প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ নিয়ে আমাদের কথা। রক্তার্জিত সফল গণঅভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুসের প্রতি পুনরায় আন্তর্জাতিক সমর্থন প্রাপ্তিতে প্রধান উপদেষ্টাকে অভিনন্দন তাঁর জ্ঞানগর্ব ও আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়যোগ্য বক্তব্যের জন্য। শান্তিতে নোবলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে ভাষণদানকালে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নেতারা উপস্থিত থাকার এমন বিরল ঘটনা ইতিহাসে উদাহরণ হয়ে থাকবে। কেননা, রাজনৈতিক নেতাদের উপস্থিতির ঘটনা বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সামনে জাতীয় ঐক্যেরই স্বাক্ষ্য। জাতিসংঘের এই অধিবেশনে বিশ্বের ১১ রাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী অধ্যাপক ইউনুস সরকারের প্রতি দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করে, বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে প্রয়োজনীয় সহযোগীতা ও পরামর্শদানের প্রতিশ্রুতিও দেন। যা চলমান বিশ্বব্যবস্থায় ড. ইউনুস নেতৃত্বাধীন সরকারের কূটনৈতিক দক্ষতার স্বাক্ষ্য যেমন বহন করে তেমনি রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে তাঁর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি যে গুরুত্ববহ তারও প্রকাশ ঘটায়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ছাত্র জনতার সফল গণঅভ্যূত্থানের কয়েক সপ্তাহ পরই অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ৭৯তম অধিবেশনেও প্রদত্ত ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনুস নিজে শুধু প্রশংসিত হননি। তিনি তাঁর গুরুত্ববহ বক্তব্যে বিশেষত: তরুণ সমাজের অফুরান শক্তি কিভাবে বাংলাদেশের গণমানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে, সে সময়ে বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোর আমুল পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে সামনে নিয়ে এসেছে, তা তুলে ধরে দেশবাসীকেও প্রশংসিত করেছেন। আর এবারের ৮০তম অধিবেশনে সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় ঐক্যবদ্ধ জনগণের উপর নির্ভর করে কতটা সফল হয়েছে তাঁর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরেছেন।
জাতিসংঘের প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ নিয়ে আমাদের কথা শীর্ষক নিয়মিত সম্পাদকীয় কলামের এ পর্যায়ে আলোচ্য যে, শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থনকারী সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রিস, বেলজিয়াম, ক্রোয়োশিয়া, স্লোভেনিয়া, লাটাভিয়া, মরিশাস, বুলগেরিয়া, বসনিয়া, হার্জে গোভিনার সাবেক নেতারা রয়েছেন। তাঁদেরকে গণপ্রহরী পক্ষে অভিনন্দন এবং তাঁদের মাধ্যমে অধিবেশনে অংশগ্রহনকারী বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বকারী সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার শীর্ষ নেতৃত্বের সাথে বিভিন্ন সময়ে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে আন্তরিক পরিবেশে আলোচনার মাধ্যমে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের গ্রহনযোগ্যতা যে হারে বাড়িয়ে চলছেন, তা জাতির জন্য অবশ্যই গৌরবের। বিশ্ব পরিস্থিতি ও সময়কাল বিবেচনায় বাংলাদশের ইতিহাসে রাষ্ট্র প্রধানদের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য সরকার প্রধান হিসেবে বিবেচিত হবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। এতদসঙ্গে আরও উল্লেখ্য, প্রধান উপদেষ্টা তাঁর প্রশংসিত বক্তব্যে সরকারের গৃহীত নানা পদক্ষেপ ও সংষ্কার উদ্যোগ এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সমস্যাসহ জলবায়ু সংকট, বানিজ্যযুদ্ধ, রোহিঙ্গা সংকট ও গাজা যুদ্ধ নিয়ে কথা বলেন। সেই সাথে তাঁর বক্তব্যে উল্লেখিত সমস্যা-সংকট থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে করণীয় উপায় নিয়েও পরামর্শ মূলক জ্ঞানগর্ব যৌক্তিকতা তুলে ধরেন।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুস জাতিসংঘের ৮০তম অধিবেশনে দৃঢ়তার সাথে যৌক্তিকতা তুলে ধরে তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ থেকে বিভিন্ন উন্নত দেশে পাচার করাকে একটি বড় আন্তর্জাতিক সমস্যা বলে চিহ্নিত করে অধিবেশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে পাচার করা সম্পদ যে সব দেশ ও প্রতিষ্ঠানে গচ্ছিত আছে সে অর্থ এদেশের মানুষের। তিনি পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এবং বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশ থেকে সম্পদ পাচাররোধে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনুস কঠোর আন্তর্জাতিক বিধিবিধান প্রণয়নের যৌক্তিক প্রস্তাবাবলি বাস্তবায়নে জোরালোভাবে বাংলাদশের কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত গতিতে চালিয়ে যাওয়া আবশ্যক। এরই মধ্যে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালাহউদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে পাওয়া শুরু হতে পারে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রত্যাশা আর যেন বাংলাদেশে স্বৈরাচারের আর্বিভাব না ঘটে। প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘের মতো সর্বোচ্চ বৈশ্বিক ফোরামে দাঁড়িয়ে প্রদত্ত বক্তব্যে নাগরিক প্রত্যাশা দুটো বিষয়ে দৃঢ়তার সাথে ব্যক্ত করেছেন যে, তিনি মনে করেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে যে দলই জনগণের সমর্থন পাক বা নির্বাচিত হোন, সংষ্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তার কোনো অবকাশ থাকবে না। তিনি আরও মনে করেন, জুলাই অভ্যূত্থানে অংশগ্রহনকারী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে দলগুলোর আলোচনা-পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে সংষ্কার প্রশ্নে যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তাতে সংষ্কার বাস্তবায়ন করাটা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান দায়িত্ব হিসেবে পর্যবসিত হবে। দ্বিতীয়ত, ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, এ নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই।
নিয়মিত সম্পাদকীয় কলামের আমাদের কথায় সম্মানিত পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ পূর্বক উল্লেখ্য, পাঠকবৃন্দ অবগত যে, ড. ইউনুস নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই প্রতিবেশী দেশের উগ্রহিন্দুত্ববাদী-মৌলবাদী সরকারের ছত্রছায়ায় থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদপুষ্ট পতিত স্বৈরাচার সরকার ও তার দোসররা দেশের অভ্যন্তরে ও বাহির থেকে সরকারকে ব্যর্থ করার অপপ্রচার ও অপতৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন। অর্থাৎ অধ্যাপক ইউনুসের নেতৃত্বকে আঞ্চলিক শক্তিধর দেশটির গাত্রদহের কারণে পরিণত হয়েছে। ফলে ঘরে-বাইরে নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই সরকারকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে প্রতিটি মুহুর্ত। যে সকল চ্যালেঞ্জ শুধু সম্ভাব্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্থই করছে না; স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তাকেও হুমকির সম্মুখীন করছে। এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংষ্কৃতিক সংগঠন সমূহকে তথা দলমত নির্বিশেষে সকল দেশ প্রেমিক শক্তি ও ব্যক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকারের পাশে থাকতে হবে। যাতে গণতান্ত্রিক সরকার গঠনে নির্বাচন বাধাগ্রস্থ না হয়। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ঐকমত্যে জনগণের গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের পর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দলীয় কর্মসূচি ভিত্তিতে জনমত সৃষ্টির মধ্য দিয়ে পরবর্তীতে গণরায় নিয়ে নিজেদের মতো করে রাষ্ট্র পরিচালনায় মনোযোগী হবেন। এ মুহুর্তে প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক গ্রহনযোগ্যতাকে মূল্যায়ন ও বাস্তবমুখী রাজনৈতিক দলসমূহকে ঐক্যবদ্ধভাবেই নির্বাচন সম্পন্ন করার ভূমিকা পালন করতে হবে, যা জনগণের কাম্য। অন্যথায় দেশী-বিদেশী অপতৎপরতায় দেশবাসীকেই খেসারত দিতে হবে। যা কারো কাম্য নয় বলেই আমরা মনে করি।
জাতিসংঘের অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবলজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনুস বিশ্বনেতাদের রাখাইনের দীর্ঘদিনের সমস্যাগুলোর রাজনৈতিক সমাধানের উপর গুরুত্বারোপ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদাসীনতায় বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকট ও বিস্তৃতিতে বাংলাদেশ ভুক্তভোগী হয়েছে তা অধিবেশনে পরিষ্কার করে তুলে ধরেছেন। তিনি মানবিক দিক বিবেচনা করে নতুন দাতাদের অনুদান প্রদানের আহ্বান জানিয়ে বিদ্যমান তহবিল সংকট রোহিঙ্গা শিবিরে নিরাপত্তা ঝুঁকি ও সংকট বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা তুলে ধরে সাহায্যদানকারী দাতাদেরও সাহায্য বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
নির্বাচন ও সংষ্কার নিয়ে স্পষ্ট বার্তা বিশ্ব নেতাদের কাছে পৌঁছে দিতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে উল্লেখ করেছেন, সফল জুলাই গণঅভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকার হিসেবে নির্বাহী আদেশের মতো সহজ পথে না গিয়ে, টেকসই ব্যবস্থার লক্ষ্য সংষ্কার প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে সংষ্কার প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাচ্ছেন। এই প্রক্রিয়ায় সংষ্কার কার্যক্রম সমাধানে গঠিত ১১টি কমিশন তাদের গৃহীত প্রস্তাব নিয়ে ৩২টি রাজনৈতিক দলের সাথে ঐকমত্য কমিশনের সংষ্কার ও ঐক্য প্রচেষ্টা আলোচনা পর্যালোচনার মতো গঠনমুলক পন্থায় এগিয়ে যাচ্ছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে ঐকমত্য না হওয়ায় সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, জুলাই সনদের বিষয়টি গণভোটে ন্যাস্ত করতে ঐকমত্যে পৌঁছেছে সকল দল। আমরা মনে করি আলোচনা-সমালোচনা ও পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছা সম্ভব। রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় সংকট সমাধানে এই প্রক্রিয়া অব্যাবহত রাখবেন বলে আমরা আশা করি। সেই সাথে প্রসঙ্গত ঐকমত্যে পৌঁছার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী নেতৃবৃন্দ এবং ঐকমত্য কমিশনের সম্মানিত সদস্যবৃন্দকেও অভিনন্দন।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ নিয়ে আমাদের কথা শিরোনামের সম্পাদকীয় কলামের এ পর্যায়ে উল্লেখ করতে চাই ‘গণপ্রহরী’ বার বার শান্তিকামি বিশ্ববাসী ও জাতিসংঘের দৃষ্টি আকর্ষণে লিখেছে-‘ফিলিস্তিনীদের নিজস্ব স্বাধীন ভূখন্ডই জায়েনবাদী ইহুদীদের গণহত্যার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। এবং এজন্য শুধু মুসলমানের ঐক্য নয় প্রয়োজন ফিলিস্তিনীবাসী মুসলমান, খ্রিষ্টান ও ইহুদীসহ সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের ঐক্য। এবং একইভাবে বিশ্বাবাসীর ঐক্য’। আজকে সারা বিশ্বের মানুষ গণহত্যাকারী ইহুদীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। জাতিসংঘের অধিবেশনে ভাষণদানকারী প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সামাধানই ফিলিস্তিন সমস্যার একমাত্র সমাধান উল্লেখ করে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র এখনই গঠনের প্রতি বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেন। আমাদের বিশ্বাস থেকে চাওয়া-বিশ্ব নেতৃবৃন্দের বাংলাদেশ পক্ষে অধ্যাপক ড. ইউনুসের যুক্তযুক্তি বক্তব্য বিবেচনায় নিয়ে জাতিসংঘের মাধ্যমে প্রস্তাব বাস্তবায়নে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করবেন। যদিও জাতিসংঘ অধিবেশনে গণহত্যাকারী সাম্রাজ্যবাদী ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বক্তব্যের জন্য উঠতেই অধিকাংশ নেতৃবৃন্দ অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করার মধ্য দিয়ে নেতানিয়াহুকে প্রত্যাখান করেন। কক্ষে থাকা বাকী সদস্যরা কক্ষ ত্যাগকারী নেতৃবৃন্দকে হাততালি দিয়ে তাঁদের সিদ্ধান্তকে স্বাগতও জানিয়েছেন।- সম্পাদক, ফাতেমা মজিদ জুঁই
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ
