Tue. Aug 19th, 2025
ধান-চালে উদ্বৃত্ত রংপুর অঞ্চলে চালের দামে নাভিশ্বাস

স্বপন চৌধুরী : ধান-চালে উদ্বৃত্ত রংপুর অঞ্চলে চালের দামে নাভিশ্বাস। ধানের এলাকা রংপুর অঞ্চলে ফের চালের দাম বেড়েছে। মান ও প্রকারভেদে পণ্যটির দাম বেড়েছে প্রতি বস্তায় (৫০ কেজি) ২০০ থেকে ৫০০ টাকা। খুচরায় কেজিতে বেড়েছে ৫ থেকে ৭ টাকা। এতে মহাবিপাকে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষজন। মাসখানেক আগে বোরো ধানের কাটামাড়াই শেষ হয়েছে। বর্তমানে কৃষকের মাঠে ধান নেই, হাটেও মিলছেনা। ধান কিনে মজুদের পাহাড় গড়ছে আটোরাইস মিল মালিক এবং বড় বড় ব্যবসায়ীরা। এছাড়া বেশি দামের আশায় অনেক বড় কৃষক ধান বিক্রি না করে গোলায় তুলে রেখেছেন। ফলে চালের দামে লাগাম টানা যাচ্ছেনা। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাল আমদানির এলসি বন্ধ, অটোরাইস মিল ও বড় বড় ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট মজুদ করায় চালের মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে।

কৃষকরা জানান, সংসারের খরচসহ ধান উৎপাদনে নেওয়া ঋণ পরিশোধ ও পরবর্তী ফসল চাষের যোগান দিতে ধান কেটেই বিক্রি করতে বাধ্য হতে হয়। সারা বছরের জন্য ধান সংরক্ষণের কোনো সুযোগ থাকেনা। তবে আগেই ধান বিক্রিতে যেমন ভালো দাম মেলেনা, তেমনি বেশি দামে চাল কিনে খেতে হয়। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালি গ্রামের কৃষক আলেফ উদ্দিন বলেন, ‘প্রয়োজনের তাগিদে কাটার পরই ধান বিক্রি করতে হয়। এছাড়া ঘরে তোলা ধান সিদ্ধ-শুকাতে শ্রমিক ও জ¦ালানির পাশাপাশি মিলে তা ভেঙে চাল করতে খরচ বেশি হওয়ায় ঝক্কি নিতে চাননা কেউ।’ তবে বাজার থেকে বেশি দামে চাল কিনতে হিমসিম খেতে হয় বলেও জানান তিনি। সিটি বাজার, সিও বাজার, ধাপ বাজারসহ রংপুরের কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, স্বর্ণা ও ব্রিধান-২৯ জাতের মোটা চালের প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায় (এক সপ্তাহ আগেও যার দাম ছিল ৫৫ থেকে ৫৬ টাকা)। আর মাঝারি মানের চালের (ব্রি-২৮) দাম ৬২ টাকার স্থলে ৬৫ টাকা নেওয়া হচ্ছে। এর চেয়েও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে ভালো মানের চিকন চাল (নাজিরশাইল, জিরাশাইল ও মিনিকেট)। যা প্রতিকেজি ৬৮ টাকার স্থলে দাম বাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে ৭৫ টাকা। সাধারণ মানুষের ভরসা নিম্নমানের মোটা চালও এখন ৬০ টাকা কেজির নিচে কোন বাজারেই মিলছে না। সিটি বাজারে চাল কিনতে আসা রিকশাচালক আব্দুর রহিম জানান, বাবা-মা সন্তানসহ সাতজনের সংসারে প্রতিদিন গড়ে তিন কেজি চাল প্রয়োজন হয়। এজন্য ১৮০ টাকা জোগাড় করতে খুবই কষ্ট হয় তার। শ্রমজীবী শওকত আলী বলেন, ‘আমাদের আয় বাড়েনি অথচ চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। মোটা চালের কেজি ৬০ টাকায় উঠেছে। সংসারে কম খেয়েও আমাদের মত নিম্নআয়ের মানুষের চলা অসম্ভব হয়ে উঠেছে।’

আরও পড়ুন – বাড়ির আঙ্গিনায় স্বপন চৌধুরীর শখের বাগান

খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, মুষ্টিমেয় কয়েকটি অটোরাইস মিল মালিক ও মজুদদারদের ইচ্ছেমতো দাম নির্ধারণের কারণে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। একই সঙ্গে সরকারের নিয়ন্ত্রণ সংস্থার প্রতিও অভিযোগ রয়েছে তাদের। সিটি বাজারস্থ চালের দোকানদার আশেক আলী বলেন, আমরা বেশি দামে কিনি বলেই বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। তবে স্থানীয় মিল মালিক ও আড়তদাররা বলছেন, কৃষকরা ধান চাষ করলেও তার সিংহভাগই চলে যাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসায়ীদের কাছে। তাদের বড় মোকামে সব ধরনের চালের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে রংপুরের বাজারেও। মাহিগঞ্জ এলাকার চালের আড়তদার মাসুম মিয়াসহ কয়েকজন জানান, ভারত থেকে চালের আমদানি বন্ধ রয়েছে। ইতোমধ্যে আটোরাইস মিল মালিকরা ধান কিনে মজুদ করে রেখেছে। এছাড়া সরকারিভাবে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান চলায় বাজারে কিছুটা কৃত্রিম সংকট দেখা দিয়েছে। সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে চালের বাজার স্থিতিশীল হবে না বলেও জানান তারা।

তবে যোগাযোগ করা হলে রংপুর জেলা রাইস মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, নানা সংকটে কৃষকদের ধান কেটেই বিক্রি করতে হয়। আর এই সুযোগটি নেন বড় মিল মালিকরা। মৌসুমের শুরুতেই কম দামে ধান কিনে তারা মজুদ করেন। তবে সুযোগ গ্রহণে দক্ষিণাঞ্চলের বড় ব্যবসায়ীদের নিয়োগকৃত লোকজন এই অঞ্চলের কৃষকদের ধান কিনে নেন। মজুদের বড় অংশ তাদের কাছে থাকায় বাজার নিয়ন্ত্রন করেন তারা। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রংপুরের সহকারী পরিচালক বোরহান উদ্দিন বলেন, হঠাৎ করে বাজারে সব ধরণের চালের দাম বেড়ে গেছে। এ ব্যাপারে মাঠ পর্যায়ে জোর মনিটরিং করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২৮ লাখ মেট্রিকটন চাহিদার বিপরীতে চলতি মৌসুমে রংপুর বিভাগে প্রায় ৫৫ লাখ মেট্রিকটন ধান উৎপাদন হয়েছে। তার পরও বৃদ্ধি পেয়েছে চালের দাম। যদিও বর্তমানে গ্রামগঞ্জের হাটবাজারে প্রতিমণ ধান প্রকার ভেদে ১৩০০ থেকে ১৪০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে।

আরও পড়ুন – ‘সেগুন কাঠ-এর ধৈর্য’: টেকসই উন্নয়ন ও সমাজ গঠনের গভীর পাঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *