Mon. Sep 1st, 2025
ডপলার রাডারে আবহাওয়ার তথ্য জানার দ্বার খুলল উত্তরেডপলার রাডার

স্বপন চৌধুরী : ডপলার রাডারে আবহাওয়ার তথ্য জানার দ্বার খুলল উত্তরে। প্রধান কার্যালয়ের তথ্যের ভিত্তিতে অনুমাননির্ভর পূর্বাভাস দিত রংপুর আবহাওয়া অফিস। সেই তথ্যও যথাসময়ে পাওয়া যেত না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে এই অঞ্চলে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, তীব্র তাপদাহ, অসময়ে কালবৈশাখী, শিলাবৃষ্টিসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়। ফলে প্রতিবছর কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কৃষিনির্ভর স্থানীয় অর্থনীতিও পড়ে মহাসংকটে। সমস্যা সমাধানে দীর্ঘ এক যুগ ধরে বিকল রাডার নিয়ে চলা রংপুর আবহাওয়া কার্যালয়ে স্থাপন করা হয়েছে নতুন ডপলার রাডার। এর ফলে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে খুলেছে আবহাওয়ার তথ্য জানার নতুন দ্বার। স্বস্তি ফিরেছে আবহাওয়া দপ্তরেও। এই রাডার স্থাপনের কাজ শেষ হলে গত ১১ মে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।

উদ্বোধন শেষে বাংলাদেশ আবহাওয়া বিভাগের পরিচালক মোমেনুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, আগে বজ্রপাত, বৃষ্টিপাতসহ আবহাওয়ার বিষয়ে অনুমাননির্ভর তথ্য প্রদান করা হতো। কিন্তু এই ডপলার রাডার স্থাপনের মাধ্যমে এখন সঠিক তথ্য প্রদান করা সম্ভব। এমনকি ৪০০ থেকে ৪৫০ কিলোমিটার রেঞ্জের মধ্যে বজ্রপাত, বৃষ্টিপাত, শীতকালের কুয়াশার ঘনত্ব ও ভুমিকম্পনের বিষয়ে আগাম তথ্য পাওয়া যাবে। নতুনভাবে স্থাপিত ডপলার রাডার কৃষিনির্ভর উত্তরাঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। নতুন এই রাডার যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কয়েক ঘণ্টা আগে তথ্য দিতে পারবে। এতে আগাম প্রস্তুতি গ্রহণের সুযোগ থাকায় দুর্যোগে কমবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। জাপানের সিমিজু করপোরেশনের তত্বাবধানে নির্মিত এ রাডার স্টেশনের সরঞ্জামাদি সরবরাহ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মারুবিনি করপোরেশন জানিয়ে তিনি জাপান সরকারের কাছে কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন। এসময় আন্তর্জাতিক আবহাওয়া পরামর্শদাতা ইয়োশিহিসা উচিদা, বাংলাদেশ আবহাওয়া বিভাগের উপ-পরিচালক আহমেদ আরিফ রশিদসহ অন্যান্য আবহাওয়াবিদগণ উপস্থিত ছিলেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রংপুর নগরীর কলেজ রোডস্থ মাস্টারপাড়া এলাকায় ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের অধীনে আবহাওয়া ও ভূকম্পন পর্যবেক্ষণাগার স্থাপন করা হয়। জাপান সরকারের অর্থায়নে ১৯৯৯ সালে ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এখানে রাডার স্থাপন করা হয়। রাডারটির আয়ুস্কাল ছিল ১০ বছর। তবে ২০০৭ সালের দিকেই ত্রুটি ধরা পড়ে। স্থানীয় প্রকৌশলীদের চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত ২০১২ সাল পর্যন্ত রাডারটি সক্রিয় রাখা সম্ভব হয়। জাপানের অনুদানে প্রায় ১২০ কোটি টাকায় রাডারটি প্রতিস্থাপনের কথা ছিল। তবে ২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর রংপুরে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি হত্যাকান্ডের পর দেশটির প্রকৌশলীরা আর রংপুরে আসেননি। সেই থেকে ঢাকায় প্রধান কার্যালয়ের তথ্য সমন্বয় করে এখানে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়। মূলত ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য  কোনো অগ্রগতি হয়নি। ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে রাডার স্থাপনের প্রকল্পে গতি আসে। আনুষ্ঠানিকভাবে রাডার স্থাপনের কাজ শুরু হয় ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ থেকে। জাপান সরকারের অনুদানে প্রায় ১২০ কোটি টাকা ব্যয়ে এটি নির্মাণ করার কথা থাকলেও পরবর্তীতে প্রকল্প ব্যয় ১৫০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। যার  বেশি অংশই দিয়েছে জাপানের দাতাসংস্থা জাইকা।

আবহাওয়াবিদদের তথ্য অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উত্তরাঞ্চলের প্রকৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। জীববৈচিত্রও হুমকির মুখে পড়েছে। শীতকালে প্রচণ্ড শীত এবং শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যায় এই অঞ্চলে। গ্রীষ্মকালে ঝড়, টর্নেডো, অবিরাম বর্ষণ, বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকে। বলা চলে বছরের প্রায় ১২ মাসই উত্তরাঞ্চলের মানুষ নানা প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে চলছে। এ অঞ্চলের আবহাওয়া অফিসগুলোর মধ্যে একমাত্র রংপুরেই ছিল রাডার এবং ভূমিকম্প পরিমাপক যন্ত্র। রাডারটি নষ্ট হওয়ায় আবহাওয়ার অনেক তথ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল এই অঞ্চলের মানুষ। তবে বর্তমানে নতুন রাডারটি স্থাপন হওয়ায় রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার মানুষ সঠিক সময়ে আবহাওয়ার সঠিক তথ্য পাবে। নতুন রাডার স্থাপনের দায়িত্বে থাকা সিমিজু করপোরেশনের কনসালটেন্টরা জানানা, এই রাডারের মাধ্যমে রংপুর আবহাওয়াকেন্দ্র থেকে চারদিকে সাড়ে ৪০০ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়, মেঘের গতিবিধি, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, বজ্রপাতসহ আবহাওয়ার আগাম নানা তথ্য দেওয়া সম্ভব হবে। দুর্যোগের বেশ কয়েক ঘণ্টা আগে তথ্য পাওয়ায় সংশ্লিষ্টদের সঠিকভাবে পূর্বাভাস দেওয়া যাবে। কালবৈশাখী মেঘের অস্তিত্ব, টর্নেডোর মেঘ, বজ্রপাতের ধরণ বলে দিতে পারবে এই রাডার।

এ বিষয়ে রংপুরের আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নতুন স্থাপিত ডপলার রাডারের মেয়াদকাল ১৫ বছর। আশা করছি, নতুন এই রাডারটি উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতি কৃষির সঙ্গে জড়িত। প্রতি বছর খরা, বন্যা, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে আমাদের কোটি কোটি টাকার ফসলহানি হয়। বজ্রপাতের কারণে দিন দিন মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস না থাকায় মৌসুমি রোগব্যাধিও বাড়ছে। তাই এখানে ডপলার রাডার স্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি ছিল। বিশেষ করে রেডজোনে অবস্থিত রংপুরে ভূমিকম্প ও বড় ধরনের বন্যার তথ্য দেওয়া যাবে। আগাম বৃষ্টিপাতের তথ্য দেওয়ার মাধ্যমে কৃষকদের ফসলের ক্ষতি থেকে রক্ষা করা যাবে। সেই সঙ্গে রংপুরের আবহাওয়ার অবস্থা ও পরিবর্তনজনিত কারণগুলো গবেষণা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ মিলবে বলেও জানান তিনি।

আরও পড়ুন- পানি সংকট : দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্পে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *