Thu. Jul 10th, 2025
ঝাড়ুদার থেকে লেখিকাঝাড়ুদার থেকে লেখিকা

গণপ্রহরী ডেস্ক : ঝাঁড়ুদার থেকে লেখিকা।  বিশেষত নারী সমাজ ঐক্যবদ্ধ হলে পারেন সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে। এ কথাই প্রমাণ করেছেন এক বাঙালি কন্যা বেবী তাঁর জীবনের এক চিলতে কাহিনী ‘আলো আঁধারি’ বইয়ে। ঝাঁড়ুদার থেকে হয়ে উঠেছেন লেখিকা। অনুপ্রেরণাদায়ক ও শিক্ষণীয় এক চিলতে কাহিনীতে- বদলে যেতে পারে জীবন ও বাল্যবিবাহসহ নানা ব্যধিগ্রস্থ সমাজ।

বিয়ের পরে স্বামীর অত্যাচারে কার্যত বাধ্য হয়ে দিল্লিতে এসে বিভিন্ন বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতনে। শেষ পর্যন্ত কাজ পেলেন মুন্সী প্রেমচন্দের নাতি অধ্যাপক প্রবোধ কুমারের বাড়িতে। মেয়েটি মাঝে মাঝেই তাক থেকে পেড়ে আনতো বই। কিছুক্ষণ বইয়ের পাতার ওপর চোখ বুলিয়ে আবার রেখে দিতো যথাস্থানে। এই ঘটনা চোখ এড়ায়নি গৃহকর্তার। প্রবোধ কুমার তাকে একটা ডায়েরি আর পেন দিয়ে গিয়েছিলেন দক্ষিণ ভারত বেড়াতে যাবার সময়, বলেছিলেন লিখতে। মেয়ে তো হতবাক….কী নিয়ে লিখবেন তিনি! সেই মেয়ের বই বেস্ট সেলার হয়েছে, ‘‘আলো আাঁধারি’। অনুবাদ হয়েছে ইংরেজি ভাষায়।

ঝাঁড়ুদার থেকে লেখিকা বেবী এই বাঙালি কন্যার জন্ম ১৯৭৩-এ কাশ্মীর উপত্যকায়। কিন্তু তাদের দু বোনকে নিয়ে তার মদ্যপ সেনাকর্মী বাবার সাথে মা থাকতে পারেননি তার বাবার নিত্য অত্যাচারে। তাই তার চার বছর বয়সে তাদর দুই বোনকে নিয়ে মুর্শিদাবাদে মামার বাড়ি। মা সেখানে আবারো বিয়ে করার পর সৎ বাবার সংসারে বড় হতে থাকে। সেখানেও ‘বিধি বাম’; আচমকাই তার মেয়ে বেলা শেষ হয়ে যায়, যখন ক্লাস সিক্সে পড়ে।

একটা বাচ্চা মেয়ে যখন ফ্রক পরে খেলাধুলা করার কথা, তখন তাকে বসিয়ে দেওয়া হয় বিয়ের পিঁড়িতে। শেষ হয়ে যায় তার ‘শৈশব’, খেলার মাঝখান থেকে তাকে উঠিয়ে এনে মণ্ডপে একটা লোকের পাশে বসিয়ে দেওয়া হয়। কিছুতেই বুঝতে পারছিল না মেয়েটা, ভেবেছিল বোধ হয় কোনো পুজো হচ্ছে। তারপর তাকে বলা হল যে ওই লোকটার সঙ্গে চলে যেতে হবে। তখন মেয়েটার মাত্র ১২ বছর বয়স, স্বামীর ২৬।

বিয়ের প্রথম রাত থেকেই শুরু হয় অত্যাচার। পতি দেবতাটির ধারণা বউয়ের তো দুটোই কাজ, সন্তান ধারণ আর রান্না করা। কুড়ি বছর বয়সের মধ্যে মেয়েটি তিন সন্তানের জন্ম দিলো। তখনই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সন্তানদের জীবন তার জীবনের মত হবে না। ১৯৯৯ সালে, ২৫ বছর বয়সী তরুণী মা তার তিন সন্তানকে নিয়ে দিল্লিগামী একটি ট্রেনে উঠে বসেন।

দিল্লিতে এসে সে বিভিন্ন বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতে শুরু করলো। একে অল্প বয়স তার ওপরে কোন গার্জেন নেই, কাজের জায়গায় থেকেই নানা কুপ্রস্তাব আসতে লাগলো। নানা বাড়ি ঘুরে শেষ অব্দি কাজ পেলো প্রবোধ কুমারের বাড়িতে। অধ্যাপক কুমার ছিলেন মুন্সী প্রেমচন্দের নাতি।

বইয়ের তাক ঝাড়পোছ করতে গিয়ে মেয়েটি মাঝেই মাঝেই তাক থেকে পেড়ে আনতো বই। কিছুক্ষণ বইয়ের পাতার ওপর চোখ বুলিয়ে আবার রেখে দিতো যথাস্থানে। এই ঘটনা চোখ এড়ায়নি গৃহকর্তার যাকে তে তাতুস বলে ডাকতো। শব্দটির অর্থ বাবা, তিনিই তাকে এ নামে ডাকতে বলেছিলেন। একদিন তিনি বেবীর হাতে তুলে দেন তসলিমার লেখা আমার মেয়েবেলা। “বইটা পড়ে আমার খুব ভালো লেগেছিল। বলছিলো কাজের মেয়েটা-মনে হয়েছিল যেন এখানে লেখা আছে আমারই কথা।

এর কিছুদিন পর, দক্ষিণ ভারত ভ্রমণে যাওয়ার আগে, নিজের ড্রয়ার থেকে প্রবোধ কুমার তাকে একটা ডায়েরি আর পেন দিয়ে যান। বলেন লিখতে। মেয়েতো হতবাক….. কী নিয়ে লিখবেন তিনি!

ঝাঁড়ুদার থেকে লেখিকা বেবী লিখলেন তার হারানো শৈশবের কথা, লিখলেন তাঁর প্রথম সঙ্গমের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা, লিখলেন তেরো বছর বয়সের প্রসব যন্ত্রণার কথা, লিখলেন বছরের পর বছর ধরে নির্যাতনের ফলে শরীরে ফুটে ওঠা ক্ষতের কথা। লিখতে লিখতে ফিরে এল (বোনের) স্বামীর বোনের গলা টিপে ধরার অবদমিত স্মৃতি।

প্রায় কুড়ি বছর পর লিখছিলেন, প্রথম দিকে বানান, ব্যাকরণ নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছিল। কিন্তু একটু একটু করে পুরোনো অভ্যাস মনে পড়ে গেলো। আরো লিখতে থাকলেন। পরে বলছেন, ভালো লাগতো ততই। অনেক দিনের কোনো ভার যেন আমার বুকের ওপর থেকে সরে যাচ্ছে-এমন মনে হতো। একশো পাতা লেখা হওয়ার পর প্রবোধ কুমার ফিরে এসে দেখেন। ‘আলো আঁধারি’নামের বইটাই বেবী হালদারের প্রথম বই।  প্রথম বার পড়ে কেঁদে ফেলেছিলেন প্রবোধ। যে সমস্ত সাহিত্য-অনুরাগীদের লেখাটি দেখিয়েছিলেন তিনি, তাঁরা অনেকে অ্যান ফ্রাঙ্কের ডায়েরির সঙ্গে তুলনা করেছিলেন লেখাটির।

বহু প্রকাশক নাকচ করে দেওয়ার পর, শেষ অব্দি কলকাতার একটা ছোট প্রকাশনী- রেশনি পাবলিশার্স- বইটি ছাপাতে রাজি হয়।

“একদিন এক বই দেখিয়ে তাতুস আমাকে বললেন, ‘এটা তোমার বই। তুমি এটা লিখেছ’। ছাপা বই আমার সামনে হাজির! আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না!

ঝাড়ুদার থেকে পরিচারিকা, পাশের বাড়ির অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা থেকে আধুনিকা কলেজ পড়ুয়া- বেবীর কাহিনী নাড়া দিয়েছিল সকলকেই। বইটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ঊর্বশী বুটালিয়া। ২০০৬ সালে বইটি বেস্ট সেরার তালিকায় ছিল। একুশটি আঞ্চলিক এবং তেরটি বিদেশি ভাষায় অনুদিত হয়েছে বইটি।

আরো দুইটি বই লিখেছেন ঝাঁড়ুদার থেকে লেখিকা বেবী। লেখা তাঁকে দিয়েছে আত্মপরিচয়, যা আগে ছিলই না।

অর্থনৈতিক ভাবে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মত অবস্থায় পৌঁছে বেবী তাঁর তিন সন্তানকে (সুবোধ, তাপস ও পিয়া) নিয়ে কলকাতায় থাকতে আরম্ভ করেন।

এখন আমি বিশ্বাস করি, মানুষ সব পারে। আগে আমি পরিচারিকা ছিলাম। এখন আমি লেখিকা। আমি সবাইকে এটাই বলি যে, শুরু যে কোনো সময়েই করা যায়।

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *