Tue. Aug 19th, 2025
ন্যায়বিচার প্রাসঙ্গিক আইন ও উপমান্যায়বিচার প্রাসঙ্গিক আইন ও উপমা। ছবি : সংগৃহীত

মুহাম্মদ যাইনুল আবেদীন : ন্যায়বিচার প্রাসঙ্গিক আইন ও উপমা। ইনসাফ ও ন্যায়বিচার  ছাড়া দুই বাক্তির বন্ধুত্বও টেকে না। ন্যায়বিচার না থাকলে রক্তের বাঁধনে নির্মিত আত্মীয়তা ভেঙ্গে পড়ে, ভেঙে পড়ে বাবার হাতের গড়া ক্ষুদ্র পরিবার। তাই ন্যায়বিচার ছাড়া একটি সমাজ বেঁচে থাকবে, মানুষের সমাজ হিসেবে-এ কথা ভাবা যায় না। আর রাষ্ট্র তো সমাজেরই বার্ধিত রূপ। তাই একটি দেশকে শান্তি-শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে সামাজিক ন্যায়বিচার। যে ন্যায়বিচার নিয়েই আজকের আলোচ্য।

আমরা জানি, ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের বিপরীতে হলো জুলুম ও অবিচার। সুস্থ ও জ্ঞানীজন কেন-অন্যায়ভাবে আক্রান্ত হলে একজন মাতালও টলোমলো কন্ঠে বলে-মামা! জুলুম করলেন? নাড়ির ধন সন্তানও যদি লক্ষ করে তার স্নেহময়ী জননী সুবিচারি নন কিংবা তার বাবা তার সব সন্তানকে একই নজরে দেখেন না। তখন সন্তান কর্মে, উপার্জনে, স্বপ্নে ও শপথে আবেগ হারিয়ে ফেলে। অতঃপর একেক ক্ষেত্রে একেক পরিবারে এর পরিণতি হয় একেক রকম। অসৌজন্যতা, ক্রোধ ও প্রতিবাদের সেই অগ্নিপ্রকাশ আমরা বরাবর দেখি! ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের অভাবে সম্পর্ক ভেঙে যায়। ভাঙ্গে সংসার, সমাজ ও রাষ্ট্র। ব্যক্তি ও সমাজ বঞ্চিত হয় শান্তি নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি থেকে।

ন্যায় ও অন্যায় আর ইনসাফ ও জুলুমের উপমা-আলো ও অন্ধকারের মতো। সমাজের সবাই ন্যায়বিচারের কথা বলে। বলে সব দল ও দর্শনের কর্তা-কর্মীরাও। কিন্তু এই পৃথিবী ইসলামের পদছোঁয়ায় ন্যায় ইনসাফ ও মানবতার যে পরশ লাভ করেছে তার দৃষ্টান্ত কি আজও কেউ দেখাতে পেরেছে? ‘আল্লাহতাআলা বলেছেন-‘আল্লাহই বিচার করেন সঠিকভাবে।’ (মুমিন-৪০ : ২০) আল্লাহ তাআলার এই সঠিক ও ন্যায়বিচারের এক উন্মুক্ত দর্পণ আমাদের গর্বের ধর্ম ইসলাম।

ইনসাফ ও ন্যায়বিচার ইসলামের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। এ সম্পর্কে কোরআন মাজিদের ঘোষণা স্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন। আল্লাহতাআলা বলেছেন-‘যখন তোমরা কথা বলবে, তখন ন্যায্য কথা বলবে স্বজনদের সম্পর্কে হলেও এবং আল্লাহকে প্রদত্ত অঙ্গীকার পূরন করবে। এভাবে আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দেন যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ করো। (আনআস ৬ : ১৫২) আরেক আয়াতে বলেছেন-‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দেবেন-‘আমানত তার হকদারকে প্রত্যর্পণ করতে; তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদের যে উপদেশ দেন তা কত উত্তম!

আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। (নিসা-৪: ৫৮) একই সুরায় আরেকটি আয়াতে বলেছেন-‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ন্যায়বিচারে দৃঢ় প্রতিষ্ঠ থাকবে আল্লাহর সাক্ষীরূপে : যদিও তা তোমাদের নিজেদের অথবা মা-বাবা এবং আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে হয়: সে বিত্তবান হোক অথবা বিত্তহীন-আল্লাহ উভয়েরই ঘনিষ্ঠতর। তাই তোমরা ন্যায়বিচার করতে প্রবৃত্তির অনুগামী হয়েঅ না। যদি তোমরা পেচালো কথা বলো অথবা পাশ কাটিয়ে যাও তবে তোমরা যা করো আল্লাহ তার সম্যক খবর রাখেন। (নিসা : ১৩৫) সুবিচারের মর্মবাণী আরও বাঙময় দেখি সুরা মায়িদায়! আল্লাহতাআলা সুবিচার প্রতিষ্ঠা এবং তার অন্তরায়ের কথাও বলেছেন যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে। বলেছেন-‘হে মুমিনগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানে তোমারা অবিচল থাকবে। কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদের যেন কখনো সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। সুবিচার করবে, এটা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় করবে। তোমরা যা করো নিশ্চয় আল্লাহ তা সম্যক খবর রাখেন। [মায়িদা : ৮]

উল্লিখিত চারখানা আয়াতের স্পষ্ট কথা হলো- ১. আল্লাহ ন্যায়বিচরক ২. ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করা ও ন্যায়ের পক্ষে সাক্ষ্যদান আল্লাহর হুকুম। ৩. নিজেদের এবং মা-বাবা ও আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে হলেও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকতে হবে। ৪. ন্যায়বিচার করতে গিয়ে প্রকৃতিকে প্রশ্রয় দেবে না। ৫. কারও প্রতি ব্যক্তিবিদ্বেষ কিংবা পূর্ববিরোধ যেন ন্যায় প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় না হয়। ৬. সুবিচার তাকওয়া ও আল্লাহভীতির নিকটতর। আর আল্লাহভীতি ও তাকওয়ার নিকটতর। আর াাল্লাহভীতি ও তাকাওয়ার পুরস্কার হলো বেহেশত। তাছাড়া ন্যায়বিচারের সঙ্গে আল্লাহভীতির বিষয়টি একারণেই সবিশেষ প্রাসঙ্গিক-আল্লাহতাআলা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন- ‘এবং কেয়ামত দিবসে আমি ন্যায়বিচারের মানদন্ড স্থাপন করব। সুতরাং কারও প্রতি কোনো অবিচার করা হবে না এবং কর্ম যদি তিল পরিমাণ ওজনেরও হয় তবুও আমি তা উপস্থিত করব। হিসাব গ্রহণকারীরূপে আমিই যথেষ্ট।’ (আম্বিয়া ২১ : ৪৭ ) এই হলো ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অসামান্য সফলতার মূল রহস্য।

আল্লাতায়ালা কেয়ামতের দিন ইনসাফের মানদন্ড স্থাপন করবেন। এই পার্থিব জীবনের সংক্ষিপ্ত পাট গুছিয়ে যখন পৃথিবীর প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত আগত-অনাগত সব মানুষ উপস্থিত হবে এক বিশাল পরিসরের ময়দানে। প্রতিটি মানুষের সমগ্র জীবনের অনুপুঙ্খ হিসাব দিতে হবে সেখানে। ন্যায়, অন্যায়, কল্যাণ ও অকল্যাণের পুরুষ্কার ও শাস্তি সেদিন সবারই পেতে হবে। আর সেদিনের বিচার হবে পূর্ণ ইনসাফ ও ন্যায়ের সঙ্গে। তাই আল্লাহ ও তাঁর বিচারের প্রতি যাদের আস্থা, বিশ্বাস এবং যাদের শেষ পরিণতির ভয় আছে তারা কোনো দিন কারও প্রতি অবিচার করতে পারে না।

এ-ও সত্য, সমাজে ন্যায় ও অন্যায়টা প্রতিষ্ঠা পায় বড় এবং শক্তিমানদের দ্বারা। ক্ষুদ্র পরিবারেও বিষযটি এর ব্যতিক্রম নয়। পরিবারের কর্তা অবিচারী হলে সেখানে আর ন্যায় ও বিচার থাকে না। তাই আল্লাহতায়ালাও সমাজে সুবিচার ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় যারা মুুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে তাদের এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন বিশেষভাবে। প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-‘সাত শ্রেণির মানুষকে আল্লাহতায়ালা সেদিন তাঁর আরশের ছায়ায় ঠাঁই দেবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত আর কোনো ছায়া থাকবে না। আর তারা হলো- ১. ন্যায়পরায়ণ শাসক ২. আল্লাহর ইবাদতে বেড়ে উঠেছে এমন যুবক… (সহীহ বুখারি, হাদিস : ১৪২৩; সহীহ মুসলিম, হাদিস : ১০৩১); অন্য একটি হাদিসে আছে- এক ব্যক্তি এসে বলল- ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাকে এমন একটি আমল বলে দিন যা আমাকে বেহেশতে নিয়ে যাবে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- ইনসাফের সঙ্গে কথা বলবে এবং (কারও সঙ্গে লেনদেন করলে) অতিরিক্ত দেবে। (ইতিহাফুল খিয়ারাতিশ মাহারা- ৪ : ২৭৪) ন্যায় ও ইনসাফের বিপরীত হলো জুলুম। জুলুম সম্পর্কে আমাদের নবীজি বলেছেন- তোমরা অবিচার করবে। জুলুম ও অবিচার কেয়ামতের দিন ভয়াবহ অন্ধকাররূপে হাজির হবে। ( সহীহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৭৮)

ইসলামের জীবন পাতায় এগুলো শুধু চমৎকার বাণীরূপে উচ্চারিত শুভচিহ্নই নয়, বরং পরম বাস্তবতায় উজ্জ্বল। আপন-পর, ছোট-বড় ও ধনী-গরীবের পার্থক্য না করে সরলরেখায় ইনসাফ করার এমন উদাহরণ আমাদের ধর্মে প্রচুর। মক্কা বিজয়ের সময়কার ঘটনা। আরবের এক সম্ভ্রান্ত কবিলা বনু মাখজুমের এক নারী চুরি করে বসে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোরআনের বিধান অনুসারে হাত কাটার আদেশ দেন। সম্ভ্রান্ত বংশের মেয়ে বলে সবাই বিচলিত হন, প্রিয় নবীজির প্রিয় পাত্র হজরত উসামা ইবনে জায়েদকে গিয়ে ধরেন- তুমি একটু সুপারিশ করো। তিনি সুপারিশের বাণী মুখে আনতেই নবীজি ক্ষুদ্ধ হলেন। বললেন, আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত বিধানের ক্ষেত্রে সুপারিশ করছ? তারপর সবার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন এবং বললেন, শোনো! তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা এ কারণেই ধ্বংস হয়েছে-তাদের মধ্যে সম্ভ্রান্তজনা চুরি করলে তাকে ছেড়ে দিত আর দুর্বল কেউ চুরি করলে তাকে শাস্তি দিত! খোদার কসম! যদি মুহাম্মদের কন্যা ফাতেমাও চুরি করত আমি তার হাত কেটে দিতাম। (সহীহ বুখারি, হাদিস : ৩২৮৮; সহীহ মুসলিম, হাদিস : ১৬৮৮)

বলতে দ্বিধা  নেই, এই যে আমাদের সমাজে আজ চুরি, ডাকাতি, হত্যা, চাঁদাবাজি এবং সবিশেষে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্নীতি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না- এ কি বিচারের বৈষম্যের কারণে নয়? যে প্রভাব কিংবা কৌশল ন্যায়বিচারককে বাধাগ্রস্থ করে সে তো জুলুমেরই হাতিয়ার! হজরত ওমর রা. এর শাসনামল। তার দরবারে মোকদ্দমা এসেছে। একজন মুসলমান অপরজন ইহুুদি। হজরত ওমর ইহুদির পক্ষে রায় দিয়েছেন। (তারগিব ওয়া তারহিব, হাদীস-৩ : ৪৪৫) হজরত ওমর রা. এর শাসনমালে একজন গাসমানি নেতা ইসলাম গ্রহণ করেন। তার নাম ছিল আইহাম। মুসলমান হওয়ার পর কাবা শরীফ তাওয়াফ করছিল। এমন সময় তার রাজকীয় পোশাকে একজন যাযাবরের পা পড়ে যায়। তার ছিল রাজকীয় মেজাজ। সঙ্গে সঙ্গে চড় বসিয়ে দেয় যাযাবরের গালে। বেচার যাযাবর বিচার দায়ের কর হজরত ওমরের দরবারে। ওমর ফয়সালা দেন- হয় যাযাবরের সঙ্গে আপস করে ক্ষমা নেবে নইলে চড়ের বদলে চড়। আইহাম সদ্য মুসলমান। মান-মস্তিষ্কে তখনো পরকালের ভয় এবং ন্যায়ের আলোকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সে দুই দিনের সুযোগ প্রার্থনা করে। অত:পর সেই সুযোগে পালিয়ে যায়। একজন আঞ্চলিক রাজা ইসলামে গেছেন বলে ওমর এইটুকু দু:খ পাননি। কারণ ন্যায়বিচারের মূল্য অনেক বেশি! (খালেদ সাইফুল্লাহ রাহমানি, রাহে আমল-৩ : ২৭)

আরেকবারের ঘটনা হজরত ওমরের শাসনামল। মদিনার বিচারপতি তখন হজরত জায়েদ ইবনে সাবেত রা. এক মামলায় বিবাদী হয়ে আদলতে এসেছেন। হজরত জায়েদ তাকে সম্মান করে বিচারপতির পাশে বসাতে চাইলে হজরত প্রতিবাদ করে বললেন- এটা অবিচার। আদালতে বাদী-বিবাদী সমান।

আরেকবারের কথা। বিচারপতি তখন হজরত উবাই ইবনে কাব রা. আদলতে বিবাদী হয়ে এসেছেন হজরত ওমর আমিরুল মুমিনিন। কিন্তু বাদী তার দাবির পক্ষে স্বাক্ষী পেশ করতে পারেনি। ইসলামের আইনে বাদী স্বাক্ষী দিতে অক্ষম হলে বিবাদীকে কসম খেতে হয়। বিচারপতি বাদীকে অনুরোধ করলেন- ‘আমিরুল মুমিনিনকে কসম করা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য। হজরত ওমর রা. প্রতিবাদ করে বললেন, এখানে বাদী-বিবাদীর সমান অধিকার। তাই কাউকে ছাড় দেওয়া ন্যায়পরিপন্থি।

হজরত আনাস রা. বর্ণনা করেন, মিসরের একজন কিবতি নাগরিক মদিনায় এসে হজরত ওমর রা. এর কাছে নালিশ করল- মিসরের গভর্নর হজরত আসর ইবনুল আম রা. ঘোড়া দৌড়ের আয়োজন করেছেন। প্রতিযোগিতায় আমার ঘোড়াটি সব ঘোড়াকে ছাড়িয়ে গেছে। মানুষ সেটা দেখেছেনও। কিন্তু গভর্ণর পুত্র মুহাম্মদ বলতে লাগল- আল্লাহর কসম! ওটা আমার ঘোড়া। আমি কাছে আসার পর শনাক্ত করে বলি, খোদার কসম! এটা আমার ঘোড়া। তখন সে আমাকে চাবকাতে থাকে আর বলতে থাকে, জানো আমি হলাম সম্ভ্রান্ত ঘরের সন্তান!

হজরত ওমর বললেন, বসো তুমি। চিঠি লিখলেন- আমার পত্র পাওয়া মাত্র পুত্র মুহাম্মদকে সঙ্গে করে মদিনায় চলে আসবে। পত্র পেয়ে হজরত আমার পুত্রকে ডেকে বললেন, তুমি কোনো অন্যায় করেছ? পুত্র নীরব। ছুটছেন পিতা-পুত্র মদিনার উদ্দেশ্যে। হজরত আনাস বলেন, আমরা তখন ওমরের দরবারেই বসা। দেখলাম পরনে একটি লুঙ্গি আর একটি চাদর গায়ে অমর ইবনুল এসেছেন। ওমর নয়ন বিস্ফারিত করে দেখছেন, অমরের পেছনে আগত লোকটি মুহাম্মদ কি না। কাছে আসতেই সেই মিসরিকে ডেকে চাবুক তুলে দিয়ে বললেন, ইবনুল আকরামিন সম্ভ্রান্ত সন্তানের খবর নাও! লোকটি তাকে ইচ্ছামতো চাবকানের পর ওমর বললেন, তার বাবাকেও মারো! তার শক্তিতেই সে তোমার গায়ে আঘাত করেছে। লোকটি বলল, যে আমাকে মেরেছে আমি তাকে মেরেছি। ওমর বললেন, তুমি তার বাবাকে মারলে আমি বাধা দিতাম না। তারপর হজরত অমর ইবনুল আসকে বললেন, জনগণকে তাদের মায়েরা স্বাধীন হিসেবে জন্মদান করেছে। তোমরা তাদের ক্রীতদাস বানালে কবে? এরপর মিসরিকে বললেন, নির্ভয়ে ঘরে ফিরে যাও। কিছু হলে আমাকে লিখে জনাবে। (ইবনুল জাওযির সিরাতে ওমর রা.- এর সূত্রে)

হজরত মুয়াবিয়া রা. এর শাসনামলে মদিনার বিচারপতি ছিলেন হজরত আবু হুরায়রা রা.। মদিনার গভর্ণর তখন মারওয়ান ইবনুল হাকাম। তার ভাই হারেস ইবনুল হাকাম একবার হজরত আবু হুরায়রার আদালতে এসে তার তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে পড়ে। এরই মধ্যে এক ব্যক্তি এসে হারেসের বিরুদ্ধে আদালতে নালিশ করে বসে। আবু হুরায়রা রা. তখন সঙ্গে সঙ্গে হারেসকে আসন থেকে উঠে বাদীর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে বলেন। তারপর বিস্তারিত শুনে ফয়সালা করেন। (মুজাহিদুল ইসলাম কাসেমি, ইসলামি আদলত)

ইসলামি ইতিহাসের এক বিখ্যাত বিচারপতি হজরত সুরাইহ ইবনুল হারেস বিন্দি রহ.। প্রখ্যাত তাবেঈ। হজরত ওমর তাকে বিচারপতির আসনে সমাসীন করেন। টানা পঁচাত্তর বছর বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন। তার আদলত ঘিরে ন্যায়বিচারের অনেক ঘটনাই ইতিহাসের মহামূল্য সম্পদ হয়ে আছে। এখানে দুটি উদাহরণ দিই। হজরত ওমর রা. এক গ্রাম্য লোকের কাছ থেকে একটি ঘোড়া কিনলেন। দাম চুড়ান্ত করার পর এক ব্যক্তিকে ঘোড়ায় চড়তে দিলেন। এতে করে ঘোড়াটি জখম হয়ে যায়। এখন এই ঘোড়া ওমর নেবেন কিনা। মালিককে বললেন, তুমি একজন সালিশ ধরো, আমরা তার বিচার মেনে নেব। সে হজরত সুরাইহকে সালিশ মানল। সুরাইহ ফয়সালা করল, আমিরুল মুমিন! আপনি যখম দাম করেছেন তখন তার কোনো ত্রুটি ছিল না। এখন ফিরিয়ে দিতে চাইলে তেমনটিই ফিরিয়ে দিতে হবে। ওমর তার ফয়সালা মেনে নেন।

ন্যায়বিচার নিয়ে আরেকটি ঘটনা খুবই বিখ্যাত। হজরত রা. তখন মুসলিম বিশ্বের অধিপতি। তার একটি লৌহবর্মটি হারিয়ে যায়। একবার তার সেই লৌহমর্ব একজন ইহুদির হাতে দেখতে পেয়ে বলেন, এটা তো আমার। আমি এটা কারও কাছে বেচিওনি, কাউকে দানও করিনি। ইহুদি বলল, এটা আমার জিনিস, আমার হাতে। হজরত আলী বললেন, চলো তাহলে বিচারপতির দরবারে! গেলেন তারা সুরাইহর দরবারে। সব শোনার পর সুরাইহ বললেন, আমিরুল মুমিনিন স্বাক্ষী পেশ করুন! হজরত আলী হাসান রা. এবং তার আজাদকরা ক্রীতদাস কুনবুরকে স্বাক্ষী বানালেন। সুরাইহ বলে দিলেন, আমিরুল মুমিনিন পুত্রের স্বাক্ষ্য পিতার পক্ষে এবং গোলামের স্বাক্ষ্য মনিবের পক্ষে গ্রহণযোগ্য নয়। তারপর তিনি ইহুদির পক্ষে রায় দেন। রায় শুনে সেদিন সেই ইহুদি বলেছিল, আমিরুল মুমিনিন আমাকে আদালতে নিয়ে এলেন। আদালত তার বিপক্ষে রায় দিলেন। আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি ইসলাম সত্য ধর্ম। আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসুল। আমিরুল মুমিনিন। এই লৌহবর্ম আপনার। রাতে অন্ধকারে পড়ে গিয়েছিল।

আজ আমরা যে অবিচার, অত্যাচার আর দুর্নীতির ঘোর অন্ধকারে ডুবে আছি, এই উপমাগুলোর আলোকে মুক্তির পথটাও আশা করি পাঠক খুঁজে নিতে পারবেন। সবশেষে শুধু এটুকু স্মরণ করিয়ে দিই- বিশ্ব জাহানের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ বলেছেন, নিশ্চয় তিনি ন্যায়বিচারকদের ভালোবাসেন।

[চট্টগ্রাম থেকে মো. কায়েস, কুড়িগ্রাম থেকে আলী আহমেদ ও মাদারীপুর থেকে মো. রাসেদ প্রমুখ পাঠকের অনুরোধে এবং শিক্ষণীয় ও সময়োপযোগী বিবেচনায় ২৮ আগস্ট ২০১৮ সালের গণপ্রহরী থেকে প্রকাশিত।] 

ন্যায়বিচার

আরও পড়ুন – আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে আমাদের কথা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *