ক্ষমতাবানদের সন্তানরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েনাহেতু শিক্ষক সংকট উপেক্ষিত। দেশের মোট জনসংখ্যা, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ও শিক্ষার্থীদের সংখ্যানুপাতে, সাধারন জ্ঞানে একটু বিবেচনা করলেই শিক্ষার ভিত্তি হিসেবে প্রথমিক বিদ্যালয় অর্থাৎ ‘সংখ্যানুপাতে’ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এখনও বিবেচিত। অথচ শিক্ষক সংকটে সেইসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা স্থবির হয়ে পড়েছে। কারণটা শিরোনামই বলেছে। প্রবাদও বলেছে-‘গরীবের দুঃখ বারো মাস’। বাস্তবতা এর সাথে যোগ দিয়েছে ‘সর্বক্ষেত্রে’। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গড়ে প্রায় সকলেই গরীবের সন্তান হিসেবে ‘গরীব’। তাইÑ।
ইতিমধ্যে ক্ষমতাবানরা পরস্পর ভূমিকার বর্ণনা শুনে ক্ষিপ্ত হয়েছেন হয়তো। কিন্তু যতই ক্ষমতাধর হোননা কেন, ভুলে যাওয়া যাবেনা যে, দেশের সংবিধানে লেখা রয়েছে ‘জনগণই রাষ্ট্রের মালিক’। এবং ‘অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার মতো মানুষের জন্মগত মৌলিক অধিকার’ নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়োজিত সরকারের। তাই এই ‘প্রতিবেদন ক্ষমতাবানদের প্রতিনিধিত্বকারি সরকারকে স্মরণ করে দিচ্ছে যে, শ্রেনীবৈষম্যের সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় জীবনে আকাশপাতাল বৈষম্যের শিকার ‘শ্রমজীবি কর্মজীবি দিনমজুর গরীব-সর্বহারা ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মানুষ এবং তাঁদের অনেকের সন্তানদের রক্তের বিনিময়ে সফল জুলাই গণঅভ্যূত্থানই ক্ষমতাসীন করেছে অন্তর্বর্তী সরকারকে। তাই ‘তাঁদের সন্তানদের শিক্ষার নিশ্চয়তা বিধানে জরুরী পদক্ষেপ নিন।’
গ্রামীন জীবনে এখনও প্রচলিত প্রবাদ আছেÑ ‘আসল ঘরে চাল নেই ঢেঁকি ঘরে চান্দোয়া’। জাতির মেরুদন্ড শিক্ষা। সেই শিক্ষার ভিত্তি হচ্ছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেই সব বিদ্যালয়ে স্থবির হয়ে পড়া শিক্ষাকে গতিশীল করে সুশিক্ষাদানের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী। শিক্ষাকে গণমূখী, বাস্তব কর্মমূখী করাসহ শিশু শিক্ষার্থীদের নিজেদের ভাল লাগাকে প্রধান্য দিয়ে সুশিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। সেই সাথে সাংবিধানিকভাবে শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে বৈষম্যের অবসান করে বৈসম্যবিরোধী আন্দোলনে আত্মবলিদানকারী শহীদ এবং আহত বীরদের আত্মত্যাগকে স্বার্থক করা নৈতিক দায়িত্ব বলে আত্মবলিদানের শ্রদ্ধাশীল গুণীজনরা মনে করেন।
এবার দেখা যাক, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে সংবাদমাধ্যম বলছে, দেশের বিদ্যমান ৬৫ (পয়ষট্টি) হাজারের বেশী সংখ্যক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪ (চার) লাখ ২২ হাজারের বেশী শিক্ষক রয়েছেন। তান্মধ্যে প্রধান শিক্ষকের পদ রয়েছে ৬৫ (পয়ষট্টি) হাজার ৪৫৭টি। এর মধ্যে ৩৪ হাজার ১০৬টি পদ শূন্য রয়েছে। এ সব বিদ্যালয়ের ১৩ হাজার ৬৭৫ জন সহকারী শিক্ষক প্রধান শিক্ষকের চলতি দায়িত্ব পালন করছেন। এদিকে ৩ (তিন) লাখ ৫৫ হাজার ৬৫৩টি সহকারী শিক্ষক পদের মধ্যে ২৪ হাজার ৫৩৬টি পদ শূন্য রয়েছে। শিক্ষানুরাগী মানুষ সহজেই বুঝেছেন, সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকটের ফলে শিক্ষার ভিত্তি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের অবস্থা তথৈবচঃ।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে গণমাধ্যম বলছেÑঅন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আরও প্রায় ২৩ হাজার নতুন পদ সৃষ্টি করছে। তান্মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৯ হাজার ৫৭২ টি সহকারী শিক্ষকদের পদোন্নতির মাধ্য যে পদ পূরণ বিবেচনায় নিয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদ অনুমোদন দিয়েছে। প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক পদ যখন শূন্য তখন নতুন পদ সৃষ্টি করে শূন্যপদ থাকা সহকারী শিক্ষকদের মধ্য থেকে পদোন্নতির চিন্তা কি ৭৩ হাজারের বেশী যে বিদ্যামান শূন্য পদে রয়েছে তা পূরণে ভূমিকা রাখবে? জনমনের প্রশ্নমুলক বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার।
পরিশেষে, শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের ক্ষুদ্রাংশ প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন যে, তাঁরা গরীব না হলেও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সন্তানদের পড়ান। ধন্যবাদ তাঁদের। তবে গরীব ও সীমিত আয়ের মানুষের মধ্যে উদাহরণ সংখ্যক না হলেও দু’চার জন অভিভাবক বড় স্বপ্ন নিয়ে অনেক কষ্ট করে ক্ষমতাবানদের সন্তানদের সাথে টাকা ব্যয়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ান; তাঁদের স্বপ্ন পূরণ হোক। এতদসঙ্গে বিশ্লেষণ না করেও উল্লেখ করা যায় যে, ক্ষমতাবান বলতে অর্থ-সম্পদশালী-বিত্তবান এবং সুবিধাদি ভোগের পাশাপাশি ভাল বেতনের ও ঘুষ বানিজ্যের সুযোগপ্রাপ্ত চাকুরিজীবিসহ সামর্থবান রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গকেই প্রতিবেদনে ক্ষমতাবান বলা হয়েছে। যাঁদের সন্তানরা নানা ইংরেজি নামের স্কুলসহ ব্যয়বহুল বিভিন্ন কিন্ডার গার্টেন স্কুলে পড়ান। ফলে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার দুরাবস্থা বিদ্যমান যা কাম্য নয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বহুগুণে গুণান্বিত লেখক-অধ্যাপক আহমেদ ছফা এক আলোচনায়- ‘শিক্ষার ভিত্তি প্রথামিক বিদ্যালয়’ প্রসঙ্গেই জনৈক উৎসাহী ব্যক্তি আহমেদ ছফার মন্তব্যের সূত্র ধরে, প্রসঙ্গত তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন আপনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হলে আপনি কি শিক্ষার মান ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টিতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় করতেন (?) তিনি হাস্যজ¦ল মুখে জবাব দিয়েছিলেন-না, আমি দেশের উন্নয়নকে প্রাধান্য দিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতাম এবং দ্বিতীয় ধাপে মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
আমরা প্রয়াত লেখক শ্রদ্ধাভাজন আহমদ ছফার মূল্যবান লেখা সমূহ থেকে শিক্ষা অর্জনের আহ্বান জানানোর সাথে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা ও শ্রদ্ধা জানিয়েই উপরোক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় সংখ্যা বৃদ্ধিসহ শিক্ষার মান বিকাশে বর্তমান সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ চাই। যা, বাস্তবায়নের ধারাবহিকতা ধরে শিক্ষাকে এগিয়ে নিবেন নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার। এ আশাবাদ ব্যক্ত করেই আহমেদ ছফার দ্বিতীয় ধাপের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দিকে যদি তাকিয়ে দেখি। তাহলে দেখি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতই নানা সমস্যা বিদ্যালয়ে হুবহু একই অবস্থা না হলেও শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে বৈষম্য বিদ্যমান। পক্ষান্তরে ক্ষমতাবানদের সন্তানদের অবাধ শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষা কেনা-বেচা প্রাধান্যের মাধ্যমিক স্তরের বিদ্যালয়গুলোসহ ইংরেজি মাধ্যম ও কিন্ডার গার্টেন প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর অনেক বিদ্যালয়েই দশম ও একাদশ বা স্কুল-কাম কলেজের মতই। তাই এক্ষনে মাধ্যমিক বিদ্যালয় নিয়ে আলোচনা (পরবর্তীতে আলোচিতব্য) নয়। আলোচনা ২০১৮ সালে পতিত স্বৈরাচার বাহবা কুড়াতে বা প্রশংসায় সদগদ হতে যে সকল কলেজ সরকারীকরণ করা হয়েছে সেই কলেজের শিক্ষাদানের অবস্থা জানা নিয়ে।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ নিজেদের সচেতনতাবোধ থেকে ও নিজেদের জ্ঞান বুদ্ধির আলোকে চারপাশে তাকিয়ে সরকারীকরণ কলেজ (মহাবিদ্যালয়) সমূহে যাঁদের সন্তান লেখাপড়া করছেন ও যাঁদের সন্তান ওইসব কলেজে পড়েন না তাঁরাও জানেন ও বোঝেন কেমন শিক্ষাদান হচ্ছে। যতটা হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হবে, তন্মধ্যে বেশিটা যে সকল বিভাগে যে দু’চারজন শিক্ষক আছেন সেই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিজস্ব প্রচেষ্টায় ও সচেতন অভিভাকদের তাগিদে। তার চেয়ে বেশি আশা করার সুযোগইবা কোথায়। ‘ঢাল নেই, তলোয়ার নেই-নিধিরাম সরদার’ প্রবাদের মতোই কলেজগুলো সরকারী করণ করা হয়েছে। আমরা জেনে আসছি ২০১৮ সালে দেশের উপজেলা পর্যায়ে ৩৩৩ (তিনশ তেত্রিশ) টি কলেজ সরকারিকরণ করা হয় বটে। তন্মধ্যে ২০২৪ সালে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়া ২০০ (দুইশত) টি সরকারিকরণ কলেজে অধ্যক্ষের পদই শুণ্য। ১০০টি কলেজে অধ্যক্ষের পদসহ উপাধ্যক্ষের পদও শুণ্য।
অথচ শিক্ষিত জাতি গঠনের প্রয়োজেন শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক এবং অভিভাবক তথা সকলের সার্বিক সুবিধা ও কল্যাণের কথা বিবেচনা করেইতো এত ঢাকঢোল পিটিয়ে, বিশাল অর্থ ব্যয়ে জাঁকজমক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কলেজগুলোকে সরকারীকরণ করা হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রেও শিক্ষানুরাগী অভিভাবকসহ জাতির দুর্ভাগ্য, কলেজগুলোতে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে আজও এক নাজুক পরিস্থিতি বিরাজমান। অর্থাৎ শিক্ষার নুন্যতম পরিবেশও নেই বলা যায়।
সবশেষে সরকারী হওয়া কলেজগুলোতে দীর্ঘদিন থেকে অধ্যক্ষ না থাকা এবং বিষয় ভিত্তিক শিক্ষক স্বপ্লতায় লেখাপড়ার ওপর এমন প্রভাব পড়েছে যে সবকিছু মিলে লাটে ওঠার উপক্রম। পাঠকরা সবাই হয়তো লাটে ওঠার সাথে একমত হবেন এইচএসসির বোর্ড পরীক্ষার ফলাফল থেকে। এসব সরকারী কলেজ ‘শিক্ষাবোর্ড নির্ধারিত’ পাশের হার স্পর্শ করতে পারছে না।
অপরদিকে, ২০১৮ সালে শিক্ষক নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা জারির পর থেকে শিক্ষক নিয়োগ বন্ধই শুধু নয়, সরকারিভাবেও শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। আলোচিত পরিস্থিতিতে ‘দৈনিক সমকালে’ প্রকাশিত অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক বিমল সরকার একটি লেখায় কলেজগুলোর বিদ্যমান বাস্তবতার বর্ণনা দিতে আক্ষেপ প্রকাশ করতে বলেছেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, দর্শন ও ইতিহাস বিষয় এবং আবিশ্যিক বাংলা ও ইংরেজি বিভাগসহ সব বিভগে (বিষয়ে) মাত্র একজন শিক্ষক দিয়েও খুড়িয়ে চলছে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাদান। তাঁর মতে, প্রতিষ্ঠানভেদে পাঁচ-সাতটি বিভাগ কিংবা তারও বেশী সংখ্যক বিষয়ে শিক্ষক পদ শূণ্য রয়েছে। তিনি, এমনও নজির আছে বলে উল্লেখ করে বলেছেন-এমন বিভাগ আছে যেখানে নিয়মিত একজন শিক্ষকও নেই। যাঁরা ছিলেন বা আছেন তাঁদের মধ্যে ৫৯ বছর পূর্ণ হওয়ায় তারা চাকুরি থেকে বিদায় নিয়েছেন বা নিচ্ছেন। তবে চলতি বছরের প্রথমার্ধে দফায় দফায় শিক্ষা ক্যাডারভুক্তদের মধ্য থেকে অধ্যক্ষ নিযোগ দেওয়ায় অধ্যক্ষ সমস্যার একটা সমাধান হলেও বিষয়ভিত্তিক শুণ্য পদগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না।
ফলে দিন যত যাচ্ছে শিক্ষার পরিস্থিতি তত সংকটাপন্ন হচ্ছে। অথচ সর্বজন স্বীকৃত যে, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। সেই শিক্ষাকে বৈষম্যমুক্ত সুশিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষিত জাতি গঠনে সরকারীকরণ কলেজগুলোতে শিক্ষাদান সুনিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগদানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস শিক্ষার সুষ্ঠ পরিবেশ নিশ্চিত করাসহ দেশের সকল পর্যায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৈষম্যমুক্ত সুশিক্ষা কাঠামো নিশ্চিত করবেন বলে গণপ্রহরীর আশাবাদ।

প্রধান সম্পাদক, গণপ্রহরী