গণপ্রহরী রিপোর্ট : চব্বিশের বিজয়ের পর জাতির সামনে একাত্তরের বিজয় দিবস। সাধারণ মানুষের কাছে দুটি দিবসই তাৎপর্যপূর্ণ। আগে দেখে ও জেনে আসছেন একাত্তরের বিজয় দিবস। এখন একটি লক্ষ্যেরই দুটি দিবস রক্তার্জিত। অর্থাৎ শহীদদের রক্ত, সম্ভ্রম হারানো মা-বোনের জীবন ও স্বজন হারানোদের চোখের পানি এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন বাজির মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত দিবস। আরেক ছাত্রজনতার গণঅভ্যূত্থানে রক্তার্জিত দিবস। জাতি শহীদদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আহত ও অংশগ্রহণকারীদের ত্যাগ স্মরণীয় অনুকরণীয় ও বরণীয়ও বটে। একজন মহান মনিষি বলেছেন, ‘কোন ত্যাগই বৃথা যায় না’।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর লাখ লাখ শহীদের এক নদী রক্তে এবং এ দেশের বীর জনগণের দামাল সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন-মরণ যুদ্ধে অর্জিত একাত্তরের বিজয় দিবস। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জিত হয়নি স্বাধীনতার তেপ্পান্ন বছরেও। একইভাবে গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসন ও শোষণের জাঁতাকলে চাপা পড়ে যায়। প্রতিষ্ঠিত হয় স্বৈরাচারের স্বৈরশাসন-ফ্যাসিজম। যেখান থেকে বাঁচতে আবারো ২০২৪ জুলাই-আগস্টে শত, হাজারো ছাত্রজনতার রক্তপথের গণঅভ্যূত্থানে অর্জিত হয় আরেকটি বিজয়। সেই বিজয় অর্জিত হয় ৫ আগস্ট স্বৈরাচারের পতনের মধ্য দিয়ে। সে কারণেই শিরোনামে দখল নিয়েছে চব্বিশের বিজয়ের পর জাতির সামনে একাত্তরের বিজয় দিবস।
‘চব্বিশের বিজয়ের পর জাতির সামনে একাত্তরের বিজয় দিবস’ শীর্ষক আলোচনার শুরুতে যে সকল শহীদের রক্তে আর লাশ মাটিতে মিশে আমাদের প্রিয় জন্মভূমির বুকে নাইট্রোজেনের জোগান বৃদ্ধি করে মাটিকে করেছে উর্বর। সেই সকল বীর শহীদদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। সমবেদনা জানাচ্ছি আহত এবং স্বজন হারানোদের প্রতি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কোন আন্দোলন সংগ্রামের শহীদদের আত্মত্যাগ স্বার্থক না হওয়ায় সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়নি। তবে অনস্বীকার্য যে, রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। সে পরিবর্তনে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যের শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। চব্বিশের আন্দোলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জনগণর হৃদয়ে যে আকঙ্খা বাসা বেঁধেছে। সেই বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থারও সম্ভাবনা ক্ষীন হয়ে আসছে। তাই চব্বিশের বিজয়ে এবং একাত্তরের বিজয়ে আত্মত্যাগকারী শহীদদের আত্মত্যাগকে স্বার্থক করতে, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে, ইতহাসের শিক্ষা নিতে হবে।
ইতিহাসের শিক্ষা বলছে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সেবাদাস নতুন ধরণের উপনিবেশিক কায়দায় শাসন-শোষণকারী পাকিস্তানের স্বৈরাশাসক গোষ্ঠির স্বৈরশাসন এবং তাদের দালাল সামন্ত-আমলা-মুৎসদ্দি-পুঁজিবাদী শ্রেনীর শোষণের হাত থেকে মুক্তির জন্য। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যের শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাম্য, ন্যায়বিচার, মৌলিক অধিকারসহ মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিশ্চিত করার জন্য গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হবে এবং লক্ষ্য অর্জনে পরিচালিত প্রক্রিয়ায় পর্যাক্রমে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, সে পথে শাসক শ্রেনী ব্যর্থ হলেও পর্যায়ক্রমে স্বৈরশাসক জাতির ঘাড়ে চেপে বসে। ইতিহাস এ পর্যায়ে জাতিকে নাড়া দেয়- তাঁর রায় সামনে এনে। ইতিহাসের রায় হচ্ছে-‘দেশ চায় স্বাধীনতা, জাতি চায় মুক্তি আর জনগণ চায় বিপ্লব’।
তবে হ্যাঁ, চব্বিশের বিজয় অর্জনে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্বাদানকারীরা স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে সক্ষম হলেও দ্বান্দ্বিক বিশ্লেষণ করে আন্দোলন পরবর্তীতে বা আন্দোলন ব্যর্থ হলে অথবা বিজয়ের পর কিভাবে দেশ পরিচালিত হবে, তা রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও অভিজ্ঞতার অভাবে করণীয় নির্ধারিত ছিল না। যদিও আন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরীতে বিএনপিসহ আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা ছিল গুরুত্ববহ। যা, বিজয়ের ইতিহাসের একটি অধ্যায় হওয়ার দাবি রাখে।
অপরদিকে, সেনাবাহিনীর উপর জনগণের আস্থা থাকলেও সে আস্থা রক্ষায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে বিলম্ব হয়েছে। এমনকি কতিপয় সেনাসদস্য, বিজিবি সদস্য ও র্যাব-পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পরেছিল। তবে তড়িৎ ছাত্র জনতার কাতারে মিশে আবারো জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছেন। তাঁদের বিশ্বাস, যে কোনো ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে বিজয়কে স্থায়ী করতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সদ সতর্ক থেকে যথাযথ ভূমিকা পালন করবেন।
আবারো শিরোনামের ‘চব্বিশের বিজয়ের পর জাতির সামনে একাত্তরের বিজয় দিবস’ যেন এ মুহুর্তে বলছে, একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করলেও শহীদদের রক্ত ও লাশ মিশে উর্বর হওয়া মাটিতে, উৎপাদিত ফসল খেয়ে বীর জনগণের জন্ম দেয়া নিরস্ত্র বীর সন্তানদের-‘একাত্তরের বিজয় এবং মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতার সাথে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। এবং চলমান অস্থিরতা ও ভারতের মদদে আওয়ামীলীগের সুবিদাভোগীদের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অপচেষ্টাসহ সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে হবে। এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে আন্দোলনকালের মতো ছাত্র জনতাকে পাশে নিয়ে রাজপথসহ দেশব্যাপী তৎপর থাকতে হবে। একাত্তরের বিজয় দিবসের মাস ডিসেম্বর থেকে মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত তৎপরতা মাঠে-ময়দানে অব্যাহত রাখতে হবে। এবং আলোচনা-সমালোচনা ও পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতা শোধরিয়ে সকল শ্রেনী পেশার মানুষ তথা ছাত্রজনতার আস্থা ও বিশ্বাসকে সুদৃঢ় করতে হবে।
পরিশেষে চব্বিশের বিজয় অর্জনে নেতৃত্বদানকারী এবং অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে দু’চারটি কথা জাতির সামনে গণপ্রহরীর আগের লেখার অংশবিশেষ পুনরায় তুলে ধরছি। যাতে দেশ ষড়যন্ত্রকারী ও অস্থিরতা সৃষ্টিাকারী চক্র হারানো স্বর্গ ফিরে পাওয়ার মোহে অন্ধ হয়ে ভুল না করে। কারণ, ৫ আগস্টের বিজয় অর্জন যে ছাত্র জনতা করেছে তা ধরে রাখতে সক্ষম, তা মনে করিয়ে দিতে হবে। এবার কথাগুলো তুলে ধরার পালা।
নতুন প্রজন্মের ছাত্ররা রক্ত দিয়েই ইতিহাসের একটি অধ্যায় রচনা করলো-‘তারাও পারে’। আর সেই পারার মধ্য দিয়ে ইতিহাসকে নতুন করে স্বাক্ষ্য রাখলো-‘শহীদের রক্তে ভেজা উর্বর মাটিতে উৎপাদিত ফসল খেয়ে’ এ দেশর বীর জনগণের জন্ম দেয়া সন্তানরা-‘বীরের রক্তে বীরের’ই জন্ম হয়েছে। তাদের পরিচয় বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে, তাঁরা জন্ম সূত্রেই ‘বীর সন্তান’। আর বীর সন্তানরা বীর সন্তানই’ তাদের একামত্র পরিচয়। শুধু কি তাই? না। একাত্তরের রক্তপথে তাদের জন্ম। যাঁরা প্রকৃত অর্থে একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা, তাঁরা জন্ম নিয়ে ছিলেন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণআন্দোলন-গণঅভ্যূত্থানের রক্তপথে এবং কিছু সংখ্যক অতীত আন্দোলন-সংগ্রাম ও দুর্ভিক্ষে মৃত্যুবরণকারী (ধর্মীয় দৃষ্টিকোনে তাঁরাও শহীদ) মানুষের লাশ মাটিতে উর্বর করা জমিতে উৎপাদিত ফসল খেয়ে জন্ম নেয়া। আর একাত্তরের রক্তপথে জন্ম নেয়া বীর সন্তানরাই চব্বিশের বিজয়ের সামনে থাকা বীর সন্তান।
তাইতো একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনে অবিচল, তাঁদের হেয় বা কটাক্ষ করা নয় অথবা সমালোচনাও নয়। বরং সম্মানের সাথে তাঁদের সামনে রাখা এবং সেভাবেই সম্মানজনক সম্বোধন করা বাঞ্চনীয়। কারণ যে বাংলাদেশে চব্বিশের ‘বিজয়’ সেই বাংলাদেশ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযুদ্ধেরই ফসল। একইভাবে একাত্তরের রক্তপথে জন্ম নেয়া বীর সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তৎসময়ে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে সফলতা অর্জনে ভূমিকা পালনকারী মুক্তিযোদ্ধা-জনতারই সন্তান। তাঁদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীরা মুক্তিযোদ্ধা-জনতার সন্তান হলেও চব্বিশের বিজয় অর্জনের মূলে যেহেতু বৈষম্যহীন সমাজ উপহার দেযার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে তাঁদের ব্যানার উচিয়ে। সেহেতু বৈষম্যহীন সমাজ (শোষণমুক্ত সমাজ ছাড়া বৈষম্যহীন সমাজ কল্পনাতীত) জাতিকে উপহার দিতে অনুপ্রাণিত করতে হবে আন্তরিকভাবে। তাদেরকেও মনে রাখতে হবে, ব্যানারে উল্লেখিত পরিচয়ই বৈষম্যহীন সমাজ উপহার দেয়ার ‘ঘোষণা’ থেকে পিছানোর পথ নেই।
চব্বিশের বিজয় অর্জনে দুই হাজারের বেশি এবং আহত এখন পর্যন্ত অগণিত (বলা যায়) তাঁদের কতভাগ কোন শ্রেনী ও পেশার তা লিপিবদ্ধ করলে বুঝতে কষ্ট হবে না যে, শোষিত-বঞ্চিত, গরীব-সর্বহারা, নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের সাধারণ মানুষই সংখ্যায় বেশি। তাঁদের বিশ্বাস-‘বৈষম্যহীন সমাজ’ হলে তাঁরা শাসন-শোষণ থেকে মুক্তি পাবেন। তবে বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে এগিয়ে চলার পথে ভুলত্রুটি হলে আত্মসমালোচনা-পর্যালোচনা ও আলোচনার মাধ্যমে শোধরাতে হবে। আন্দোলনকারী ছাত্র নেতৃত্বসহ অংশগ্রহণকরীরা শুধু একাত্তরের রক্তপথেই জন্ম নেয়নি। বিশ্ব ইতিহাসে অতীত ছাত্র আন্দোলনের উজ্জল দৃষ্টান্ত নতুন করে আবারো স্থাপন করেছে এবং যা বিশ্ব ইতিহাসে রক্ত দিয়ে লেখা একটি অধ্যায়। জাতীয় ঐক্য অটুট থাকুকÑ এ পর্যায়ে এটাই কাম্য।
