Sat. Jul 12th, 2025
পানি সংকট: দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্পেপানি সংকট দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্পে

স্বপন চৌধুরী: পানি সংকট: দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্পে। যা কৃষক জনতাকে ভাবিয়ে তুলেছে। তদসত্বেও ভয়াবহ পানি সংকটের শঙ্কা নিয়ে দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের মাধ্যমে সেচ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। চলতি বোরো মৌসুমে ব্যারাজ পয়েন্টে মাত্র আড়াই হাজার কিউসেক পানিপ্রবাহ নিয়ে হেড রেগুলেটরের মাধ্যমে রংপুর ও দিনাজপুর প্রধান সেচখালে পানি ছাড়া হয় ১৫ জানুয়ারি। সেচ কার্যক্রম চালু রাখতে বন্ধ রাখা হয়েছে ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট। যদিও গত বছর সেচ কার্যক্রম শুরুর প্রাক্কালে পানিপ্রবাহ ছিল চার হাজার কেউসেকের বেশি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, এবারও তিস্তার পানি দিয়ে শতভাগ সেচ দেওয়া সম্ভব হবেনা। চলতি মৌসুমে অনেক জমিতে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কৃষকদের সেচ দিতে হবে। চলতি বছর সেচ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে মাত্র ৫৫ হাজার হেক্টর।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পের আওতায় গত বছর ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেওয়া হলেও চলতি বোরো মৌসুমে নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ১২ উপজেলায় ৫৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নীলফামারীর জলঢাকায় সাড়ে ৯ হাজার হেক্টর, কিশোরগঞ্জে ১০ হাজার হেক্টর, নীলফামারী সদরে ১০ হাজার হেক্টর, সৈয়দপুরে ৩ হাজার হেক্টর ও ডিমলায় সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর, রংপুরের তারাগঞ্জে ৩ হাজার হেক্টর, বদরগঞ্জে ১ হাজার হেক্টর, গঙ্গাচড়ায় ৪ হাজার  হেক্টর ও রংপুর সদরে ৪ হাজার হেক্টর, দিনাজপুরের খানসামায় ৫০০ হেক্টর, পার্বতীপুরে ২ হাজার  হেক্টর ও চিরিরবন্দর উপজেলায় সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর। সূত্র আরও জানায়, সেচ কমান্ড এলাকায় ৮৪ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদানের কথা থাকলেও তিস্তায় পানি সংকটসহ নানা জটিলতার কারণে ২০১৪ সালে তিন জেলায় মাত্র ৮ হাজার হেক্টর, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে ১০ হাজার হেক্টর, ২০১৭ সালে ৮ হাজার হেক্টর, ২০১৮ সালে ৩৫ হাজার হেক্টর, ২০১৯ ও ২০২০ সালে ৪০ হাজার হেক্টর, ২০২১ সালে ৫৩ হাজার হেক্টর, ২০২২ ও ২০২৩ সালে ৩৫ হাজার হেক্টর এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালে ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করা সম্ভব হয়।

পানি সংকট: দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্পে। এমন সংকট নিয়ে কৃষকদে মতামত জানতে চেষ্টা করা হয়। সরেজমিনে তিস্তা সেচ প্রকল্পের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সেচ খালে পানি সরবরাহ শুরু হওয়ায় কৃষকরা বোরো চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কেউ জমি কাঁদা করছেন, কেউবা রোপন করছেন ধানের চারা।  কৃষকরা জানান, জমি তৈরি থেকে শুরু করে ধান কাটা পর্যন্ত সেচ প্রকল্পের আওতায় প্রতি একর জমিতে  সেচ খরচ দিতে হয় ৪৮০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি বিঘায় (৩৩ শতাংশ) খরচ পড়ে মাত্র ১৬০ টাকা। সেখানে নিজস্ব কিংবা ভাড়ায় সেচযন্ত্র ব্যবহার করলে বিঘাপ্রতি সেচ খরচ গুনতে হয় কমপক্ষে আড়াই হাজার টাকা। সে কারণে বোরো চাষে প্রকল্পের সেচখালে পানি আসার অপেক্ষায় থাকেন তারা। কিন্তু মৌসুমের কোনো কোনো সময় ঠিকমত পানি মেলেনা বলে অভিযোগ রয়েছে তাদের।

নীলফামারীর জলঢাকার দুন্দিবাড়ি এলাকার কৃষক আব্দুস সবুর বলেন, ‘সেচ প্রকল্পের আওতায় অনেক কম খরচে বোরো চাষ করা যায়। তবে তিস্তায় পানি সংকটের ফলে কখনো কখনো সেচখালে পানি থাকেনা, ফসল রক্ষায় তখন জমিতে সেচযন্ত্র বসিয়ে সেচ দিতে হয়। সেক্ষেত্রে খরচ বেড়ে যায়।’ রংপুরের গঙ্গাচড়ার খলেয়া এলাকার কৃষক নুরুজ্জামান জানান, প্রতি বছর সেচ প্রকল্পের আওতায় তিনি বোরো চাষ করেন পাঁচ বিঘা জমিতে। পানি পেয়ে জমি তৈরি করলেও শৈত্যপ্রবাহের কারণে এখনো চারা রোপন করতে পারেননি। দু’একদিনের মধ্যে চারা লাগানো সম্ভব হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের পানিতে ধানের ফলন ভালো হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঠিকমত সেচের পানি মিলবে তো!’ এমন সন্দেহ প্রকাশ পায় তাঁর কথায়।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের মুখ্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা অমলেশ চন্দ্র রায় জানান, তিন জেলার ১২ উপজেলায় প্রকল্পের সেচখালের দৈর্ঘ্য ৭৬৬ কিলোমিটার। ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তার পানিপ্রবাহ ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। সে কারণে সবগুলো জলকপাট বন্ধ করে সেচের পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। ফলে ব্যারাজের ভাটিতে তিস্তায় আর প্রবাহ থাকছে না। প্রকল্প এলাকায় সেচ দেওয়া এবং নদীর প্রবাহমাত্রা ঠিক রাখতে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে স্বাভাবিক প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন ২০ হাজার কিউসেক পানি।

শুধু সেচ প্রকল্প চালাতেই প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন ১৪ হাজার কিউসেক এবং নদীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজন ৬ হাজার কিউসেক। কিন্তু তিস্তায় প্রয়োজনীয় পানি মিলছে না। শুষ্ক মৌসুমে বোরো আবাদের সময় ব্যারাজ পয়েন্টে বিগত কয়েক বছর ধরে পাওয়া যায় মাত্র ৫০০ থেকে ১০০০ কিউসেক পানি। গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে ভারতের একচেটিয়া পানি প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশ অংশে তিস্তার পানি ক্রমাগত কমে গেছে। তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল এলাকাগুলোকে সেচের আওতার বাইরে রাখায় কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

পানি সংকট: দেশের সর্ববৃৎ সেচ প্রকল্পে। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে পানি উন্নয়ন বোর্ড রংপুরের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, এই প্রকল্পটি বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ সক্ষমতার আংশিক ব্যবহার করে উত্তরাঞ্চলের রংপুর, দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলার ১২ উপজেলায় সেচ কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়েছে।

লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত পাঁচ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে চারা রোপন করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ৩০ হাজার হেক্টর ছাড়িয়ে যাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমানে ব্যারাজ পয়েন্টে পানিপ্রবাহ রয়েছে আড়াই হাজার কিউসেক। এর থেকে আরো কমলে সেচের পানি সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটবে। তবে ৭৬৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সেকেন্ডারি আর টারসিয়ারি সেচখাল পুনর্বাসন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। নতুন উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে এর সক্ষমতা বাড়বে।

আরও পড়ুন- তিস্তা নদী মৌসুমের শুরুতেই শুকিয়ে কাঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *