উত্তম সরকার : পাখির নাম সাত ভায়লা। গাঁয়ের পথ চলতে প্রায়ই দেখা য়ায় পাঁচ-সাতটি পাখির একেকটি দল। সে দল কোন ছোট গাছের তলায় কিংবা ঝোপ জঙ্গলে কেচর কেচর শব্দ করে জোর পায়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। মনে হবে, ওদের যেন হুলুল্লুল ঝগড়া লেগেছে।
সম্প্রতি খোলাহাটী ইউনিয়নের ফারাজীপাড়া গ্রামের একটি বাঁশঝাড়ের নীচে দিয়ে, যাওয়ার সময় সাত ভায়লা পাখির ঝগড়ার শব্দ কানে ভেসে আসে। মুহুর্তে থমকে দাঁড়াই এবং ক্যামেরা হাতে চেষ্টা ঐ পাখিটির ছবি তোলার জন্য। দেখতে পেলাম বাঁশঝাড়ের নীচে বেশকিছু সাত ভায়লা লাফালাফি, চেঁচামেচি করছে। একটু কাছে যেতেই ফুরত করে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। মনে মনে ভাবলাম ছবি তোলা আর হল না।
এক পর্যায়ে দেখলাম দলছুট একটি সাত ভায়াল পাখি একা একটি গাছের নীচে একা তিড়িং বিড়িং লাফিয়ে বেড়াছে। ঝটপট ক্যামেরা জুম করে ওই সাত ভায়লা পাখির ছবি বন্দি করলাম। সাত ভায়লা পাখি আকারে শালিকের ছেয়ে একটু বড়। পালকের রঙ মেটে, চোখর বলয় সাদা, পা ও ঠোঁট ফেকাসে হলদে। দেখে মনেহয় যেন রক্তশূন্যতায় ভূগছে। তবে চোখের চাহনিটি ভযানক দুষ্টু। এক সঙ্গে চরে বেড়ায় বলেই বোধহয় এদের নাম ‘সাত ভায়লা’ যেন সাত ভাই-বোন ওরা।
পাখির নাম সাত ভায়লা। পাখিটার এই নাম নিয়ে গ্রাম বাংলায় প্রচলিত একটি গল্প আছে। গল্প : এক গাঁয়ের মোড়ল ছিল আঁটকুড়ে। বউয়ের সঙ্গে তার বনিবনা ছিল না। বউ ভাবত, মোড়লের পাপেই সে সন্তানের মুখ দেখতে পারল না। একদিন মোড়ল গেল দূরের এক গাঁয়ে। ফেরার পথে সে জল পিপাসায় কাতর হয়ে এক গেরস্তবাড়িতে যায়। গেরস্ত মোড়লকে যত্ন সহকারে জল খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করে। মোড়ল দেখল গেরস্তের অবস্থা খুব ভাল, তার সাত ছেলে। বিশ্রাম শেষে মোড়ল আবার পথ চলতে শুরু করে। পথে এক কুষ্ঠ রোগী তার কাছে ভিক্ষা চেয়ে বলল, ‘শীঘ্রই তোমার একটি কন্যা সন্তান হবে’। মোড়ল তাকে খুশি করল।
কিছুদিন পর মোড়লের বউয়ের কোল জুড়ে এলো চাঁদের মতো ফুটফুটে এক কন্যা। কন্যার বয়স হতেই মোড়ল তার বিয়ের কথা ভাবতেই, মনে পড়ে সেই গেরস্তের কথা,যার সাত ছেলে। গেরস্তের কাছে মোড়ল বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। চাষীর সাত ছেলেরই ছিল বিয়ের বয়স তাই প্রত্যেকেই মোড়ল কন্যাকে বিয়ে করতে চায়। এই নয়ে শুরু হয় সাত বাইয়ের ঝগড়া। তারা দল বেঁধে প্রতিদিন মোড়লের বাড়ী আসে, কে বিয়ে করবে তা নিয়ে ঝগড়া করে। এতে অতিষ্ঠ হয়ে মোড়ল স্ত্রী-কন্যা নিয়ে বাড়ী ছেড়ে পালায়।

এক সকালে সাত ভাই এসে দেখে বাড়ীতে কেউ নেই, সারা বাড়ী খাঁ খাঁ করছে। তারা মোড়লের মেয়েকে সারা বাড়ী আকুল হয়ে খূঁজতে লাগল। খুঁজতে খূঁজতে তারা এক সঙ্গে হয়ে গেল সাতটি পাখি। আজও তারা এক সঙ্গে যেন কন্যাকে খুঁজছে আর পরস্পর ঝগড়া করছে। লোকে তাই এদের সাত ভাই বা সাত ভায়রা পাখি বলে অর্থাৎ পাখির নাম সাত ভায়লা।
প্রজাতি পরিচিতি: সাত ভায়লার ইংরেজি নাম: জাঙ্গল ব্যাবলার, বৈজ্ঞানিক নাম: টার্ডিডেস স্ট্রায়টাস, গোত্র: সিলভিআইদি। সনাক্তকরণ বৈশিষ্ট: সাত ভায়লার ডানা ছোট, তাই ভাল উড়তে পারে না। তারা খেলে রক্কর ঝক্কড় উড়ে দৌড়ে পালায়। আর এক ডাল থেকে অন্য ডালে দল বেঁধে পর পর উড়ে বেড়ায়। এদের পালকগুলো যেন কোন মতে শরীরে লেগে আছে, একটু নাড়া খেলেই যেন খসে পড়বে। স্বভাব : সাত ভায়লার দলবদ্ধ হয়ে বাস করে। একে অন্যের সুখ-দুঃখের সঙ্গী। স্ত্রী-পুরুষ একই রকম দেখতে
খাদ্য: প্রিয় খাবার কীটপতঙ্গ, শূক এবং ছোট ফল ও ফুলে মধু। প্রজননঃ মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর। ঝোপ-জঙ্গলের ছোট গাছের পাতার আড়ালে ঘাস ও সরু শিকড় দিয়ে এরা পেয়ালা আকারে বাসা তৈরি করে। স্ত্রী পাখি তাতে ডিম পাড়ে ৩-৪ টি। এদের বাসায় চোখ গেল এবং কোকিল গোত্রীয় আরও এক দুটি পাখি ডিম পেড়ে পালায়। সাত ভায়লা’রা সেগুলো নিজের ডিম মনে করে তা দেয় এবং নবজাতকদের আপন সন্তান মনে করে পরিচর্যা করে।
