ফাতেমা মজিদ জুঁই : জ্ঞনার্জনের ক্ষেত্রে নিরক্ষর কুদ্দুস পথ প্রদর্শকই বটে (!) জ্ঞান অর্জনের জন্য চাই শিক্ষা। যে শিক্ষার ভিত্তি হচ্ছে বই। আর ‘বই পড়া’ শিক্ষার জন্য ভিত্তি হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়। মানুষের মধ্যে শ্রেণীগতভাবে গরীব-সর্বহারা, নিম্ন-আয়ের কর্মজীবি-শ্রমজীবি, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যা অধিক সংখ্যক। তাদের সন্তাদের শিক্ষার ভিত্তি সরকারি প্রথমিক (এমপিওভুক্ত হওয়ার আবেদন পেশকারীসহ) বিদ্যালয়। সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা ও সংকট নিয়ে এই প্রতিবেদনে আলোচ্য নয়। আলোচ্য হচ্ছে- বই কেনা ও অপরকে দিয়ে পড়িয়ে শোনা যার নেশা, সেই নিরক্ষর কুদ্দুস পথ প্রদর্শক হতে পারে কি-না, সে নিয়ে পাঠকের সাথে মতবিনিময় করা।
যশোর জেলা শহরের পালবাড়ি রায়পাড়া এলাকায় মাত্র ১৩ শত জমির উপর নিরক্ষর আব্দুল কুদ্দুস (৭৩)-এর বাড়ি। সেই বাড়িতে আব্দুল কুদ্দুস তার স্ত্রী-পুত্র, পুত্রবধু ও নাতি- নাতনি নিয়ে বসবাস করেন। জ্ঞান পিপাসু আবদ্দুল কুদ্দস নিরক্ষর হওয়ায় সাহিত্য পড়তে বা গান গাইতে পারেন না। কিন্তু জ্ঞান অর্জন ও জানার আগ্রহই তাকে পিছপা হতে দেয়নি। যশোর থেকে সাংবাদিক মনিরুল ইসলাম বাড়িতে গিয়ে এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে প্রথম আলোত লিখেছেন,‘সাহিত্য পড়তে বা গান গাইতে না পারলেও আবদুল কুদ্দসুস সাহিত্য ও ভাবসংগীতের অনুরাগী। তাঁর সংগ্রহে রয়েছে বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকের হাজার খানেক বই। পুত্রবধুকে পাশে বসিয়ে বই পড়িয়ে সাহিত্যির নির্জাস উপলব্ধি করেন এবং সাহিত্যের রস আস্বাদন করেন।
আরও পড়ুন- শুরুতে গুলিবিদ্ধ ফয়েজ আহমেদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা
ভাবতে অবাক হতে হয়- ‘সাহিত্য আর বাউলগানের প্রতি অতি আগ্রহী আবদুল কুদ্দুসের পুত্রবধূ সাবিহা খাতুন গর্ব করে জানিয়েছেন-সময় পেলেই যেন তাঁর গর্বিত শশুর তাকে ডেকে পাশে বসিয়ে, সাহিত্যের বই পড়তে বলেন। আর আমি বই পড়তে শুরু করলে শ্রদ্ধেয় শশুর তার পাশে বসে আগ্রহ নিয়ে শুনতে থাকেন। যেন সব শব্দ ও বাক্যগুলো তিনি গিলে খাচ্ছেন। তার ‘আগ্রহ ও মনোযোগ’ বিদ্যালয়ের গন্ডি পর্যন্ত পড়াশোনা করা পুত্রবধু সাবিহাও উপভোগ করেন। পুত্রবধুও গর্বচিত্তে বলেন, সাহিত্য ও বাউলগানের প্রতি বেশী আগ্রহী তার শশুরের। মন ‘শিশুর মতো’। তিনি অন্যদের চেয়ে একেবারেই আলাদা। তার স্বামীও বই পড়তে উৎসাহ দেন উল্লেখ করে বলেছন, ‘যতই পড়বে ততই শিখবে’। গত ১১ জুলাইয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রতিবেদক মনিরুল ইসলাম তাঁর লেখায়ও যেন প্রকাশ করেছেন-তিনিও আশ্চর্য হয়েছেন যে, প্রতিবেদনের আলোচ্য ব্যক্তিত্ব শহরের পালবাড়ি রায়পাড়ার নিরক্ষর আব্দুল কুদ্দুসের ঘরে গানে তাল লয় সুর তোলার জন্য দোতারা, একতারা ও মন্দিরা রয়েছে। তাঁর দাদাবাড়ি ছিল বাগেরহাটের চিতলমারীতে। দারিদ্রতার কষাঘাতে তার বাবা আনিসুর রহমান অভাব মোকাবিলায় পরিবার নিয়ে যশোর চলে আসেন। এবং তিনি সংসার পরিচালনার জন্য রিক্সা চালাতেন। যে আয় হতো তা দিয়ে সংসার চালানোই ছিল কষ্টকর। লেখাপড়া শিখানোর মতো কেউ ছিলেন না। তাই দাদার কাছে কবি সাহিত্যিকের গল্প শোনা আজকের আলোচনার মধ্যমণি আব্দুল কুদ্দুস বুট বিক্রি শুরু করেন। আজও বাড়ীতে ভাজা বুট, বাদাম ও চিড়া নিয়ে বাই সাইকেলে যাতায়াত করে দোকানে দোকানে বিক্রি করে চলছেন।
জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে নিরক্ষর কুদ্দুস পথ প্রদর্শকই বটে। তার এই পথ প্রদর্শক হওয়ার ক্ষেত্রে বাউল গান ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে তার দাদার যে আগ্রহ দেখেছেন, সেটাই তার অনুপ্রেরনা জুগিয়েছে। এছাড়া কোন বিষয়ে কারও কাছে কিছু জানতে চাইলে একেকজন একেক রকম উত্তর দিতেন। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন-বই কেনার। আয়ের মাধ্যমতো-ভাজা চিড়া, বুট ও বাদাম বিক্রি করা। তা থেকে যে সামান্য আয় হতো তা দিয়ে সংসার চালিয়ে কিছু টাকা প্রতি মাসে বাঁচিয়ে তা দিয়ে আশির দশকে বই কেনা শুরু করেন। তাঁর কেনা প্রথম বই ‘বানী চিরন্তনী’। সেই যে শুরু; কিনতে কিনতে হাজার খানেক বই তাঁর সংগ্রহে। তন্মধ্যে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বেগম রোকেয়া সাখত্তয়াত হোসেন, কবি জসীম উদ্দিন, শরৎচন্দ্র চট্টোপধ্যায়, ড.লুৎফর রহমান সহ বিভিন্ন কবি-সাহিত্যেকের লেখা মূল্যবান বই অন্যতম।
আরও পড়ুন- সুকান্ত : কবি ও মানুষ
প্রসঙ্গত, তিনি জানিয়েছেন, যদিও বেশী মানুষের সাথে মেশেন না, তবে তিনি মনে করেন-‘সাহিত্য ও ভাব সংগীতের চর্চা’ তাঁকে নানা খারাপ বাসনা থেকে দুরে রেখেছে; মূলত: বাউল সাধকেরাই তাঁর সঙ্গীসাথী ছিলেন। কুষ্টিয়ার প্রখ্যাত বাউল সধিক করিম শাহ ছিলেন তার ‘গুরু’। তিনি গুনে গুনে তাঁর সাথে ৫৬ বার সাক্ষাৎ করেছেন গুরুর সান্নিধ্য লাভ করেছেন। পাঠকবৃন্দের সকলে না হলেও অনেকেই একমত হবেন যে, ‘নিরক্ষর জ্ঞান পিপাসু আবদুল কুদ্দুস যত সাধক-বাউলের সাথেই মেশেন না কেন-তিনি অন্যান্য সাধক বাউলের চেয়ে কম কিসে? আমরা মনে করি- তিনিও ‘সাধক’ সাহিত্যে ও বাউল গানের। তাইতো তিনি মাঝে মধ্যেই ভাবসংগীতের আসর বসাতেন তার সাধনের ঘরে। শুধু কি তাই? না। একদিনের জন্যও যাঁর স্কুলে যাওয়া হয়নি। তিনি নিজ চেষ্টায় অক্ষর আয়ত্ব করেছেন। তার সাহায়্যে গড়গড়িয়ে পড়তে না পারলেও, ধীরে ধীরে পড়তে পারেন। লেখকদের ছবি দেখে কার লেখা বই তা বুঝে বই কিনতেন এবং যেদিন যে লেখকের বইয়ের লেখা মন চাইত, সেই বই পুত্রবধু সাবিহা খাতুনকে ডেকে পাশে বসিয়ে পড়িয়ে শুনতেন। যা তার প্রবল মেধার স্বাক্ষ্য বহন করে-এটা বলা যায়। পরিবারের সদস্যরাও সময়ে সময়ে বই পড়ে শোনানো পুত্রবধুকে বই পড়ে শোনানোর জন্য তাগিদও দিবেন।
জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে নিরক্ষর কুদ্দুস পথ প্রদর্শকই বটে- ‘শীর্ষক আজকের এ প্রতিবেদনে সাহিত্য ও বাউলগানের আগ্রহী ব্যক্তিত্ব-সংগীত বা ভাবসংগীতের সংগ্রাকও। তিনি এক্ষেত্রে নিজের ভূমিকা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘শিক্ষনীয় ও অনুকরনীয়’ মূল্যবান উক্তি করেছেন। তিনি সাধক-গুরুজনদের গুড়ের ‘দানা’ উল্লেখ করে বলেছেন- ঠিলেয় (ঠিলা/পাত্র) দানা বাঁচিয়ে রাখার জন্য যেমন ‘ঝোল’ রাখা হয়, তিনিও সেই ঝোল স্বরূপ। নিজে ‘দানা’ হতে না পারলেও ‘দানা’ বাঁচিয়ে রাখতেই ‘ঝোল’ হিসেবে চেষ্টা করে যাচ্ছি।’ সাহিত্যের পাশাপাশি আধ্যাত্নিক গানের প্রতি ভাব প্রকাশ ঘটাতেই তাঁর ঘরে প্রায় ১০ (দশ) হাজার ভাবসংগীতের রেকর্ডসহ আড়াই হাজার অডিও রেকর্ড তাঁর ঘরে সংরক্ষিত। শুধু সংরক্ষণে সীমাবদ্ধ নয়, সংরক্ষণে রয়েছে ১৪ টি ক্যাসেট প্লেয়ারও। যার সাহায্যে তিনি প্রতি রাতে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েন। মাঝেমধ্যে তঁর সাধন ঘরে গানের কথা ও ভাব নিয়ে আলোচনা বৈঠকও হয়। এসবও তাঁর সাধনা।
পরিশেষে উপরোক্ত আলোচনার সারসংক্ষেপে আবারো বলতে হয়- ‘জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে নিরক্ষর কুদ্দুস পথ প্রদর্শকও বটে।
শেষ করার আগে পাঠকদের জানাতে চেষ্টা করি-তার ঘরের পরিবেশ নিয়ে। এত বই ও এত ক্যাসেট কিভাবে সংরক্ষিত। স্ত্রী-সন্তানরা পৃথক ঘরে থাকেন। কাচা মেঝে ঘরের এক পাশে বই রাখার দুটো আলমারি। মাঝে একটি ব্রেঞ্চ। আর সার্বক্ষণিক মশারি টানানো চৌকি বিশিষ্ট খাটটিতে তাঁর মাথার বালিশের দু’পাশের এক পাশে দুই কাটুন ভর্তি অসংখ্য ক্যাস্টেসহ দুটি ক্যাসেট প্লেয়ার ও কোলবালিশের (পাশবালিশ) মতো পাশে রাখা একটি দোতারা। বৃষ্টিতে যাতে না ভিজে যায়, সেজন্য পলিথিনের মলাটে বাইগুলো মুড়িয়ে রাখা। ইতিটানার মূহুর্তে বলতেই পারি-‘জ্ঞান অর্জনে বই পড়ার বিকল্প নেই এবং শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড।’ যে ‘বই কেনা নিরক্ষর আব্দুল কুদ্দুসের নেশা’
আরও পড়ুন- প্রকৃতি বিনাশে কি শৈল্পিক বাবুই হারাবে (?)
