয়। দীর্ঘদিন ভোগার পরে সুষ্ঠু চিকিৎসা ও আল্লাহর রহমতে আমি সম্পূর্ণ সুস্থ্য হয়েছি। আমাদের এই সফলতার গল্পগুলো চারদিকে ছড়িয়ে দিতে হবে।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. জাহান আফরোজ লাকী’র সভাপতিত্বে আলোচনা অনুষ্ঠানে ক্যান্সার রোগ নির্ণয়, সঠিক চিকিৎসা এবং ক্যান্সার সচেতনতা নিয়ে আলোচনা করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। সভায় বক্তব্য রাখেন রেডিওথেরাপি বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. শফিকুল ইসলাম, ডা. সরকার তানভীর জাহিদ, ডা. আরিফ হাসনাত, ডা. এরশাদুল, ডা. মনি রানী, ডা. সোহেলী বিনতে মোস্তফা মিষ্টি, ডা. আফসানা ফেরদৌস, এমবিবিএস, এমপিএইচ, এমএসসি ফিল্ড অফিসার, ইউএনএফপিএ ডা. শাহিন আক্তার প্রমুখ। এসময় বিভিন্ন ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির কর্মকর্তারা মরণব্যাধি ক্যান্সারকে জয় করার লক্ষ্যে রংপুরে ক্যান্সার যোদ্ধাদের নিয়ে এমন ব্যতিক্রমী আয়োজনের ভূয়শী প্রশংসা করেন। বক্তারা বলেন, সঠিক সময়ে ক্যান্সার রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলে রোগীরা দ্রুত সুস্থ্য হয়ে ওঠেন। এ রোগে আক্রান্ত রোগীদের শেষ দিকে চিকিৎসা শুরু করলে অনেক ক্ষেত্রে তাদের সুস্থ্য করে তোলা সম্ভব হয় না। এছাড়া গ্রামের অনেক নারী-পুরুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেই মনে করেন মৃত্যু নিশ্চিত। এতে করে তাদের মনোবল ভেঙে যায়। অথচ সঠিক চিকিৎসা করে অনেক রোগী স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে। ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসায় আলাদা সরকারি হাসপাতাল নির্মাণ, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির ব্যবস্থা এবং সচেতনতা বৃদ্ধির উপর গুরুত্বারোপ করা হয় আলোচনা সভায়। এর পর একটি জনসচেতনতামূলক র্যালির উদ্বোধন করেন রংপুর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. শরিফুল ইসলাম। এতে উপস্থিত ছিলেন উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আনোয়ার হোসেন, রংপুর কমিউনিটি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সামসুজ্জামান প্রমুখ। র্যালিটি রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ক্যাম্পাসসহ নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান ডা. জাহান আফরোজ লাকী বলেন, ক্যান্সার মানেই মৃত্যু নয়, ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীরাও যে সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে সেটা মানুষকে জানানোর লক্ষ্যে এ মিলনমেলার আয়োজন। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেডিওথেরাপি মেশিন নষ্ট। এর পরেও আমরা রোগীদের যথাসাধ্য ক্যান্সারের চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ্য করে তুলেছি। আমি ক্যান্সার রোগীদের দূর্ভোগ লাঘবে ঔষধ ও যন্ত্রাংশ সরবরাহসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মেডিকেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এটি করা সম্ভব হলে ক্যান্সার রোগীরা এ সরকারি হাসপাতাল থেকেই ক্যান্সারের সকল চিকিৎসা পাবে। সেইসঙ্গে তিনি বলেন, চিকিৎসায় ভালো হওয়া শুধু নয়, ক্যানাসার যাতে না হয় সেজন্য প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। বিশেষ করে রংপুর অঞ্চলের মানুষকে খৈনি, গুল, জর্দা ও বিড়ি-সিগারেটসহ তামাকজাতীয় পণ্য বর্জনের আহবান জানান তিনি।
আরও পড়ুন- গাইবান্ধার উন্নয়ন: সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
