Sun. Jul 13th, 2025
প্রকৃতি বিনাশে কি শৈল্পিক বাবুই হারাবেপ্রকৃতি বিনাশে কি শৈল্পিক বাবুই হারাবে

প্রকৃতি বিনাশে কি শৈল্পিক বাবুই হারাবে (?) আমাদের সুন্দর এই ভূবনে সুস্থ্য শরীরে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে, বৈচিত্রে ভরপুর সচল প্রকৃতি। চলমান নদী-নালা, বিল-হাওর, পাহাড়-গুহা, পশু-পাখি ও গাছপালা প্রভৃতি রক্ষা জীব-বৈচিত্রের নিরাপদ জীবন-জীবিকার জন্য প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষায় অত্যাবশ্যকীয় শর্ত। অথচ বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থায় পরিচালিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার কথিত উন্নয়নের নামে দেশ, সমাজ ও জনগণের কল্যাণে প্রকৃতি বিনাশ প্রক্রিয়া চলমান। এতে প্রকৃতির লীলা খেলার নিপুন কারুকার্যময় শিল্পকর্মের ‘বাবুই পাখির’ বাসাও সচারচর চোখে পড়েনা (!)

আঠারো কোটির বেশি মানুষের এই দেশে আঠারো হাজার বা তার কিছু কম বা বেশি নানা বয়সের মানুষ গ্রামে যায়নি বা যায়না এবং ছবি দেখেও বোঝেনা, এমন হতে পারে। সারা দেশের সকল শ্রেনি পেশার মানুষ হয়তো অস্বীকার করতে পারবেন না যে, বাবুই পাখি ও তার নিপুন শিল্পকমের্র বাসা দেখেননি। এ পাখি প্রকৃতি দাবড়ে বেড়ানোর পাশাপাশি শৈল্পিক বাসা বুনানোতে (বুনন) বাবুই পাখির তুলনা হয় না বা তার জুড়ি নেই। কালের বিবর্তনে বা পরিবর্তিত পরিবেশে তালপাতায় মোড়ানো শৈল্পিক বাসা বানানোর নিখুঁত কারিগর খ্যাত বাবুই পাখি হারাতে বসেছে। তাইতো, প্রকৃতি পরিবেশের সৌন্দর্যপ্রিয় মানুষের মনে প্রশ্ন জেগেছে প্রকৃতি বিনাশে কি শৈল্পিক বাবুই পাখি হারাবে (!)

 শৈশবে গাইবান্ধা শহরস্থ আমাদের পৈত্রিক বাসা ও বাসা সংলগ্ন পশ্চিমপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিছনের খেজুর গাছসহ বিভিন্ন স্থানে খেজুর গাছে বাবুই পাখির বাসা দেখেছি। আবার নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার চিলাহাটি খ্যাত ভোগডাবুরির বাড়ীর নিকটবর্তী জমিতে উচু তালগাছে বাসা দেখেছি এবং এই পাখির কিচিরমিচিরও শব্দ শুনতে মাঝে মাঝে তালগাছের কাছে যেতাম। যাওয়ার সময় কবি রজনীকান্ত সেনের কালজয়ী ছড়া কবিতার এক-দু’ লাইন বলতে বলতে যেতাম। কবি লিখেছেন-‘বাবুই পাখিকে ডাকি বলিছে চড়াই কুড়ে ঘরে থাকি করো শিল্পের বড়াই আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে তুমি কত কষ্ট পাও রোদ বৃষ্টি ঝড়ে’।

প্রকৃতির কারিগর বাবুই পাখি যেন আমাদের দেশসহ বিশ্বেরই প্রকৌশলী-প্রযুক্তিবিদদের নকসা মতে গড়ে তোলা রং-বেরংয়ের নানা সাইজের বড় বড় অট্টালিকার সাথে প্রতিযোগিতা করে। এবং সে প্রতিযোগীতায় বিজয়ী বেশেই উচু তালগাছে নিপুন কারুকর্মের বাসা বুনিয়ে আনন্দে দোল খাবে। যা, প্রকৃতির এক অপূর্ব অংশ হিসেবে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে বিবেচনার দাবি রেখে আসছে।

কেনইবা তা নয়? প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহ ঝড়ো বাতাস, ঝড়-ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষায় পাকা দালান গৃহের চেয়ে যেন শক্তপোক্ত করে তৈরি করা এই পাখির বাসা। ভিতরে কুঠরি রয়েছে ডিম রাখার জন্য। একইভাবে প্রয়োজনীয় আলো-বাতাস চলাচলেরও ব্যবস্থা থাকে সে বাসাগুলোতে। উঁচু তালগাছ, নারিকেল ও খেজুর গাছে তাদের বাসা তৈরীর প্রাধান্য দিয়ে থাকে। ফসলের ক্ষেত ও বন জঙ্গলের কাছাকাছি এ সব গাছকে যেন বেশি গুরুত্ব দিতো। কীট পতঙ্গ ও শস্যদানা  ইত্যাদি বাবুই পাখির প্রধান খাদ্য।

প্রকৃতি বিনাশী উন্নয়ন কাজের নামে প্রকৃতি পরিবেশের অপরিহার্য শর্তের গাছপালা-নদীনালা  কৃষিজমি, হাওর-বিল যেমন ধ্বংস হচ্ছে। তেমনি গাছপালার মধ্যে উচু তাঁল, নারিকেল ও খেজুর গাছও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ভেঙ্গেচুড়ে বা মূল্যৎপাটন হওয়ায় উঁচু এসব গাছ দ্রুত কমে যাচ্ছে। তাতে বাবুই পাখিসহ অন্যান্য পাখিরও বাসা বাঁধা ও আশ্রয় নেয়ার সংকটে সব পাখি। এতে পাখিও বিলুপ্তির দিকে। সেদিক থেকে জনমনে উত্থাপিত প্রকৃতি বিনাশে কি শৈল্পিক বাবুই হারাবে-তা বাস্তব হতে যাচ্ছে। যদিও প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষায় রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং তা নিলে এখনও অনেকটা রক্ষার সম্ভাবনা রয়েছে।

সাহিত্য ও সমাজ কল্যাণ সংসদের ‘আন্তর্জাতিক স্বাধীন বাংলা’য় ছড়া-কবিতার আসরের কবি মনোয়ারা পারভীন ‘শৈল্পিক পাখি’ শিরোনামে লিখেছেন-‘বাবুই পাখি নামে তোমায় আমরা সবে ডাকি/ শৈল্পিক জ্ঞানে তুমি যে এক অসাধারণ পাখি।/ কত সুন্দর বাসা বুনো তাল গাছেতে ঝোলে তাই না দেখে মনুষ্য মন আনন্দেতে দোলে।/ ঝড় তুফানে ভরসা এই অনেক শ্রমের বাসা/ খড়-কুটোতে গড়া তোমার দারুণভাবে খাসা।/ একটুখানি বাতাস এলে হেলেদুলে চলে/ সেসব দেখে কবির হৃদয় কত কথা বলে’…..।

পরিশেষে, একাধিক প্রকৃতি প্রেমি-ব্রাহ্মনবাড়িয়ার আখাউড়া প্রকৃতি ও পরিবেশ ক্লাবের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আকছির এম চৌধুরী গণমাধ্যমকে প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে শিল্পমনা বাবুই পাখি নিয়ে জানিয়েছেন, এই পাখির কিচিরমিচির শব্দ এবং তার শৈল্পিক বাসা তৈরি মানুষকে আনন্দিত করতো। তিনি প্রকৃতির কারিগর বাবুই পাখি ও তার শৈল্পিক নিদর্শন রক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন।

কিশোরগঞ্জের তড়াইল থেকে মাহবুর রহমান, প্রকৃতির কারিগর বাবুই পাখির বাসা নিয়ে বলেছেন, উপজেলার গ্রামগঞ্জে তালগাছে এই পাখির বাসায় ভরা ছিল এবং সর্বদা বাবুই পাখির কলতানে মুখরিত থাকতো বিভিন্ন গ্রাম। এমনকি বাংলার মাঠ-ঘাট গ্রাম বাংলায় তালগাছের পাতায় ঝুলন্ত বাবুই পাখির বাসা ছিল নিত্য সঙ্গী, যা আজ হারিয়ে যাচ্ছে।

অলিউর রহমান ফিরোজ বলেছেন, বাবুই পাখির বাসা বুননের শিল্পকর্ম যেমন ভাবিয়ে তোলে, তেমনি দেখতে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে এসেছে ‘শিল্পী বাবুই’। বাবুই পাখির বুননো বাসার সৌন্দর্যে মেয়ে সঙ্গিনী মুগ্ধ হয়ে সংসার পাতে এবং মনের আনন্দে তারা শৈল্পিক বাসা বোনে। তার মতে, ১১৭ প্রজাতির বাবুই পাখি আছে পৃথিবীতে।

প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ড. জুয়েল গণমাধ্যমকে বলেছেন, পরিবেশ ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে অনেক প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে। অসংখ্য প্রজাতির পশু-পাখি ও কীটপতঙ্গ বিলূপ্ত হয়েছে পরিবেশ থেকে এবং বিলুপ্ত হতেও যাচ্ছে অনেক প্রজাতি। জীববৈচিত্রের স্বার্থে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাচ্ছে প্রকৃতি পরিবেশ রক্ষায়।

আরও পড়ুন- পাখির নাম সাত ভায়লা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *