Fri. Sep 5th, 2025
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত

ওবায়েদ : বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত। বাংলাদেশের রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থায় ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে নানা উত্থান-পতন, সামরিক শাসন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং নির্বাচন-ভিত্তিক সরকার গঠনের চর্চা চলেছে। ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার পর আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি হলেও, সময়ের সাথে সাথে রাজনৈতিক সংকট, দলীয়করণ, প্রশাসনিক অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে জনগণের আস্থা কমেছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতিতে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে — 

বাংলাদেশ বর্তমানে সংসদীয় শাসনব্যবস্থার আওতায় পরিচালিত। এখানে প্রধানমন্ত্রী প্রধান নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। রাষ্ট্রপতি মূলত আনুষ্ঠানিক ও প্রতীকী ভূমিকা পালন করেন। সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন হয়। তবে দীর্ঘদিন ধরে এককেন্দ্রিক ক্ষমতার বলয়, নির্বাচন ব্যবস্থার দুর্বলতা, প্রশাসনের দলীয়করণ এবং বিরোধীদলের কার্যকর ভূমিকার অভাব শাসনব্যবস্থাকে দুর্বল করে তুলেছে।

কেন শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার? একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশ দ্রুত অর্থনৈতিক অগ্রগতির মধ্য দিয়ে গেলেও গণতান্ত্রিক চর্চা, মানবাধিকার, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় পিছিয়ে রয়েছে। দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বে মর্যাদা ধরে রাখতে একটি আধুনিক, দায়বদ্ধ এবং অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা অপরিহার্য।

কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা : অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও শক্তিশালী করা। সেনা মোতায়েনসহ নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকারের বিকল্প ব্যবস্থা বিবেচনা করা যেতে পারে।

ক্ষমতার ভারসাম্য ও বিকেন্দ্রীকরণ ক্ষেত্রে সংসদ, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করতে হবে। এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা ভেঙে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা দেওয়া। জেলা, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ বাড়ানো।

বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা বিচারকদের নিয়োগ ও পদোন্নতিতে দলীয়করণ দূর করা। হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের কার্যক্রম নিরপেক্ষভাবে পরিচালনার জন্য স্বতন্ত্র কমিশন গঠন। মামলা নিষ্পত্তি ও বিচারিক কার্যক্রম দ্রুততর করা।

গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা -স্বাধীন সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ মতপ্রকাশ নিয়ন্ত্রণমূলক আইন সংস্কার। তথ্য অধিকার আইন কার্যকর করে সরকারি তথ্য জনগণের নাগালের মধ্যে আনা।

দুর্নীতি প্রতিরোধ ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ-দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ। বড় বড় দুর্নীতির মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি ও অভিযুক্তদের শাস্তি নিশ্চিত। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আয়ের স্বচ্ছতা ও হিসাব-নিকাশ জনসম্মুখে প্রকাশ।

দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা ও অংশীদারিত্বভিত্তিক শাসন- ২০৩৫ ও ২০৫০ সালের বাংলাদেশ কেমন হবে, তার রূপরেখা প্রণয়ন। রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, পেশাজীবী সংগঠন ও তরুণদের অংশগ্রহণে নীতিনির্ধারণ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও পরিবেশ বিষয়ে স্থায়ী নীতি গ্রহণ।

বিকল্প শাসন কাঠামোর প্রস্তাবনা- মিশ্র শাসনব্যবস্থা (Parliamentary-Presidential Hybrid System) যেখানে রাষ্ট্রপতির হাতে নিরপেক্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু ক্ষমতা থাকবে (নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ), আর প্রধানমন্ত্রী সরকারের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।

স্থানীয় স্বশাসন ব্যবস্থা সকল জেলা-উপজেলা এবং সিটি কর্পোরেশনকে স্বায়ত্তশাসিত বাজেট ও প্রশাসনিক ক্ষমতা দেওয়া হবে।

পরিশেষে বাংলাদেশের রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই চ্যালেঞ্জের মুখে। ২০২৪ পরবর্তী সময়ে গণতন্ত্র, সুশাসন এবং মানবাধিকারের প্রশ্নে জনগণের প্রত্যাশা আরও বেড়েছে। তাই বর্তমান শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা কাটিয়ে কার্যকর, জবাবদিহিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক একটি নতুন শাসন কাঠামো প্রণয়ন সময়ের দাবি। এ জন্য শুধু রাজনৈতিক দল নয়, সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে প্রয়োজন শান্তি, ন্যায়বিচার, সুশাসন এবং গণতন্ত্রের অপরিহার্য ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে নতুন এক বাংলাদেশ গড়ে তোলা। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলাতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকেও নিজেদের ভেতর গণতান্ত্রিক চর্চা, নেতৃত্ব বিকাশ এবং দায়বদ্ধতা বাড়াতে হবে। অন্যথায় কাঠামো পরিবর্তন হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।

আরও পড়ুন – মুই হনু কামলা পাই ভাত এক গামলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *