বিশেষ সম্পাদকীয়
‘চব্বিশের শিক্ষায় পঁচিশকে স্বার্থক করুন। বৈষম্যহীন সমাজের উচ্চতর রূপ শোষণমুক্ত সমাজের রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় জাতীয় ঐক্যকে সুদৃঢ় করুন’। এই আহ্বান-চব্বিশের রক্তার্জিত অবিস্মরণীয় গণঅভ্যূত্থানে আত্মবলিদানকারী বীর শহীদদের। আর আহত বীররা যেন বেঁচে আছেন, শহীদদের আহ্বানে সাড়া দেয়ার তাগিদ দিতে। তাই খ্রিষ্টীয় নতুন বছর ২০২৫ এর যাত্রা শুরুর উদিত সূর্য যে আশা জাগিয়েছে তার বাস্তব রূপ দিতে আন্তরিক হতে হবে সকলকে।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তার্জিত বাংলাদেশ মূল ‘লক্ষ্য’ থেকে সরে যাওয়ায়ই বিদায়ী বছর ২০২৪-এ হাজারো মানুষকে রক্ত দিতে হয়েছে, জীবন দিতে হয়েছে। যে আশা-আকাঙ্খা ও বিশ্বাস নিয়ে শাসিত- শোষিত-অধিকার হারা, আকাশ-পাতাল বৈষম্যের নিষ্ঠুর শিকার হওয়া মানুষ রাজপথে নেমে এসেছিলেন; তা বাস্তবায়নের অঙ্গিকার নিয়ে ঐক্যমত্য হোন। চব্বিশের শিক্ষায় পঁচিশকে স্বার্থক করুন, করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, স্বৈরশাসনের পতনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও চব্বিশ বিদায় নিয়েছে অর্থনৈতিক নানা সংকট রেখে। মুদ্রাস্ফীতির চাপে পিষ্ঠ হওয়া জনগণ আজও বাজার অস্থিতিশীলতায়। শীতকালীন সবজির বাজার একইভাবে সর্বক্ষেত্রে না কমলেও, কিছুটা কমেছে। তবে অর্থনীতিতে এক প্রকার স্থবিরতা বিরাজমান থাকায় উদ্বেগ কাটছেনা জনমনে। উপরন্ত বেকারত্ব চরম পর্যায়ে এবং দেশী-বিদেশী বিনিয়োগে ভাটা পড়েছে মর্মে প্রচার-প্রবাগণ্ডা থাকায় জনমনে চাঞ্চল্যতা নেই।
আমরা চারদিকে দেখছি এবং জীবন দিয়ে উপলদ্ধি করছি, চব্বিশ যেন প্রকৃতির শীতকে উপহার দিয়ে বিদায় নিয়েছে। পক্ষান্তরে প্রচণ্ড শীত ও শ্বৈতপ্রবাহ মাথায় নিয়ে জাতীয় জীবনে আগমন ঘটেছে পঁচিশের। আকাশ-পাতাল বৈষম্যের শিকার দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবি উৎপাদক জনগণ দেশব্যাপী হাড় কাঁপানো শীতে কাবু হয়ে পড়েছেন। ফলে জীবিকা নির্বাহে দারুণ কষ্টে রয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে সরকার এবং দাতা সংস্থা ও দানশীল ব্যক্তিরা জনগণের পাশে দাড়াবেন, শীতে আক্রান্ত মানুষকে রক্ষায়। একই সাথে প্রস্তুত থাকতে হবে পঁচিশের যে কোনো দুর্যোগ মোকবিলায়। সেই সাথে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি-অর্থনীতির চাকা ঘুরানোর বিষয়টির প্রতি আরও অগ্রাধিকার দিবেন এবং তা দিতে হবে।
বিশ্ব ব্যবস্থায় আধিপত্য বিস্তার ও বাজার দখলে বিশ্বব্যাপী বৃহৎ শক্তিধর সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র সমূহ দ্বন্দ্বে-যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ছে। ফলশ্রুতিতে ফিলিস্তিনের গাজায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট ইসরাইলী মানবতা বিরোধী বর্বর সেনাবহিনী নিরপরাধ অবুঝ শিশু-নারী হত্যাসহ বেপরোয়া গণহত্যা চালিয়েছে। এমনকি আন্তর্জাতিক স্বীকৃত সীমানা অতিক্রম করে ইসরাইলী বাহিনী লেবাননেও হামলা বিস্তৃতি ঘটিয়েছে। জাতিসংঘের বিধি-নিষেধকে উপেক্ষা করেই যেন ইসরাইলি বাহিনী ফিলিস্তিনে মানুষ হত্যা ও সম্পদ ধ্বংসে উদ্মাদ হয়ে উঠেছে।
অপরদিকে, আরেক বৃহৎ শক্তি রাশিয়া সাম্রাজ্যবাদ ইউক্রেন দখলের যুদ্ধ চালাচ্ছে টানা তিন বছর ধরে। চব্বিশ স্বাক্ষ্য দিচ্ছে-বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্র সমূহের আধিপত্য বিস্তার ও বাজার দখলের একগুয়েমীপনায় যুদ্ধ বন্ধ হয়নি ও হচ্ছে না। বরং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি যেন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ এগিয়ে নিচ্ছে। সেই সাথে সম্প্রসারণবাদী ভারতকে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে উগ্রহিন্দুত্ববাদী বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার বাংলাদেশসহ প্রতিবেশি দেশগুলোকে অনুগত রাষ্ট্রে পরিণত করার অপতৎপরতায় লিপ্ত।
এদিকে, সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ার মদদপুষ্ট সিরিয়ার আসাদ সরকার গণঅভ্যূত্থানের মুখে পালিয়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছে। একইভাবে বাংলাদেশে চব্বিশের অবিস্মরণীয় গণঅভ্যূত্থানের মুখে শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। পতিত সরকারের প্রধান শেখ হাসিনাই ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে বাংলাদেশকে ভারতের অনুগত রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। শেখ হাসিনাকে পুনর্বহাল করে অনুগত রাষ্ট্র হিসেবে ফিরে পেতে ভারত, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অপতৎপরতা তুঙ্গে তুলেছে।
কিন্তু মুলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ জীবন-মরণ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টি করায় ব্যর্থ হচ্ছে ভারত পদে পদে। তবে সরকারসহ সকল শক্তিকে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে হবে। সম্প্রীতি বিনষ্টকারি ‘কাঠপোকা’ ন্যায় ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুদৃঢ় রাখতে হবে, যা আছে।
এখানেই শেষ নয়। কারণ, এ মুহুর্ত পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদী প্রভূশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় বিশ্ব রাজনীতিতে নানা সম্ভাবনার হিসাব-নিকাশ চলছে। কেননা, অংকের হিসাব-নিকাশের চেয়ে রাজনীতির হিসাব-নিকাশ অনেক অনেক বেশি কঠিন ও জটিলও বটে। এমনিতেই বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে ও তার ফলশ্রুতির যুদ্ধে বিশ্ব সংকটে। সেদিক থেকে আমরাও সংকটে, আমাদের দেশও সংকটে ও জনগণতো মহাসংকটে। উপরন্ত জাতীয় জীবনে অনেক অভূতপূর্ব ঘটনার মধ্য দিয়ে চব্বিশের বিদায় ঘটেছে। যা মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনে জনগণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে যেমন বিরাট ভূমিকা রাখবে তেমনি স্বৈরশাসকদের জন্য শিক্ষনীয় হয়ে থাকবে। তাই বিশেষ সম্পাদকীয় কলামের শিরোনাম হয়েছে চব্বিশের শিক্ষা পঁচিশে স্বার্থক করুন।

অনস্বীকার্য যে, বিদায় বছরে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও আগের সংবিধানের ধারাবাহিকতায় ও আগের সুবধাভোগী জনবল প্রাধান্যে পরিচালিত থাকায় সাধারণভাবেই রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম চ্যালেঞ্জের মুখে। তাই আইনশৃঙ্খলার স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দেশের অভ্যন্তরীন ক্ষেত্রে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। যা আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জেসহ অভ্যন্তরীন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়ক হবে।
আমরা যদি মনে করি, পতিত স্বৈরাচারের বিগত দেড় দশকের স্বৈরশাসন ও লুটপাটই সবকিছুর অন্তরায়। তাহলে স্বৈরশাসকদের পতন ঘটানোর পর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা যেমন অপরিহার্য হয়ে ওঠে তেমনি দুর্বল হয়ে পড়া প্রতিষ্ঠান সমূহ সংস্কারও অপিরহার্য হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি আমাদেরকে বিশ্বখ্যাত সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিষ্ট’-এর বিশ্ব জরিপে বাংলাদেশ বর্ষসেরার তালিকাভুক্ত হওয়ায় যে নতুন নতুন আশা জাগিয়েছে, তা আমাদের ভাবনায় রাখতে হবে।
চব্বিশের শিক্ষায় পঁচিশকে স্বার্থক করুন। তা করতে যেহেতু আগের সংবিধান আগের ব্যবস্থা বিদ্যমান সেহেতু সাধারণ মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উত্তরণে অন্তর্বর্তী সরকাররের দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। প্রধান উপদেষ্টাও গণতান্ত্রিক উত্তরণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার সম্ভাব্য সময় উল্লেখ করেছেন। সে লক্ষ্যে নতুন বছর ২০২৫-এর রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের সাথে নিয়মিত আলোচনা অব্যাহত রেখে সম্ভাব্য সংষ্কারের মধ্য দিয়ে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে চলা। তাতে দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা পরিকল্পিত নীলনকশা বাস্তবায়নে ষড়যন্ত্রে সফল হতে পারবে না।
পরিশেষে চব্বিশের শিক্ষায় পঁচিশকে স্বার্থক করুন। চব্বিশের শহীদদের এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায় বলতে হয়- ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নি স্লানে শুচি হোক ধরা’। এতদসঙ্গে আমাদের জাতীয় জীবনে এগিয়ে চলার পথে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং চব্বিশের গণঅভ্যূত্থান থেকে অর্জিত শিক্ষাকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে হবে। যে চেতনা আমাদের অনুপ্রাণিত করবে, উজ্জীবিত করবে এবং সতর্ক করবে জনশক্তির উর্ধ্বে আর কোনো বিকল্প শক্তি নেই, তা মনে রাখতে। জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। ২০২৫ শুভ হোক সবার জীবনে। ০১.০১.২০২৫। –এসকে মজিদ মুকুল
