গণপ্রহরী রিপোর্ট : পুলিশ সপ্তাহের মতামতে পুলিশের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে বলে পুলিশ সপ্তাহ-২০২৫ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের অনেকের মতামতে বেরিয়ে এসেছে। এবং কারো কারো মতামতে-‘এবার যদি পুলিশ জনগণের বন্ধু হওয়ার পথে এগিয়ে যেতে পারে, তাহলে পুলিশের প্রতি বিরুপ হওয়া নয়, জনগণও বন্ধু হিসেবে বরণ করে নিবে পুলিশকে। যদিও এই উপমাহদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ পুলিশ সৃষ্টি করেছিল তাদের উপনিবেশিক শাসন-শোষণ ও তাদের হুকুম মেনে, শৃঙ্খলার সাথে জনগণকে চলতে বাধ্য করতে। এ জন্য পুলিশের আইন, তাদের পোশাক, হাতের লাঠি ও অস্ত্র বাধ্য করার প্রতিক হলেও, পুলিশের প্রতি নির্দেশনা ছিল পুলিশকে হতে হবে জনগণের বন্ধু। পুলিশ কতটা বন্ধু হতে পেরেছে জনগণের তাতো ২০২৫ সালের পুলিশ সপ্তাহের মতামত পুলিশের শুভবুদ্ধির উদয় শিরোনামই বলে দিচ্ছে। তারপরও সকলকেই আশাবাদ বিলম্বে হলেও পুলিশ হোক জনগণের বন্ধু ও আইনের সেবক।
২৯ এপ্রিল মঙ্গলবার রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে বাংলাদেশ পুলিশ অডিটরিয়ামে ‘আমার পুলিশ, আমার দেশ, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্য নিয়ে চারদিনের পুলিশ সপ্তাহের কর্মসূচি উদ্বোধন করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস। শুভবুদ্ধির উদয়ের দিকে নির্দেশনা বা আশাবাদের হেতু হচ্ছে- এবারই প্রথমবারের মতো পুলিশ সপ্তাহে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতাসহ ধর্মীয় নেতা ও সাংবাদিক নেতাদের সাথে পৃথক পৃথক বৈঠকের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, সেসবে জনগণের প্রত্যাশা নিয়ে আলোচনা হবে। দ্বিতীয়ত: পুলিশ পক্ষের মতামতে পতিত সরকার পুলিশকে দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করায় জনগণের সাথে দূরত্ব তৈরী হয়। যা, তারা চান না; তারা নিরপেক্ষ পুলিশের ভূমিকা পালন করতে চান। তাদের প্রকাশ করা মনোভাবকে ‘শুভবুদ্ধির উদয়’ বলতে কারো হয়তো আপত্তি থাকবে না। তবে অনেকেই হয়তো এ মুহুর্তে মন্তব্য করছেন- ‘গাছ তোর নাম কি ফলে পরিচয়’ প্রবাদটি।
তৃতীয়ত: পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে পেশাদারিত্বের সাথে পরিচালনার জন্য একটি ‘স্বতন্ত্র পুলিশ কমিশন’ গঠনের প্রস্তাব পেশ করেছেন।
এবার জানা যাক, পুলিশ সপ্তাহের মতামতে পুলিশের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে, যে মতামত উদ্বোধন অনুষ্ঠানে; সেই অনুষ্ঠানের উদ্বোধক ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস। ‘আমার পুলিশ, আমার দেশ, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্য বিষয়ক আলোচনায় তাঁর বক্তব্যে কি কি বলেছেন এবং অন্যান্যদের মধ্যে কারা বক্তব্য দিয়েছেন। শিরোনমের সাথেই ব্যবহৃত ছবি কথা বলছে, পুলিশ সপ্তাহ উদ্বোধনকালে পুলিশবাহিনীর নির্বাচিত সদস্যদের পদক পরিয়ে দিচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনুস বলেছেন, গত আগষ্টে অন্তর্বর্তী সরকার যখন দায়িত্ব গ্রহন করে, সে সময় এ দেশের আইনশৃঙ্খলা রখ্খাকারী বাহিনী ভঙ্গুর অবস্থায় ছিল।পুলিশের সাথে জনগণের দুরুত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। পরিস্থিতি উন্নতির জন্য যা কিছু প্রয়োজন, সরকার সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহন করেছে। তিনি বলেছেন, স্বৈরাচারী শাসনামলের ১৫ বছরে দেশের পুলিশকে দলীয় বাহিনীতে পরিণত করায়, সব ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে উল্লেখ করে ড. মুহাম্মদ ইউনুস বলেন, ‘স্বৈরাচারের অবৈধ অন্যায় আদেশ পালন করতে গিয়ে পুলিশ বাহিনী ব্যাপকভাবে জনরোষের মুখে পড়ে। অনেক সৎ পুলিশ সদস্যেরও এজন্য মাশুল দিতে হয়েছে। স্বৈরাচারী শাসনের অবৈধ আদেশ পালন করতে গিয়ে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা জনরোষের শিকার হয়েছেন। পুলিশ জনগণের বন্ধু। পুলিশ বাহিনীকে সে ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটা কঠিন। কঠিন হলেও এটাই ন্যায্য এবং এটাই আমাদের করতে হবে’।
প্রধান উপদেষ্টা পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছেন ‘মনে রাখবেন, কোনো ব্যক্তি যদি অন্যায় বা অনিয়মের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়, সেই ব্যক্তির দ্বারা ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। সুতরাং কারও দ্বারা ব্যবহৃত হবেন না। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ব্রত হিসেবে নির্বাচনে নিজেদের নিয়োজিত করবেন’।
তিনি বলেছেন আমি আগেও বলেছি, আমরা একটা যুদ্ধাবস্থায় আছি। অশুভ চক্র আমাদের স্বপ্নকে, আমাদের ঐক্যকে ভেঙে দিতে সব শক্তি নিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে। একে প্রতিহত করার জন্য আপনাদের সবসময় সতর্ক থাকতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন ‘ভবিষ্যতে কখনো যেন পুলিশ বাহিনীকে দলীয় বাহিনী বা অন্যায় কাজে ব্যবহার না করা যায়, সে জন্য একটি সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অত্যন্ত জরুরী। নির্বাচনের আগের এই সময়টা অনেক কঠিন। আপনাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে, পরাজিত শক্তি যেন কোনোভাবেই দেশকে অস্থিতিশীল করতে না পারে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস বলেছেন, পুলিশ মানুষের বন্ধু। পুলিশ বাহিনীকে সেই ইমেজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রথমবারের মতো এবার পুলিশ সপ্তাহে ধর্মীয় নেতা, সাংবাদিক ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে বলে আমি জানতে পেরেছি। এ বৈঠকে পুলিশের ওপর জনসাধারণের প্রত্যাশা নিয়ে আলোচনা হবে। আমার প্রত্যাশা হলো, এটি যেন চলমান থাকে। প্রতি বছর পুলিশ সপ্তাহে যেন এ ধরনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
পুলিশ সপ্তাহ-২০২৫ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে: জেনারেল(অব.) জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, সাধারণ মানুষ যেন কোনোরকম হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন এবং কারও কাছ থেকে কোনো বিশেষ সুবিধা নেওয়া যাবে না। ঘুষ, দুর্নীতি থেকে নিজেদের দূরে রাখতে হবে। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম।
মত বিনিময়কালে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে এএসপি আসাদ আলম ও ঢাকা জেলার পুলিশ কনস্টেবল সামিয়া স্বর্না তাদের যৌক্তিক মতামত ব্যক্ত করেছেন। তন্মধ্যে পুলিশ সংষ্কার কমিশন নিরপেক্ষ এবং প্রভাবমুক্ত পুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়ে নীতিগত একমত হলেও এ বিষয়ে কমিশন পূর্ণাঙ্গ কোনো রূপরেখা দেয়নি। একটি স্বতন্ত্র পুলিশ কমিশন গঠিত হলে পুলিশ সততা, নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ ও আস্থা অর্জনে সক্ষম হবে।
অন্যান্য প্রস্তাবের মধ্যে ছিল পুলিশের সব স্তরে ঝুঁকি ভাতা চালু করা, আবাসন সংকট নিরসন, ট্রেনিং একাডেমিতে ভাতা দেওয়া, নারী প্রশিক্ষণ সেন্টার বাড়ানো, পুলিশ সদস্য স্বামী-স্ত্রী হলে একই কর্মস্থলে পদায়ন এবং নারী ট্রাফিকের জন্য নারীবান্ধব টয়লেটের ব্যবস্থা। এ ছাড়া বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালে আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহসহ সার্বিক মান উন্নয়নের প্রস্তাব করা হয়।
গণপ্রহরীর মতামত:গণপ্রহরীর মতামত বলতে গণপ্রহরীর প্রধান সম্পাদক, মহান মুক্তিযুদ্ধের ১১ নং সেক্টরের ঐতিহাসিক রৌমারী মুক্তাঞ্চল ও প্রথম মুক্তিযোদ্বা বাহিনী গড়ার সংগঠক-ঘোষক ও সন্মুখ মুক্তিযোদ্বা, গাইবান্ধা ইউনিট কমান্ডের সাবেক কমান্ডার, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থার সাবেক মহাসচিব ও গাইবান্ধা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এসকে মজিদ মুকুল-‘পুলিশ সপ্তাহের মতামতে পুলিশের শুভবুদ্ধির উদয়’ শীর্ষক প্রতিবেদনে পুলিশ সপ্তাহ-২০২৫ প্রতিপাদ্য ‘আমার পুলিশ, আমার দেশ, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ’ এবং আলোচনা বেরিয়ে আসা মতামত প্রেক্ষিতে বলেছেন, ‘চঙখওঈঊ’ শব্দের প্রতিটি অক্ষর যে সকল শব্দ থেকে নিয়ে পুলিশ নামকরণ করা হয়েছে তার প্রতিটি অক্ষরের বাস্তবতা থাকবে প্রত্যেক পুলিশ সদস্যের ভূমিকায় ও কার্যক্রমে। তবেই পুলিশ হবে জনগণের বন্ধু। শব্দগুলো প্রতিটি যেহেতু ‘গুণাবলি’ সেহেতু এগুলোই জনগণকে উদ্বুদ্ধ করবে পুলিশকে জনগণের বন্ধু ভাবতে। তিনি পুলিশ সদস্যের পক্ষে উত্থাপিত প্রস্তাবের মধ্যে পুলিশের সব স্তরে ঝুঁকি ভাতার ব্যবস্থা, স্বামী-স্ত্রী একই কর্মস্থলে পদায়ন, বিবাহিত প্রার্থীদের এএসপি নিয়োগ না করা এবং অন্যান্য সরকারি চাকুরিজীবিরা যেমন বছরে ১২৯ দিন সরকারি ছুটি কাটান ও তাদের কর্মঘণ্টা থাকে। পুলিশের ক্ষেত্রে তা যেহেতু প্রযোজ্য নয়, সেহেতু তাদের উত্থাপিত প্রস্তাবের ১২৯ দিন ছুটির পরিবর্তে একমাসের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ ভাতা হিসেবে প্রদানের প্রস্তাব, নারী ট্রাফিকের জন্য নারী বান্ধব টয়লেটের ব্যবস্থা ও আবাসন সংকট নিরসন এবং বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসার সার্বিক মান উন্নয়ন ইত্যাদি প্রস্তাবাবলী বিবেচনার দাবি রাখে বলে মন্তব্য করেছেন।
আরও পড়ুন-মে দিবসে ‘গণপ্রহরী চুয়াল্লিশে’ ও আমাদের কথা
