প্রতিবেদক : বটেশ্বর-ওয়ারী বাংলার প্রাচীন জনপদ। বাংলাদেশের প্রচীন জনপদ কোনটি এ নিয়ে তর্ত-বিতর্ক পুরনো। কারো কারো মতে বগুড়ার মহাস্থানগড় ও কৃমিল্লার ময়নামতিই ছিল দেশের সবচেয়ে প্রাচীন জনপদ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নরসিংদীর বেলাব উপজেলার ওয়ারী এবং বটেশ্বর গ্রামকেই সবচেয়ে প্রাচীন জনপদ হিসেবে ধারণা করছেন প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক ও বিশ্লেষকরা।
ঢাকা থেকে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দূরে বটেশ্বর গ্রামের খানিক পশ্চিমে বেশ কবছর আগে মাটি খনন করার সময় অনেক দিনের পুরনো দালানকোঠা ধ্বংসাবশেষের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেই সঙ্গে মিলেছে হরেক রকম প্রত্নতাত্ত্বিক দ্রব্য। ওয়ারী গ্রামেও মিলেছে প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক। এসবের আকার-আঙ্গিক দেখে বোঝা যাচ্ছে, সবকিছুই সুপ্রাচীন রাজবাড়ির অংশবিশেষ। এ ব্যাপারে স্থানীয় নাগরিক মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ পাঠান দেশের বিশিষ্ঠ প্রত্নতাত্ত্বিকবিদদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি তাদের দৃষ্টিতে আনেন। তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী ড. এমাজদ্দীনের নেতৃত্বে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের ছ’জনের একটি প্রতিনিধি দল দু’বছর ধরে বটেশ্বর এবং ওয়ারী গ্রামে প্রত্নতাত্ত্বিক পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে আসছে। তারা মাটি খুঁড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিসপত্র খুঁজে বের করছেন। এই গবেষকদের বদ্ধমূল ধারণা, এটি প্রাচীন সভ্যতা হরপ্পা মহেঞ্জোদারোর কাছাকাছি সভ্যতার নিদর্শন হতে পারে। যা বগুড়ার মহাস্থানগড় এবং কুমিল্লার ময়নামতির চেয়েও প্রাচীন জনপদ। বটেশ্বর-ওয়ারী গ্রামে আরও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি আছে।
আরও পড়ুন – মোবাইল বা কম্পিউটার নিয়ে কি ব্যস্ত আপনার সন্তান
বটেশ্বর গ্রামের শেষ সীমানা থেকে শুরু করে রাজারবাগ-আমলাব গ্রাম হয়ে স্থানীয় আড়িয়ালখাঁ নদী পর্যন্ত একটি উঁচু পাহাড়ি গড় আজও পুরনো আমলের নিদর্শনের প্রমাণ দিচ্ছে। এ জনপদে বসবাসরত বিফথুন নামের এক রাজা তার মায়ের আদেশে এক রাতের মধ্যে এই গড়টি নির্মাণ করেছিলেন বলে ব্যাপক জনশ্রুতি আছে। গড়টি এখনও অসম রাজার গড় হিসেবেই পরিচিত। আর বিফথুন রাজাই ইতিহাসখ্যাত অসম রাজা। ওয়ারী বটেশ্বর গ্রাম দু’টোর চারদিকে খাল। বহিঃশত্রুর কবল থেকে অসম রাজার প্রাসাদ রক্ষার জন্যই গ্রাম দু’টোর চারদিকে খাল খননের মাধ্যমে পরিখা তৈরি করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওয়ারী গ্রামটি ছিল প্রাচীন নৌ-বন্দর। ব্যবসা -বাণিজ্যের প্রয়োজনে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে বণিকরা আসত। পরিখা খননের মাধ্যমে তাদের নিরাপত্তাও অনেকাংশে নিশ্চিত করা হতো বলে স্থানীয় নাগরিকদের বন্ধমূল বিশ্বাস।
এদিকে ওয়ারী, বটেশ্বর ও রাজারবাগ গ্রামে মাটি খননকালে পাওয়া গেছে হাত কুঠার, লোহার বল্লম, ধনুকের গোলক, পাথরের তৈরি ধারালো ছুরি, দা, হাতুড়ি এবং শিলপাটাসহ আরও অনেক কিছু। ওয়ারী এবং বটেশ্বরে পাওয়া গেছে দুর্লভ নকশি প্রস্তর গুটিকার মালা। স্থানীয় মানুষজন এ প্রস্তর গুটিকাকে সোলেমানী পাথর হিসেবে মনে করেন। নাম করণের নিদর্শন পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন – পাখির নাম সাত ভায়লা
রাজা-বাদশাদের বিহারস্থল ছিল বলেই স্থানীয় এলাকা রাজারবাগ ও রাজাবাড়িয়ার নাম হয়েছে। আমলাবদের আবাস ছিল বলেই গ্রামের নাম হয়েছে আমলাব। উজিলাব গ্রামে বাস করত উজিলাব। বাদ্যকররা বসবাস করত বাজনাব গ্রামে। এদিকে বটেশ্বর গ্রামে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলা প্রচীন প্রত্নতাত্ত্বিক দ্রব্যাদি সংগ্রহ করার উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রাহক, গবেষক, সাহিত্যিক হানিফ পাঠান এই সংগ্রহশালকে সমৃদ্ধ করেছেন।
তার অবর্তমানে তারই সন্তান হাবিব উল্লাহ পাঠান সযত্নে লালন করছেন প্রাচীন নিদর্শনসমৃদ্ধ এ সংগ্রহশালাটি।
এ সংগ্রহশালায় আছে খ্রিস্টপূর্ব দু’ হাজার থেকে বারশ’ সালের নব্য প্রস্তর যুগের পাথরের ছুরি, খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার বছর আগের লোহার বল্লম, পাথরের দু’ধারী কুঠার, পাথরে খোদাই করা লকেট, আর্য আমলের লোহার কুটার, বিশ কেজি ওজনের লোহার হাতুড়ি, ছোট আকৃতির লোহার কুঠার, ধনুকের গোলক, পোড়া মাটির শিবলিঙ্গ, নকশি প্রস্তর বুটিকা (সোলেমানী পাথর) ধাতব মুদ্রা, ১৯৩৩ সালের রৌপ্যমুদ্রা, ইসলাম শাহ ও বাহদুর শাহের রৌপ্যমুদ্রা, বাদশাহ আকবরের ব্রোঞ্জ মুদ্রা, গিয়াস উদ্দিন জালার শাহের রৌপ্য মুদ্রা, বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলমের ব্রোঞ্জ, রৌপ্য ও তাম্র মুদ্র। এছাড়াও আছে ক্ষুদ্র কোরআন শরীফ, প্রাচীন গীত কবিতার পান্ডুলিপি ডাকটিকিট এবং বিভিন্ন পুরনো সংবাদপত্র। এ সবকিছুতেই প্রাচীন সভ্যতার প্রমান মেলে।
