গণপ্রহরী ডেস্ক : পুলিশ এত নির্মম হতে পারে উল্লেখ করে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেছেন, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে পুলিশ যা করেছে, তা বিগত ১৫ বছরে বিশ্বের কোনো পুলিশ করতে পারেনি।। এসব কর্মকাণ্ড পুলিশকে চরমভাবে হেয় করেছে। পুলিশ যে এত নির্মম হতে পারে ভাবতেও লজ্জা লাগে।
শনিবার বিকেলে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। আইজিপি এ সময় বলেন, তিনি সারাদেশের বিভিন্ন ইউনিট পরিদর্শন করে পুলিশ সদস্যদের চিন্তাভাবনা বোঝার চেষ্টা করছেন।। তাদের মনোবল বাড়ানোর জন্য যা করা যায় তা করার চেষ্টা করছেন।
ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তবে ভালো প্রভাবের প্রয়োজন আছে।
সারাদেশে মিথ্যা মামলা প্রসঙ্গে আইজিপি বলেন, কোনো নিরপরাধকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। বরং প্রাথমিক তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত হলে তাকে গ্রেফতার না করার জন্য তদন্ত কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন তিনি।
পুলিশের মনোবল ফিরিয়ে আনতে পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে শনিবার সকালে সিলেট পৌঁছেছেন আইজিপি বাহারুল আলম।। সিলেটে পৌঁছে তিনি এসএমপি সদর দফতরে সিলেট বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেন।
প্রায় ২ ঘণ্টা বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আইজিপি। শুরুতেই পুলিশ সংস্কার নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশ সংস্কার কমিশন যে বিষয়টি নিয়ে ভাবছে, আমরাও তা চাই।। যাতে রাজনৈতিক প্রভাব পুলিশের ওপর না পড়ে। ভালো প্রভাব আসতে পারে। কারণ রাজনীতিবিদরা আমাদের কান্ডারী। তারাই দেশ চালাবে। তবে আমরা যেন তাদের কুপ্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারি।
আইজিপি বলেন, গত ১৫ বছরে আমাদের ওপর দলীয়ভাবে এত খারাপ প্রভাব আসছে, এমন কোনো অন্যায় নেই যা আমরা করিনি। আপনারাও এটা জানেন এবং আমরা এটা জানি। এর জন্য আমরা অত্যন্ত দুঃখিত ও লজ্জিত।
বাহারুল আলম বলেন, ‘আমরা সেই বাহিনীর সদস্য, সেই উপলব্ধিটা আমাদের মধ্যে আসে, এসব চিত্র যখন দেখি। আমরা যে ঘটনাগুলো ঘটিয়েছি, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা পুলিশ ঘটায়নি। হয়তো সেনাবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে এমন কাজ করতে পারে, কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে পুলিশ এত নির্মম হতে পারে ভাবতে পারি না। রাজনীতিবিদরা কেন এমন করলেন? দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার জন্য এমন নির্দেশ দেওয়া হয় যে জনগণের জীবন ধ্বংস করে ফেলবেন? আগে পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠাতো, কিন্তু এভাবে মেরে ফেলবে- আমার কাছে উত্তর নেই।। আমার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে পুলিশ যে মঞ্চ থেকে চলে গেছে সেখান থেকে উত্তরণ ঘটানো।
পুলিশের হারানো মনোবল ফিরিয়ে আনতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে আইজিপি বলেন, পুলিশের সহকর্মীরা মারা গেছেন, পুলিশের বিরুদ্ধেও জনতার বিচার হয়েছে।। এসব নিয়ে এত ঝামেলার মধ্য দিয়ে তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। শুধু পুলিশ নয়, সাধারণ জনগণের মাঝেও ঝড় উঠেছে। কারণ আমরা এসব দেখে অভ্যস্ত নই।
তিনি বলেন, যেহেতু পুলিশ একেবারে সামনের সারিতে ছিল, তাই তাদের ওপর এর প্রভাব বেশি পড়ে। পুলিশ দেখে, তার সহকর্মীকে হত্যা করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, অন্য কেউ দৌড়ে গিয়ে পুলিশকে লাথি মেরেছে।। কারণ মানুষের মধ্যে এত ঘৃণা জন্মেছে যে মানুষ আর তা নিতে পারছে না। আর এসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পুলিশ তাদের আবেগ হারিয়ে ফেলেছে। পুলিশের আবেগ ফিরিয়ে আনাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেজন্য আমি ঢাকায় না বসে সারাদেশের পুলিশ সদস্যদের কাছে যাচ্ছি, পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলছি। আমার কাজ হল তারা কি ভাবে, তারা কি চায় তা শোনা। আমি হয়তো সব কিছু করতে পারব না, কিন্তু আমি তাদের কষ্টের কথা শুনতে চাই, এতে হয়তো তারা অন্তত মানুষিক স্বস্তি পাবে।
পুলিশ হত্যার ঘটনায় সদস্যদের মধ্যে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে তা প্রশমনে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে জানতে চাইলে আইজিপি বলেন, পুলিশ এখন বেহাল দশায়।। যে সামর্থ্য ছিল তা এখন কাজ করছে না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে, আস্থার অভাব দেখা দিয়েছে, মানুষের কাছে ফিরে যাব, কাজ করব। ভয়ে, আতঙ্কে, সহকর্মীদের মৃত্যুতে, তারপর আবার দেখেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা হুকুম দিয়ে পালিয়েছেন। কোথাও কোনো এসপি, ডিআইজি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মারা যাননি! যারা মারা গেছেন তারা ইন্সপেক্টর থেকে কনস্টেবল। তার মানে আমরা অফিসাররা পুরো বাহিনীকে অনিরাপদ করে পালিয়ে গেছি। এখন বড় চ্যালেঞ্জ এই বাহিনীকে নতুন করে সজ্জিত করা।
৫ আগস্ট ও পরে পুলিশের হারানো অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে এক প্রশ্নে আইজিপি বলেন, প্রায় ছয় হাজার অস্ত্র লুট হয়েছে।। এর মধ্যে ১৫০০ অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি।
এসব অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চলছে বলে জানান তিনি। কিন্তু এগুলো সংরক্ষণ করা তখনই সম্ভব হবে যখন সকল মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারবে। তখন সমাজের মানুষ এসব অস্ত্র খুঁজবে।
এর আগে সারাদেশে নিরপরাধদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে আইজিপি বলেন, এরই মধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।। প্রতিটি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে প্রাথমিক তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে যাতে তাদের গ্রেফতার করা হবে না।। এছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই নিরপরাধ ব্যক্তিদের মামলা থেকে বাদ দিতে পারে।
ওইদিন দুপুরের পর সিলেট পুলিশ লাইনে পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন আইজিপি। তাদের কষ্টের কথা শোনেন। তিনি তাদের কষ্ট লাঘবের প্রতিশ্রুতি দেন।
