Thu. Jul 10th, 2025
বাংলা নববর্ষ : সেকাল ও একাল

বাংলা নববর্ষ : সেকাল ও একাল। বাংলা নববর্ষ আমরা এখন যেভাবে মহাসমারোহে উদযাপন করি, আগেকার দিনে এ দিনটিকে এমন উৎসবমুখর পরিবেশে বরণ করা হতো না। বাংলায় এটি ছিল প্রধানত ব্যবসায়ীদের হালখাতা উৎসব যা আজো আছে। পহেলা বৈশাখের আগে দোকানিরা দোকানের মালামাল সব বের করে দেকানঘর ঝেড়েমুছে ধুয়ে নতুন করে সাজায়।

বাংলা নববর্ষ : ফজলুল করিম
ফজলুল করিম

ব্যবসা-বাণিজ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের আধিক্য ও প্রাধান্য ছিল। তাই তারা নতুন করে দোকান সাজাতে কিছু আচার-অনুষ্ঠানের আশ্রয় নিত। ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষী’ এ স্লোগান প্রায় সব হিন্দু দোকানে লক্ষ করা যেত। তাই ধনের দেবী লক্ষী যেখানে বিরাজমান, সেখানে শুচিতা অবশ্যই বিরাজ করবে। প্রতিটি হিন্দুর দোকানে প্রবেশদ্বারে এদিন শোলার তৈরী কদমফুল ঝুলিয়ে দেয়া হতো। নতুন বছরের জন্য নতুন হিসাবের খাতা সব দোকানে দেখা যেত। লাল কাপড় দিয়ে বাঁধাই করা এসব খাতাপত্র দফতরিরা সরবরাহ করত। হিন্দু ব্যবসায়ীরা সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে নতুন হালখাতার প্রবর্তন করত। বড় বড় মহাজনদের দোকানে লালসালু কাপড়ের বাঁধাই করা খাতায় নতুন করে হিসাব লেখা হতো।

বর্তমানে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা শহর ও অন্যান্য শহরে বাংলা নববর্ষ একটা জাতীয় উৎসবের বেশ ধারণ করেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ দিনটি সরকারি ছুটি হিসেবে পালিত হচ্ছে। রাজধানী উৎসবের আনন্দে জ¦লজ¦ল করতে থাকে। তার বিপরীতে গ্রামের সেই সহজ-সরল উৎসব-পার্বণের ছবিটি আজ হারিয়ে গেছে।

আরও পড়ুন- কৃষিকে কেন্দ্র করেই পহেলা বৈশাখ

আমার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে গ্রামে। সম্পূর্ণ গ্রামীন পরিবেশে বেড়ে উঠেছি। তাই জীবনে যতবারই পহেলা বৈশাখ আসে, মনে পড়ে গ্রামের চৈত্র পরবের মেলার কথা। আমদের বাড়ির সামনে একটি প্রাচীন বাজার আছে। কিছু স্থায়ী দোকানপাট ছাড়াও বেশ কিছু সংখ্যক ছোট ছোট ছাপড়া ঘর ছিল। এখানে সপ্তাহে দু’দিন হাট বসত। আমাদের এই হাটে পহেলা বৈশাখ পরবের মেলা বসত। এই মেলার দিনটির জন্য আমরা যারা ছোট তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। মেলার আনন্দ-উৎসব ছাড়াও আরেকটি আকর্ষণ ছিল আমাদের। চৈত্র মাস না যাওয়া পর্যন্ত আমাদের কাঁচা আম খেতে দিত না বড়রা। এ ব্যাপারে কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিল। বলা হতো, চৈত্র মাস না গেলে আমের বিউ যায় না। এই বিঁউ না গেলে কাঁচা আমে প্রচন্ড পেট ব্যাথা হয়। এমনিভাবে বড়রা আমাদের ভয় দেখাতেন। তাই পহেলা বৈশাখের দিনটির জন্য আমরা আকুল আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম। কারণ বৈশাখ এলেই আর আম খাওয়ায় কোনো বাধা নেই। এ ভয় দেখানোর দুটো কারণ খুঁজে পেয়েছি বড় হয়ে। প্রথম, অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঁচা আম খেলে সত্যি সত্যি পেট ব্যাথার ঝুঁকি রয়েছে। দ্বিতীয়ত, চৈত্র মাসে আম ছোট থাকে। ছোটরা যদি দল বেঁধে আম সাবার করতে থাকে তাহলে বৈশাখ মাসের জন্য আর তেমন কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। তাই চৈত্র মাসে কাঁচা আম খেতে বারণ। আজকালের দিনে তো চৈত্র মাসের শুরুতেই বাজারে কাঁচা আম আসতে শুরু করে। শহুরে মানুষ যে কোনো দামেই হোক কিনবেই- নতুন কিছু বাজারে এলে কে কার আগে তার স্বাদটুকু আস্বাদন করবে, এ নিয়ে প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে যায়। তাই কাঁচা আম প্রথম বাজারে এলে পাকা আমের চেয়েও দ্বিগুন মূল্যে বিক্রি হয়।

গ্রামে মুসলমান পরিবারে এদিন কোনো আনন্দ-উৎসবের আয়োজন ছিল না। অপরদিকে হিন্দু পরিবারে একটা উৎসবের আয়োজন ছিল। তারা সবাই সুন্দর পোশাক ও পরিষ্কার জামা-কাপড় পরে নতুন বছরের মেলায় আসত। হিন্দু বাড়িতে পূজাও হতো। গ্রামে পহেলা বৈশাখ থেকে শুরু করে অন্তত দিন পনেরো এদিক-ওদিক বিভিন্ন স্থানে বৈশাখী মেলা বসত। গ্রামের মানুষ এটাকে পরবের মেলা বলত। এ মেলায় জিলিপি, মুড়ির মোয়া, খই, বাতাসা, কদমা ইত্যাদির দোকান বসত। এছাড়া বিভন্ন খেলনা, মেয়েদের চুলের ফিতা, চিরুনি, কাঁকই, চুড়ি, কোমরের তাগা, বিভিন্ন ধরনের বাঁশি, ছুরি, চাকু ইত্যাদির পসরা সাজাত দোকানিরা। রঙিন কাগজের ঘুড়ি ওড়ানো ও ঘুড়ি বিক্রিও এসব মেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল। কোনো মেলার চাষাবাদ ও ঘর-গেরস্থালির বিভিন্ন প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যেমন- হালের লাঙল, কোদাল, দা, শাবল, টুকরি, খড়ম ইত্যাকার দ্রব্যাদি মেলায় আসত। বর্তমান প্রজন্মের খড়মের সঙ্গে পরিচয় নেই। কাঠের এই পাদুকা এককালে গ্রামীণ সংষ্কৃতির অঙ্গ ছিল। রামায়ণে রামের বনবাসে যাওয়ার পর তার পাদুকা সিংহাসনে স্থাপন করে ভারতে রাজ্য শাসনের কাহিনী ছাড়া খড়মের আর কোনো ইতিহাস নেই।

গ্রামে আমাদের বাড়ির পাশে একটি ছুতোর (সুত্রধর) বাড়ি ছিল। তারা হালের লাঙল, খড়ম ও জলচৌকি এবং খড়মের খুঁটি তৈরি করত। পয়লা বৈশাখের অীত প্রত্যুষে এই ছুতোর বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরা বাড়ির প্রবেশদ্বারে জড়ো হয়ে নতুন বছরে আপদ-বালাই তাড়াত। তাদের এই আপদ-বালাই তাড়ানোর ব্যাপারটা ছিল খুবই মজার। তারা তাদের বাড়ির দক্ষিণ দিকে অবস্থিত একটি মুসলমান বাড়ির দিকে ইঙ্গিত করে সমস্বরে বলত-আমাদের বাড়ির আপদ-বালাই দক্ষিণ বাড়িতে যা-রে-দূর-হ, দূর-হ। দক্ষিণ বাড়ির ছেলেমেয়েরাও জরো হয়ে উল্টো সুরে কোরাস ধরত- ‘আমাদের বাড়ির আপদ-বালাই ছুতোর বাড়ি যা-রে-দূর-হ, দূর-হ’। ভোরবেলায় নতুন বছরে এই দু’বাড়ির বাকযুদ্ধ আমরা খুব উপভোগ করতাম। আমাদের বাড়ির কাছের এই বৈশাখী মেলায় হঠাৎ করে এক বছর কিছু লাঠিধারী মোল্লা কিসিমের লোক এসে মুলসমানদের বাধা দিতে লাগল। এটা হিন্দুদের মেলা, মুসলমানদের এখানে যাওয়া শরিয়তবিরোধী ইত্যাদি কথা বলে ধর্মের দোহাই দিয়ে লাঠিধারী মোল্লারা বাধা সৃষ্টি করল। সাম্প্রদায়িকতা এবং মৌলবাদ এভাবে আস্তে আস্তে তার পক্ষ মেলতে শুরু করে।

এখন পহেলা বৈশাখে নতুন বছরকে নানাভাবে নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বরণ করে নেয়া হয়। এতে প্রতিনিয়ত নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। কিন্তু গাঁয়ের সেই লোকয়ত সংষ্কৃতির ধারাটি আজ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। যুগের পরিবর্তন হয়েছে। সমাজ বদলেছে, মানুষের ভোগ-বিলাসের সামগ্রীর পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ভোগের পসরা সাজিয়ে মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়া হচ্ছে। এর মাঝে পুরনো সেই লোকজ সংষ্কৃতির সন্ধান করার কোনো মানে নেই। শহরে আমরা এই দিনটিকে নিয়ে যতইি মাতামাতি করি না কেন, গ্রামের সাধারণ মাুনষের জীবনে এ আনন্দ-উৎসবের জোয়ার কতটুকু সাড়া জাগায় সেটা কি আমরা ভাবি? এখনো অনেক হিন্দু পরিবারে বছরের শেষ দিকে পঞ্চতিক্ত ও নিরামিষ ভক্ষণ এবং বছরের প্রথম দিনে আঁশওয়ালা মাছ দিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজন হয়ে থাকে। বছরের প্রথম দিনে ভালো খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা অনেক পরিবারেই হয়। দই-মিষ্টি তো প্রায় সবাই কেনে। অনেক মিষ্ট দোকান খালি হয়ে যায়। ঈদের আনন্দের মতো সব মানুষ যেদিন নতুন জামাকাপড় পরবে এবং উৎসবের আনন্দে মেতে উঠবে, সেদিন এই পহেলা বৈশাখ আমাদের জাতীয় উৎসবের রূপ নেবে। আমাদের জাতীয় উৎসব বলতে তেমন কিছু নেই। এই পহেলা বৈশাখই হোক আমাদের জাতীয় উৎসব, যা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ একত্রে উদযাপন করতে পার।

লেখক : ফজলুল করিম-সাংবাদিক ও কলাম লেখক

(২০০০-২০০৫ সালের গণপ্রহরীর পুরনো ফাইল থেকে সংগৃহীত। বাংলা নববর্ষ) 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *