মওলানা ভাসানীর মৃত্যু নেই যুগ যুগ জিও। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার মুক্তিকামী কৃষক-শ্রমিক মেহনতি জনগণের হৃদয়ে লেখা যার নাম। সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ-আমলাবাদ-মুৎসদ্দি-পুঁজিবাদ এবং তাঁদের দালাল-সেবাদাস-শোষক-শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দেলান-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যার প্রকাশ। আর আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানুষের হৃদয়ে খোদাই করে লেখা হয়েছে যার নাম। তিনিই মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। সেই মহান নেতার আজ ৪৮তম মৃত্যু বার্ষিকী। তাঁর মৃত্যু বার্ষিকীতে গণপ্রহরী পরিবার পক্ষে গভীর শ্রদ্ধার স্মরণ করে তাঁর জীবনাদর্শ থেকে শিক্ষা গ্রহনের আহ্বান জানাচ্ছি। পাঠকদের সদয় অবগতির জন্য কাছে থেকে দেখা ভাসানী যুগ যুগ জিও বিষয়ক লেখা তুলি ধরছি।
অস্বীকার্য যে, সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ-আমলা-মুৎসদ্দি-পুঁজিবাদ এবং তাদের প্রতিনিধিত্বকারী শাসক শোষকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ ‘মওলানা ভাসানী’। এবং আন্দোলন-সংগ্রামের প্রকাশ মওলানা ভাসানী। স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ভাসানীর রাজনীতি ও দর্শন সংগ্রামের হাতিয়ার। যে হাতিয়ার উচিয়ে ধরেছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে, আসাম থেকে বাঙ্গালী খেদাও আন্দোলনের লাইন প্রথা বিরোধী সকল আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন মওলানা ভাসানী। অত:পর বায়ান্ন, উনসত্তর, সত্তর ও একাত্তর প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রাম ও গণঅভ্যূত্থানের অগ্রনায়ক ছিলেন মওলানা ভাসানী। জীবনের সন্ধিক্ষণে ৯৬ বছর বয়সে বাংলাদেশের জন্য ও বাঙালীদের জন্য মরণফাঁদ আখ্যায়িত ফারাক্কা বাঁধ ভেঙ্গে দেয়ার হুশিয়ারি দিয়েছিলেন ১৯৭৬ সালে। তাঁর হুংকারে লাখো জনতার কণ্ঠে যখন এই স্লোগান উচ্চারিত হচ্ছিল, তখন যেন কাপছিল ফারাক্কা বাঁধ। তাইতো ভাসানীর মৃত্যু নেই। ইথারে ভাসছে-‘মওলানা ভাসানীর মৃত্যু নেই যুগ যুগ জিও’।
এবার ভূমিকায় উল্লেখিত ‘কাছে থেকে দেখা ভাসানী যুগ যুগ জিও’ বিষয়ক লেখাটি পাঠকের অবগতির জন্য তুলে ধরছি।
প্রথমে আবারো বলে নিতে হয় মওলানা ভাসানীর মৃত্যু নেই যুগ যুগ জিও। ইতিহাস কথা বলে। তবে ইতিহাস যা বলে তা যেমনি বাস্তব তেমনি রুঢ়। সেই ইতিহাসের রায় হচ্ছে-‘দেশ চায় স্বাধীনতা, জাতি চায় মুক্তি আর জনগণ চায় বিপ্লব’। আমার মতো সাধারণ মানুষের বিন্দু সমতুল্য বিদ্যাবুদ্ধিতে শিক্ষায় অর্জিত যে, ইতিহাসের আরও একটি রায় হচ্ছে- ইতিহাস যারা বিকৃত করে তারা নিজেরাই সেই বিকৃত ইতিহাসের শিকার হয় এবং সত্য মিথ্যার যুদ্ধে সত্যের বিজয় নিশ্চিত। এমনকি, মিথ্যার পাথর চাপা থেকে সত্য বেরিয়ে আসে ও আসবেই। পাঠক, প্রায় লেখাতেই বলে থাকি, ‘দোহাই’ রাগ করবেন না ও গাল দিবেন না ; আর গাল দিলেও অন্তত: রাজাকার বলবেন না। কারণটা দু’চার লাইনে বলার আগে বহুবার বলা নিজের মুদ্রা দোষের সত্য কথাটা বলে নেয়াই ভালো। তাহলো-স্বল্পবিদ্যার জন্য এক কথায় বলার ঘটনা দশ কথায় বলার জন্য লেখার পরিধি বাড়ে, যা নিজগুনে ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে বেবিচনার অনুরোধসহ আরও বেশী তথ্য জানা থাকলে, জানালে বাধিত হবো। যাকে কাছ থেকে দেখে, যার কথা শুনে ও বুঝে ষাট দশকের তার প্রদর্শিত পথের দেশের মোট জনসংখ্যার নব্বই ভাগের বেশী সংখ্যক-ভুমিহীন সর্বহারা কৃষক শ্রমিক তথা আপমর জনগণের মুক্তির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলাম। সেই মহান নেতা এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার স্বীকৃত ও পরীক্ষিত মজলুম জননেতা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রবক্তা মুক্তিযুদ্ধকালিন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৮তম মৃত্যু দিবস ১৭ নভেম্বর উপলক্ষে বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়েই ইতিহাসের বিশাল অংশজুড়ে থাকা মাওলানা ভাসানীর ঐতিহাসিক ভুমিকার প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই এই এক চিলতে লেখার অধমের আজকের উপস্থাপনা।
পাঠক, আগেই বলেছি ইতিহাসের রায়-‘দেশ চায় স্বাধীনতা, জাতি চায় মুক্তি আর জনগণ চায় বিপ্লব; ইতিহাসের এই রায়কে (১৮৮৫-১৯৭৬) সেদিনের বাস্তবতায় পর্যালোচনা বা মূল্যায়ন করলে যার নাম ও রাজনীতি নিয়ে অন্ততঃ ১৭ নভেম্বর বা এই দিনটিকে ঘিরে পত্র পত্রিকাসহ সকল গণমাধ্যমে সম্ভাব্য সচিত্র প্রতিবেদনসহ ব্যাপক লেখালেখি হওয়ার কথা। আলোচনার পাশাপাশি রাজনৈতিক- সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে রাজপথে জনসভা, সভা-সেমিনার ও মিছিলে সরগম থাকার কথা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তার একদশমাংশও পরিলক্ষিত হচ্ছে না বা হবে বলেও বিগত ৪৮ বছরের বাস্তবতায় মনে হয় না। বরং সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থাধীনে পরিচালিত রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় যতই দিন যাচ্ছে, ততই যেন তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকা মুছে ফেলার অঘোষিত অপতৎপরতা চলছে। তানাহলে যথাযথ সম্মান প্রদর্শনে ও তাঁর ভুমিকা থেকে শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে সংক্ষিপ্তভাবে হলেও লিখতে হতো না। আর আমি লিখছি আমার দায়বদ্ধতা থেকে এবং স্বল্প পরিসরেই এই মহান নেতার ৪৮তম মৃত্যু দিবস যারা পালন করছেন, তাদের দায়বদ্ধতা থেকে। সেই দায়বদ্ধতা হলো, সকল বীর শহীদদের আত্মত্যাগ স্বার্থক করার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জন করে জাতিকে দায়মুক্ত করার দায়বদ্ধতা । আর সেই লক্ষ্যের শোষনমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল মহান নেতা মওলানা ভাসানীর আজীবন সাধনার রাজনীতি ও ত্যাগতিতিক্ষা। তবে হ্যাঁ, সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী প্রভুশক্তি সমুহই শুধু নয়, প্রতিবেশী সাম্রাজ্যবাদী পথে চলা সম্প্রসারনবাদী ভারতও মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যের শোষনমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা অর্থাৎ সমাজতন্ত্রের কঠোর বিরোধী। এবং সাম্যা, ন্যায়বিচার ও মৌলিক অধিকারসহ মানবাধিকার সংরক্ষণের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থারও বিরোধী। যে কারণে সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ-সম্প্রসারণবাদ ও তাদের এদেশীয় দালাল সামন্ত-আমলা-মুৎসদ্দি, পুঁজিবাদী শোষক গোষ্ঠির প্রতিনিধিত্বকারী শাসক শ্রেণীর চাওয়াও এক। তাদের লক্ষ্য শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে, ভাসানীর শোষিত শ্রমজীবি মেহনতি মানুষের রাজনীতির ক্ষুরধার অস্ত্রের ধার ভোতা করে দেওয়া। তদসত্বেও যেহেতু দেশ ও জনগণের নিবেদিত প্রাণ মওলানা ভাসানীর সাহসী ভুমিকা শক্তিশালী ও আত্মনির্ভরশীল দেশ ও সমাজ বিনির্মাণে প্রেরণা যোগাবে। সেহেতু লিখতে হবে জানতে হবে ও জানাতে হবে ।
বললে ভুল হবে বলে মনে হয় না যে, তিনি একমাত্র নেতা যিনি জাতীয় রাজনীতির নেতৃত্ব দিয়েছেন বলতে গেলে অজো পাড়াগ্রাম থেকে । তিনি সাধারণ কৃষি পরিবারে জন্ম নিয়ে অসাধারণ স্বপ্ন আর তার দৃঢতার সাথে জীবন সংগ্রাম করেছেন। সাধারনের ন্যায় জীবন যাপন করে এক অসাধারন ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে, সাধারণ মানুষের জন্য রাজনীতি করে বাংলার মানুষকে এক অসাধারণ সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন। তাইতো মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী উজ্জল এক নক্ষত্রের নাম। তাঁর পথ অনুসরণ করলে আমরা অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবো। শহীদদের আত্মত্যাগ স্বার্থক হবে। সেহেতু মওলানা ভাসানীর মৃত্যু নেই যুগ যুগ জিও।
প্রবাদ প্রতিমের বাংলাদেশের এই মহান নেতা রাজনৈতিক কর্মসূচী বাস্তবায়ন তৎপরতায় আত্মনিয়োগ করার জন্য ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশসহ সারা উপমহাদেশের এক প্রবাদ প্রতিম ব্যক্তিত্ব ছিলেন। অসম্প্রদায়িক রাজনীতির অন্যতম প্রধান পুরোধা এই নেতাকে দেখেছি শৈশবে একাধিকবার টাঙ্গাইলের তাঁর বিন্নাফৈড়ের বাড়ীতে পীর হিসেবে। তখন তেমন না বুঝলেও কৈশোরে একবার দেখেছি নিজেদের বাড়ীতে, তখন শুনেছি তিনি পীর এবং নেতাও। তাতে বুঝেছিলাম তিনি মায়ের মমতায় ছোট বড়, হিন্দু-মুসলমান সবার কথা বলেন, ছোটদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। ভক্তদেরকে বলতে শুনেছি তোমরা মনে রাখবা, ‘হযরত নবী করিম (সঃ) মদিনায় যেভাবে মুসলমান, খৃষ্টান-ইহুদী মিল মহব্বতের মধ্যে একসাথে বসবাস করতেন, তোমরাও সেইভাবে মিলে মিশে থাকবে। একজনের দুঃখ কষ্টে আরেকজন আগাইয়া যাবা। আল্লাহ পাক কোন মানুষকে মুসলমান করে, হিন্দু করে, খৃষ্টান করিয়া ও বৌদ্ধ করিয়া দুনিয়ায় পাঠায় নাই, পাঠাইয়াছে মানুষ করিয়া।
তিনি বলেন, আগে ব্রিটিশ আর তার দালাল জমিদার-জোতদাররা কৃষকদের রক্ত চোষার জন্য মানুষকে ভাগ করিয়া দিত। তোমরা কৃষক, কামার, কুমার, জেলে, তাতী, নাপিত- মেথর, মুছি বলিয়া মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করবা না। দেল দিয়া বুইঝা দেখবা-যে যে কাজই করুক, তার কাজ আরেকজনের দরকার। যখন তার যাওয়ার সময় হলো তখন যারা যারা মাটির বাসনে ও বোতলে পানি নিয়ে এসেছিল পানিপড়া নিতে, তিনি পানিতে ফু দিয়ে যাওয়ার সময় বলে যান, অসুখ বেশী হলে ঔষধ খাওয়াবা। ছেলেমেয়েদের স্কুলেমক্তবে পাঠাবা, লেখাপড়া না শিখলে দুনিয়া সম্পর্কে জানবে না, ন্যায়, অন্যায় বুঝবে না’। অল্প সময়ের মধ্যে এত সুন্দর করে গুছিয়ে এতগুলো কথা বললেন, যা আমার হৃদয়ে আজও গেঁথে আছে। যদিও কিশোর বয়সে শুনেছিলাম। প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক বাবার কাছে জানতে চেয়েছিলাম হুজুরের লেখাপড়া কত দূর? বাবা বলেছিলেন, ওনার লেখাপড়ার শেষ নেই। আল্লাহপাক আলৌকিক জ্ঞানদান করেছেন তাঁকে। ব্রিটিশ আমাদের দেশ শাসন করতো, আমরা পরাধীন ছিলাম। আজকে পাকিস্তান, ভারত দেশ দুটি যাঁদের নেতৃত্বে স্বাধীন হয়েছে? তাঁদের মধ্যে হুজুরও একজন। কায়েদে আযম ও মহাত্মাগান্ধীদের সাথে আন্দোলন করেছেন বলেইতো মওলানা ভাসানী হুজুরও এবং নেতাও। আসামে এখনও আমাদের আত্মীয় স্বজন আছেন। তারা হুজুরের আন্দোলনের জন্যই আছেন। তাঁর কথায় তুমি যেমন মুগ্ধ হয়েছো, তেমনি আসাম থেকে যখন বাঙালীদের তাড়িয়ে (বাঙালী খেদাও) দিচ্ছিল; তখন হুজুর সারা আসামে বড় বড় মিটিং করে এমনভাবে বক্তৃতা দিয়ে হিন্দু-মুসলমান সবাইকে এক করেছিলেন বলেই তারা এখনও আছেন ।
বড় হয়ে যেয়ে দেখবে-যে ভাসান চরে লাখো কৃষকদের নিয়ে মিটিং করেছিল সেইখানে হুজুরের নামে মাদ্রাসা আছে, পোস্ট অফিস আছে আরও অনেক কিছু। মুসলমান-হিন্দু সকলেই তাঁকে হুজুরমানে, নেতা মানে। এই কথাগুলো আমি খাতার পাতা ছিড়ে লিখে রেখেছিলাম। অনেকদিন ছিল জীবন পথে চলতে কোন সময় লেখা কাগজটা হারিয়ে যায় বটে। কথাগুলো হৃদয় ছুয়ে গিয়েছিল এবং বাবার কথাগুলো মওলানা ভাসানীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল করেছিল বলেই ষাট দশকে তাঁর প্রদর্শিত পথে রংপুরে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিয়ে কৃষক, শ্রমিক মেহনতি জনগণের স্বার্থে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলাম ।
আর সেই উৎসর্গিত জীবনে ঊনসত্তরের ছাত্র গণআন্দোলন-গণঅভুত্থানে সক্রিয় ভুমিকা পালন করি। এক পর্যায়ে আসাম সীমান্তে রৌমারীকে কেন্দ্র করে কুড়িগ্রাম, গাইবান্দা ও জামালপুরের (আংশিক) চরাঞ্চল নিয়ে মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলেছিলাম। গড়ে তুলেছিলাম ভাসানী মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা বাহিনী (সংক্ষেপে ভাসানী বাহিনী)। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে মওলানা ভাসানী যান সেই মুক্তাঞ্চলে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের পাকিস্তানী সামরিক জান্তারা তাঁর বাড়ীতে আক্রমণ করার পূর্ব মুহুর্তে মেনন ভাইয়ের (রাশেদ খান মেনন) অনুরোধে বাড়ী থেকে বের হয়ে নৌকাযোগে রৌমারী পৌছেন এবং তাঁর পিছু নিয়ে এখানেও আসতে পারে ভেবে তাই বেশী সময় দিতে পারেননি। ঠিক যে ভাবে প্রথম জীবনে ভাসানীর কথা শুনেছিলাম তদ্রুপই আগেই জানতেন আমি পূর্ববাংলার ছাত্র ইউনিয়ন ও কৃষক সমিতির মাধ্যমে মুক্তাঞ্চল করে মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী গড়ে তুলেছি ও গোপনে তার ভক্তদের এলাকার ব্রহ্মপুত্র নদের চরে চরে প্রশিক্ষণ চলছে।
ভাসানীর গুছিয়ে কথা বলাই শুধু নয়, অল্প কথায় বর্ণনা যেন ছিল ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১০-১৫ মিনিটে সব বিষয়ে দক্ষ দুরদর্শী জ্ঞানী মওলানা ভাসানীর রেজুলেশনের বর্ণনা-“ন্যাপ নেতা, কৃষক নেতা-আব্দুস সোবহানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথি ন্যাপ সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী (তাঁর ভাষায়) আব্দুল মজিদের (তিনি এনামে বলতেন) নেতৃত্বে ন্যাপ, কৃষক সমিতি, ছাত্র ইউনিয়ন ও শ্রমিক আন্দোলনের সমন্বয়ে গড়ে তোলা ১০১৭ জনের ভাসানী মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী অনুমোদন করেন এবং আঃ মজিদকে (এসকে মজিদ মুকুল) ভাসানী বাহিনীর প্রধান করে তার রণনীতি ও রণকৌশলের সংক্ষিপ্ত বিবরণ শুনে তা অনুমোদন দেওয়া হলো। সভায় সকলকে মুক্তিযুদ্ধ সফল করতে গোপনীয়তা ও শৃংখলা রক্ষার সাথে ঐক্যবদ্ধ থেকে শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে চেষ্টা চালাতে হবে। আল্লাহ্ ন্যায়ের যুদ্ধকে সফল করবেন ইনশা আল্লাহ’। সভাস্থল ত্যাগের আগে বলে যান সরকার গঠনের কথা। দুর্ভাগ্য মে মাসের প্রথম দিকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি দল রৌমারী মুক্তাঞ্চলে পৌঁছলে, আলোচনা সাপেক্ষে তাদেরকে সেই সভার রেজুলেশন ও তালিকা তাদেরকে হস্তান্তর করি। যা পরবর্তীতে পাওয়া যায়নি। এছাড়া রুশ ভারতের হস্তক্ষেপে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ায় এ নিয়ে কোনদিন মওলানার মুখোমুখি হইনি। এদিকে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ সুবিধা প্রদানের ঘোষণায় আমাদেরও তালিকাভূক্ত কৃষক, শ্রমিক ও নারী, শিশু মুক্তিযোদ্ধারা তালিকাভুক্ত হওয়ার আগ্রহ ও আবেদন নিবেদন করেন। যা কৌশলে ফাইল চাপা পড়ে যায়।
মহান নেতা মওলানা ভাসানীর ৪৮তম মৃত্যুদিবস স্মরণে তাঁর অবদানের কথা নতুন করে উল্লেখ করতে হলো। আরেকটি কথা বলতেই হয়, একবার কি কারণে যেন হুজুর রাগ করে ভাত খাচ্ছিলেন না। যাদু ভাই (মশিউর রহমান যাদু মিয়া) রংপুরে ফোনে জানালো, তাঁর পরামর্শ মতে রংপুরের ন্যাপ নেতৃবৃন্দের মধ্যে ভাষা সৈনিক হবেন চাচা, টুলু ভাই ও মোজাম্মেল ভাই প্রমুখ জীপ গাড়ীতে আমাকে নিয়ে টাঙ্গাইল আসেন। হুজুরের ওখানে পৌছালে তিনি চিরাচরিত নিয়মে প্রথমেই খাওয়ার কথা বলেন। তখনই সলাপরামর্শ মতে বলেছিলাম আমি ক্ষুধার্ত বটে। কিন্তু আমি নিয়ত করে এসেছি হুজুরের সাথে খাবো। আমাকে সাথে নিয়ে না খেলে, হুজুরের মতো আমি অনশন করবো—। পরে বাঁশ ও পাটখড়ির বেড়া দেওয়া ঘরে মাদুরে বসে ভাত খেয়েছি।
পৌঁছার পরই একজন মেয়েকে ডাকেন, আসতে দেরী হওয়ায় নিজে ওই পুরানো সাদামাটা কাঠের চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে একটা বড় কেতলি নিয়ে আসতে থাকেন, তাতে কেতলির কালিরদাগ হুজুরের পাঞ্জাবীতে লাগে। পরে আমাদের নিয়ে আসা পাঞ্জাবী পরিয়ে দেই। পাঠক যারা জানেন না তাঁরা নিশ্চয়ই নিশ্চিত হয়েছেন, তাঁর কর্মীদের প্রতি তাঁর স্নেহপরায়নতা, মমতাবোধ। এছাড়া তিনি জীবন দিয়ে ক্ষুধার যন্ত্রনা বুঝে প্রথমেই যে কোন অতিথি, দলীয় নেতা, কর্মী হোক বা ভক্ত অথবা অন্য কোন পেশার অতিথি হোক তাদেরকে আগে খাবার দেয়াকে প্রাধান্য দিয়ে অনুকরণীয় হয়ে আছেন। যে কারণে কাছে থেকে দেখা মওলানা ভাসানী যুগ যুগ জিও লিখেছিলাম আবার লিখছি মওলানা ভাসানীর মৃত্যু নেই যুগ যুগ জিও।
পাঠক, আগেই বলেছি ইতিহাস কথা বলে । কিন্তু যে মানুষটির জন্ম থেকে আমৃত্যু ইতিহাস সৃষ্টি করে নিজেই হয়েছেন ইতিহাস। সেই মহান মানুষটির জীবন ও রাজনীতি আমি কাছ থেকে দেখে জেনে শুনে ও পড়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জন পর্যন্ত তাঁর রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত থেকে যেটুকু জেনেছি সেটুকু লিখতে গেলেও ইতিহাসের একটি ছোট বই হবে। তারপরও বিভিন্নসূত্রে জানামতে বিকাশমান বিজ্ঞান প্রযুক্তির এই যুগের প্রজন্মের অনেকেই স্বাধীনতার প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির শোণিত মজলুম নেতা সম্পর্কে যেমন অবগত নন। তাকে ঘিরে থাকা বাম প্রগতিশীল কমিউনিস্ট বিপ্লবীরাও তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ও কর্মকান্ড সম্পর্কে যথাযথভাবে অবগত করে সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, সম্প্রসারনবাদ, সামন্ত আমলা মুৎসুদ্দি পুজিবাদী শাসন শোষণ থেকে মুক্ত করার বিপ্লবী ভুমিকার অংশ হিসেবে তা করছেন না। ফলশ্রুতিতে সাম্রাজ্যবাদী-
পুজিবাদী, বিশ্বশক্তি ও সাম্রাজ্যবাদী হওয়ার লিপ্সায় হিন্দুত্ববাদী ও বাঙ্গালী বিরোধী সম্প্রসারণবাদী ভারতের অধিপত্যের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। তাইতো ভাসানী হিসেবে ‘প্রকাশের’ আন্দোলন সংগ্রামের পথ ধরে জুলাই-আগষ্টের গণঅভ্যূত্থান।
একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর যে ভাষণকে ঐতিহাসিক ভাষণ বলা হয়- সেই ভাষণের পর সামরিক শাসকদের সাথে বৈঠক করে ঘোষণা অকার্যকর করেন। যাতে করে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলতে না পারে সামরিক জান্তা। সে নিয়ে এ মুহুর্তে আলোচনা নয়।
মুক্তি অর্জনের মহান মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যের শোষনমুক্ত সমাজ ৫৩ বছরেও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অথচ বঙ্গবন্ধু তার দাবি মতে তিনি ছিলেন শোষিতের পক্ষে ও শোষিতের মুক্তির ঘোষণা দিয়েছিলেন। আজ দেশ উন্নত বিশ্বের একটি দেশ হতে ধনীক শ্রেণী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অর্থাৎ ধনী গড়ার তালিকায় বিশ্বের তৃতীয় দেশ। কৃষক, শ্রমিক মেহনতী মানুষের কর্মসংস্থানের বদলে রাস্তা-ব্রীজ বড় বড় অট্টালিকা-মার্কেট তৈরি হচ্ছে। কেউ বলার নেই। কারণ বলতে গেলে সাম্রাজ্যবাদ- সম্প্রসারণবাদ-সামন্ত-আমলা-মুৎসুদ্দি-পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। যা শাসক শ্রেণীর পক্ষে নীতিগত স্বার্থে সম্ভব নয়।
এ মুহুর্তে প্রয়োজন ছিল ভাসানীর। আজকে বাঙালি জনগণের খাবার তৈরির অপরিহার্য শর্তের এক কেজি পেয়াজের দাম, আলুর দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। খাদ্যদ্রব্য বলতেই বাজারে আগুন। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে কৃষি জমি কমানো হয়েছে, কৃষক কমছে। তারা শহরমুখী। রাজধানী থেকে হকার, বস্তি উচ্ছেদ করা হচ্ছে। কোন নেতাই ভাসানীর মতো সরকারের দিকে আঙ্গুল তুলে বলে না…. ‘খামোস’। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা উপমহাদেশের মেহনতি মানুষের কণ্ঠস্বর, মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান, এ অঞ্চলের সকল নির্যাতিত মানুষের অবিসংবাদিত নেতা, উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রনায়ক ও পাকিস্তানের শোষনের বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রধান প্রবক্তা স্বশিক্ষিত মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী।
উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পিতৃতুল্য বিবেচনা করতেন। যে কারণে উনি ১৯৭০-এ পাকিস্তানী স্বৈরশাসকের দেওয়া শর্ত সাপেক্ষের নির্বাচনকে দূরভিসন্ধিমূলক আখ্যায়িত করে এবং স্বাধীনতার প্রস্তুতির প্রয়োজনে নির্বাচন বর্জন করলেও বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে নির্বাচনের শেষ সময়কালে ঢাকাসহ আশপাশের জেলা সমূহে প্রায় ২১টি জনসভা করে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানিয়ে ছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন ভাসানী। আজকে তিনি যথাযথ মূল্যায়িত হচ্ছেন না। যা করতে হবে প্রজন্মকে এবং ইতিহাস খুজে দেখতে হবে। ভাসানীর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। নিজেও এগিয়ে যেতেই কাছে থেকে দেখা ভাসনী যুগ যুগ জিও লিখেছিলাম।
পরিশেষে এটুকু বলতে পারি, সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় দেশ সবদিক থেকে সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। দুর্নীতি, বিশৃংখলা ও অত্যাচারে ছেয়ে যায়। যখন তথাকথিত জনগণের প্রতিনিধিরা, দুর্বৃত্তরা কালো টাকা ও মাস্তান বাহিনীর জোড়ে জনগণের সম্পদ লুট করে অবলীলাক্রমে ব্যাংক-বীমা-কর্পোরেশনে জনগণের সঞ্চিত অর্থ অত্মসাৎ করে। রাজনৈতিক দলগুলো যখন বাগাড়ম্বপূর্ণ উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিরীহ জনগণকে ভোট নামক প্রহসনমূলক নিপীড়নযন্ত্রে অংশ গ্রহণ করতে বাধ্য করে। তখন মওলানা ভাসানীর নাম বার বার বাংলার জনগণের মুখে আসে। কেননা তাদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। তাই পরিশেষে আবারো বলছি-‘মওলানা ভাসানীর মৃত্যু নেই যুগ যুগ জিও’।

প্রধান সম্পাদক, গণপ্রহরী