Thu. Oct 16th, 2025
বাল্যবিবাহ সামাজিকব্যাধি হলেও সমাজ পরিবর্তনের উদ্যোগ নেই (!)

কেএস মৌসুমী : বাল্যবিবাহ সামাজিকব্যাধি হলেও সমাজ পরিবর্তনের উদ্যোগ নেই (!) কারণ, বাল্যবিবাহের মূলে রয়েছে দরিদ্রতা, নিরক্ষরতা বা অজ্ঞতা, ধর্মান্ধতা, সামাজিক অবিচার ও মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, পর্বতের চূড়া আর সমতল ভূমির পার্থক্যের মতোই বৈষম্যের সমাজব্যবস্থায় অনিয়ন্ত্রিত নারী পুরুষ সম্পর্ক বেড়ে যাওয়া, কন্যাদায় থেকে গরীব পরিবারগুলোর মুক্তি পাওয়ার আকঙ্খা ইত্যাদি। এই কারণগুলো- এক তিল পরিমাণ বিবেক দিয়ে সাদামাটা চোখে নিজ নিজ বসবাসের সমাজের দিকে তাকালেই, স্পষ্টভাবে চোখের সামনে ভেসে উঠবে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষ সহজ কথায় গরীব। আর কন্যাদায় গরীব পরিবারের মেয়েরাই প্রধানত বাল্যবিবাহের শিকার হয়। বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হলে-ধনসম্পদশালী, বিত্তবান সমাজপতি এবং বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার প্রতিনিধিত্বকারী সরকার এবং রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের সদিচ্ছাই যথেষ্ট।

অনস্বীকার্য যে, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বা সামাজিক অভিশাপ খ্যাত বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিদ্যমান যে সব আইন আছে তার সাথে আরও কঠোর পদক্ষেপ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করলেই কি বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়ে যাবে? নিশ্চয়ই না। কারণ, সীমিত জ্ঞানে হলেও উপরোক্ত ভূমিকাই যেহেতু যথেষ্ট বলে মনে করি। সেহেতু সেটাকে প্রাধান্য দিয়েই আইনি ব্যবস্থা সম্পর্কে নির্দ্বিধায় বলা যায়-আইনগুলো সম্পর্কে যথেষ্ট গণসচেতনতা তৈরী করতে হবে। এবং যাদের সদিচ্ছাই যথেষ্ট বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তাদেরসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও পেশাজীবিদের সামিল করতে হবে-‘গণসচেতনতা তৈরীর গঠনমুলক কার্যক্রমে। অন্যথায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে প্রণোদীত আইনগুলো আইনের বই ও সার্কুলারে’ সীমাবদ্ধ থাকবে; তা কার্যকর বা টিকসই হবে না।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভয়াবহ এক তথ্যসূত্র বলছে, ২০২০ সালে জাতিসংঘ শিশুসংস্থা ইউনিসেফের চাইল্ড ম্যারেজ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে-ওই বছর বাংলাদেশে ৫১ শতাংশ নারীর শৈশবে বিবাহ হয়েছে। তন্মধ্যে ৩ কোটি ৪৫ লাখ নারীর ১৮ বছর হওয়ার আগেই বিয়ে হয়েছে। এবং ১৫ বছর হওয়ার আগে বিয়ে হয়েছে ১ কোটি ৩ লাখ নারীর। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, বাংলাদেশে ২০০৬ সালে ১৮ বছরের কম বয়সে বিবাহের হার শতকরা ৬৪ জন, ২০১২ সালে শতকরা ৫২ জন ও ২০১৯ সালে ৫১ শতাংশ। এভাবে কমার হার অব্যাহত থাকলেও ২০৩০ সালে বিবাহের হার দাড়াবে প্রায় শতকরা ৩০ জন।

এবার ২০২৫ সালে এসে দেখা যাক, আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস ২০২৫ উপলক্ষে রাজধানীর ইস্কাটর্নে মহিলা অধিদপ্তরে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)-এর সহায়তায় অনুষ্ঠিত মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর আয়োজিত উচ্চ পর্যায়ের আন্ত:মন্ত্রণালয় সংলাপে যে তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। পরিবেশিত তথ্য বলেছে-বাংলাদেশে বছরে ২ শতাংশ হারে বাল্যবিবাহ কমলেও প্রতি দুইজন মেয়ের একজন এখনও বাল্যবিবাহের শিকার। অনুষ্ঠিত সংলাপে অঙশ নিয়েছিলেন আইন ও বিচার, তথ্য ও সম্প্রচার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান মন্ত্রণালয়, মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ ও স্থানীয় সরকার বিভাগসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ। অংশগ্রহনকারী সকলেই একমত হয়েছেন যে- ‘শুধু আইনি পদক্ষেপ নয়, সামাজিক, শিক্ষাগত ও প্রশাসনিক সমন্বয়ের মাধ্যমে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে জাতীয় আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি’।

সংলাপ অনুষ্ঠানে সহায়তাকরী ইউএনএফপিএ’র প্রতিনিধি ক্যাথরিন ব্রিন কামকং অনুষ্ঠিত ‘সংলাপকে’ প্রকৃত অর্থেই একটি সর্ব সরকারীয় পদক্ষেপের প্রতিনিধিত্ব করে উল্লেখ করে বলেছেন, প্রণোদীত আইনের অর্থ নেই, যদি তা বাস্তবায়ন না হয়; আবার সুরক্ষা ব্যবস্থারও অর্থ নেই, যদি মেয়েরা সুযোগ না পায়। তিনি বলেছেন, আমরা যে দ্রুত অগ্রগতি চাই, তা তখনই সম্ভব হবে, যখন সব পদক্ষেপ একসঙ্গে বাস্তবায়িত হবে। ইউএনএফপিএ’র প্রতিনিধি আরও বলেছেন- ‘যদি একটি মেয়ের জীবনদক্ষতা, শিক্ষা ও আইনি সুরক্ষা না থাকে, তবে সে ঝুঁকিমুক্ত নয়। তাই সকলকে প্রতিটি মেয়ের শৈশব যাতে সুরক্ষিত থাকে, সেজন্য একসঙ্গে কাজ করতে হবে’।

‘বাল্যবিবাহ সামাজিক ব্যাধি হলেও সমাজ পরিবর্তনের উদ্যোগ নেই’ শিরোনামের আজকের এই প্রতিবেদনে বাল্যবিবাহ কতটা স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ায়, তার একটু বর্ণনা দিয়েই যার যার অবস্থান থেকে পাঠকবৃন্দ বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সম্ভাব্য ভূমিকা পালন করবেন-এ আশা ও বিশ্বাস থাকছে। সর্বজন স্বীকৃত যে, ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড’-হলেও একটি দেশ বা রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নে ‘সুস্থ্য-কর্মক্ষম জাতিও অপরিহার্য’। অথচ ইউনিসেফের তথ্যানুসারে-‘১৮ বছরের আগে কোনো কিশোরী নারীর বিয়ে দেয়ার পরিণতি হয় অন্যদের তুলনায় তাকে বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলে দেওয়া। যাদের বেশির ভাগই স্বামীর দ্বারা সহিংসতার শিকার হয়। আর যখন বাল্যবিবাহের কোনো কিশোরী যখন মা হতে যায় তখন প্রসবকালে যমন অধিক ঝুঁকিতে পরে। সেই ঝুঁকিতে জন্ম নেওয়া সন্তানও স্বাস্থ্যগত ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফলশ্রুতি জাতির উন্নয়নে প্রয়োজীনয় সুস্থ্য কর্মক্ষম তরুণ-যুবশক্তির ঘাটতি থেকে যায়। উপরন্ত শিক্ষা ও কর্মের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। যদিও কর্মক্ষম অীধক সংখ্যক শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত ও নিরক্ষর প্রায় তরুণ-যুবশক্তি কর্মহীন-বেকার থাকার প্রভাও প্রতিফলিত হচ্ছে বাল্যবিবাহে।

প্রসঙ্গত আলোচ্য যে, সমাজের অভিশাপ খ্যাত বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বৈষম্যমুক্ত সমাজের বিকল্প যেমন নেই। তেমনি, মানুষের মৌলিক অধিকারসহ মানবাধিকার সাম্য, ন্যায় বিচার ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মতো জনগণের গণতান্ত্রিক সরকারও অপরিহার্য। একইভাবে অপরিহার্য-‘রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংষ্কৃতিক সংগঠন সুশীল সমাজও বিভিন্ন শ্রেনীপেশার নেতা-কর্মী-সমর্থকসহ সকল সচেতন মানুষের অংশগ্রহন ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন’। তবেই অভিশাপখ্যাত সামাজিক ব্যাধির বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ সম্ভব।

পরিশেষে, বিশেষভাবে পুন: পুন: উল্লেখ্য যে, পাঠকবৃন্দের সাথে মতামত বিনিময়ে উল্লেখিত উপরোক্ত বর্ণনায় যাদের সদিচ্ছা ও অংশগ্রহনসহ গণসচেতনতা তৈরীতে সামিল হওয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে তাঁরা অবহেলা করলে- বাল্যবিবাহই ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি করবে। এমনিতেই বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান  প্রথম এবং বিশ্বের মধ্যে অষ্টম। ১৮ বছর হওয়ার আগে বিবাহিত ৫১ দশমিক ৪ শতাংশের মধ্যে শতকরা ২৪ জন সন্তান জন্ম দিচ্ছেন। অথচ এখনো জীবদ্দশায় জীবনসঙ্গী বা স্বামীর দ্বারা সহিংসতার শিকার হচ্ছে শতকরা ৭০ জন। প্রতিনিয়ত কেউ না কেউ ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। কর্মসংস্থানের অভাবে সৃষ্টি বেকারত্ব-স্নাতক ডিগ্রিধারী নারীদের মধ্যে শতকরা ২৯ শতাংশ যখন বেকার তখন পুরুষ ১২ শতাংশ অর্থাৎ পুরুষের চেয়ে নারীরা দ্বিগুণ বেকার। ফলশ্রুতিতে নারীরা এখনো অনিরাপদ বলা যায়। তাই সার্বিক বিশ্লেষণ গত ১১ অক্টোবর পালিত আন্তর্জাতিক কন্যা দিবসের আলোচিত প্রতিপাদ্য আমি কন্যা শিশু-স্বপ্নে গড়ি, সাহসে লড়ি, দেশের কল্যানে কাজ করি’। এর সাথে সচেতন পাঠক সমাজের বিবেচনার জন্য সংযোজন জাতীয় কবি কাজী নজরুলের অমর বাণী-‘পৃথিবীতে যত সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’।

আরও পড়ুন- জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে নিরক্ষর কুদ্দুস পথ প্রদর্শকই বটে (!)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *