Thu. Jul 10th, 2025
মওলানা ভাসানী স্বাধীনতার প্রবক্তা

[ইতিহাসের অধ্যায় সৃষ্টিকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লড়াকু সাহসী বীর অন্তর্বর্তী সমন্বয়ক ও সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের এক মূল্যবান বক্তব্য আমার বিবেককে নতুন করে তাগিদ দেয়-দেশের একজন অমর নেতা সম্পর্কে লিখতে। ইতিহাসের মহানায়ক স্বাধীনতার প্রবক্তা মওলানা ভাসানী’কে নিয়ে হাজির হলাম। এই মজলুম জননেতার মৃত্যু দিবস ঘিরে ‘লেখাটি’ উপস্থাপন করছি, উপদেষ্টার বক্তব্যের একটি কথার আলোকে।

নাহিদ ইসলাম স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতাদের ভূমিকার আলোকে বলেছেন, ‘আমাদের অনেক ‘ফাউন্ডিং ফাদার’ রয়েছেন। তাদের লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি’। হ্যাঁ, তা নিশ্চিত। ইতিহাসের স্বাক্ষ্য মতেও তাই। তাইতো ইতিহাসে স্বীকৃত স্বাধীনতার প্রবক্তা, এশিয়া-আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর প্রতি বিনম্র শদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে উপদেষ্টার বক্তব্যের সাথে অংশ গ্রহন করছি। অনুরোধ করছি তার ভাষায় ‘ফাউন্ডিং ফাদার’দের যথাযথ সম্মানে জাতির সামনে তুলে ধরতে।]

তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম
তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম

পাঠকবৃন্দ, আপনাদের মস্তিষ্কের বিশাল ভান্ডারে সঞ্চিত জ্ঞানবুদ্ধিতে আমার মতো স্বল্পবিদ্যাবুদ্ধির মানুষের, মত-অভিমত বা মন্তব্য পরীক্ষিত বাস্তব সত্য হলেও মতাদর্শগত কারণে হয়তো সকলেই একবাক্যে স্বীকার করবেন না। তা না করলেও অস্বীকার হয়তো করবেন না, এমন বিশ্বাস নিয়েই লিখতে বসেছি। হয়তো কেও মন্তব্য করতে পারেন, এতো সন্দেহ নিয়ে লেখারই-বা প্রয়োজন কি ? প্রয়োজন-বিন্দু সমতুল্য জ্ঞানবুদ্ধিতে উপলদ্ধির দায়বদ্ধতা ও কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে। দ্বিতীয়ত : আমার দৃষ্টিতে ও বিবেচনায় ইতিহাসের যে মহানায়কের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে লিখতে যাচ্ছি, তাঁকে সবারই কম-বেশি জানার কথা। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতিকে তা জানানো হয়নি। এমনকি মজলুম জননেতার আমৃত্যু জীবনের ভূমিকা প্রেক্ষিতে, যথাযথ মর্যাদায় বাংলাদেশের ইতিহাসে অধিষ্ঠিত করা হয়নি। এবং পরীক্ষিত এই অসাম্প্রদায়িক নেতাকে তার প্রাপ্য মর্যাদাও দেয়া হয়নি। অথচ ‘স্বাধীনতার প্রবক্তা মওলানা ভাসানী’।

১৮৮৫ সালে অজো পাড়াগাঁয়ে জন্ম নিয়ে ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ আমৃত্যু রয়েছে সুদীর্ঘ বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাবলী। অসংখ্য ঘটনাবলীর প্রতিটি যেন ইতিহাসের একেকটি অধ্যায় হওয়ার দাবী রাখে। যে অধ্যায়গুলো ইতিহাস হিসেবে, পাঠ্যবই, উপন্যাস, নাটক-সিনেমায় প্রকাশ-প্রচারের মধ্য দিয়ে পাঠকের নখদর্পণে থাকার কথা। এ নিয়ে পাঠকের মন্তব্যই যথাযথ।

শুধু এটুকু সংযোজন করতে পারি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর জীবনী এবং বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু বই প্রকাশ পেয়েছে। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে। সবই ব্যক্তিগত পর্যায়ে। যেমন প্রখ্যাত সাংবাদিক-লেখক-গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ ও লেখক-রাজনীতিক আমজাদ হোসেন। এবং ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলার কর্মসূচী ঘোষণাকারি পূর্ববাংলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ড. মাহবুব উল্লাহর সহযোদ্ধা ও বিপ্লবী সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক নান্নুর লেখা বইসহ ও রাশেদ মামুন প্রমুখের লেখা বই রয়েছে।

যারা ভাসানীর আপোষহীন-দূরদর্শী রাজনৈতিক ভূমিকা সম্পর্কে কম-বেশি জানেন, তাঁদের আরও আক্ষেপ রয়েছে স্বাধীনতার প্রবক্তা মওলানা  ভাসানী’র জন্ম-মৃত্যু দিবসের কর্মসূচী পালন নিয়েও। পত্রপত্রিকাসহ সকল গণমাধ্যমে সম্ভাব্য সচিত্র প্রতিবেদনসহ ব্যাপক লেখালেখি আলোচনা থাকার কথা। রাজনৈতিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সরকারের উদ্যোগে তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষার শিক্ষনীয় অনুকরণীয় ভুমিকা নিয়ে ব্যাপক কর্মসূচীর মাধ্যমে পালনের মধ্য দিয়ে যথাযথ সম্মান দিয়ে মূল্যায়ন করার কথা। কিন্তু তা বিগত দিনের বাস্তবতার এবং গত ১৭ নভেম্বর ৪৮তম মৃত্যু দিবস পালন কিভাবে কোথায় হয়েছে তার সঠিকতা আয়োজকরা নিজেই অবগত। তাই এই অধমের লেখার কোন বাক্য বা মতামত যদি কারো কাছে ক্ষোভের বা আপত্তির থাকে, তা নিজগুনে ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে বিবেচনা করার অনুরোধ থাকছে। স্বীকার করা বা না করা ও বিশ্বাসের বিষয়টি পাঠকের নিজস্ব। আমার আগে লিখে সংক্ষিপ্ত আকারে মূল লেখায় যাবো।

 

 

পাঠক, বিদ্যাবুদ্ধির স্বল্পতায় লেখাটা শুরু করাটা সমস্যা হলেও কতিপয় পাঠকের অনুরোধে লিখতেই হচ্ছে। তবে স্বীকার করবেন কিনা জানিনা। বিশ্বাস তবে, সকলেই একবাক্যে স্বীকার না করলেও অস্বীকার করতে পারবেন না। অনেকে জীবন দিয়ে বাস্তবতার আলোকে দেখে-শুনে জেনে; উপলদ্ধি করে কতটা আত্মস্থ করতে পারেন। তারই স্বাক্ষী মওলানা ভাসানী। মক্তবে পড়া এবং জ্ঞানী-মহাজ্ঞানী, সঠিক গুনীজনদের সংস্পর্শে থেকে অধ্যাবসায়-অনুশীলনের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করেছেন মওলানা ভাসানী। এবং সাধারণ কৃষি পরিবারে জন্ম নেয়া চেগা মিয়া (ডাক নামটি প্রচলিত নয়) ৫ বছর বয়সে পিতৃহীন হন। ৯ বছর বয়সে ‘ওলাওঠা’ নামের মহামারি রোগের ছোবলে মা ভাই বোন ও পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন হারান।

পক্ষান্তরে ক্ষুধা-দারিদ্রতাকে আপন হিসেবে পান। জমিদার-জোতদার ও তাদের দালালদের অনাচার, বেবিচার, জুলুম, অত্যাচার, অবজ্ঞা উপহাস ছিল তার নিত্য দিনের পাওনা। যেন এসব করা ছিল তাদের কর্তব্য কাজ। কে ভেবেছে সেই চেগা মিয়া নামের মানুষটি বিশে^ পরিচিতি পাবেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী নামে। আর কে জানত সেই চেগা মিয়াই হবেন স্বাধীনতার প্রবক্তা মওলানা ভাসানী। ব্যক্তিগত পারিবারিক ভোগ বিলাস সুখ-শান্তির বিরুদ্ধে জীবন সংগ্রাম করে অর্জিত অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও প্রজ্ঞা, দুরদর্শিতা, পারদর্শিতা, ব্যক্তিগুণাবলী ও ত্যাগতিতিক্ষায় ‘অর্জন’ই মওলানা ভাসানীর “ডিগ্রী” (যোগ্যতা)। সেই ডিগ্রীর সাথে সাম্রাজ্যবাদী সামন্তবাদ ও আমলা মৎুসদ্ধি পুজিবাদী ব্যবস্থাধীনের শিক্ষাক্ষেত্রের কোন ডিগ্রীর তুলনা হয় না। এটাই হয়তো বলবেন সমালোচকরা।

কিন্তু ভাসানীর সেই অর্জন ও ত্যাগতিতিক্ষা যদি হয়, আমাদের দেশসহ সারা বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত-শাসিত মানুষের মুক্তির পথ হিসেবে স্বীকার্য। তাহলে বলার থাকবে না। এও অনস্বীকার্য যে, কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মজলুম জনগণকে দেশী-বিদেশী শাসন-শোষনের হাত থেকে মুক্তির আন্দোলন-সংগ্রামে সর্বদাই সামনে থেকেছেন। তাই এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার স্বাীকৃত ‘মজলুম জননেতা’ হয়েছেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। দেশের স্বাধীনতার জন্য জাতিগত, ধর্মগত ভেদাভেদ মূলক নিপীড়ন ও বর্ণবৈষম্যের হাত থেকে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মুক্তির জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন ভাসানী।

তিনি জেল-জুলুম সহ্য করেছেন যেমনি জনগণের ভাগ্যের ও সমাজ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য। তেমনি ন্যায় ও ন্যায় বিচার, সততা ও মানবাধিকারসহ মানুষের জন্মগত মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। তাহলে সেই মানুষটি নিশ্চয়ই মহান ; আর তা যদি হয় শিক্ষনীয় অনুকরণীয় ও অনুসরনীয় তাহলে (?) সেই মানুষটির জীবনইতো হয় ও হবে ইতিহাস এবং ব্যক্তিটি হবেন সেই ইতিহাসের মহানায়ক। ইতিহাস দৃষ্টে ও কাছ থেকে আমার দেখা আফ্রিকা-এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার স্বীকৃত পরীক্ষিত মজলুম জননেতা। ইতিহাসের মহানায়ক মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর আত্মার প্রতি এই লেখার মাধ্যমে আমি তাঁর আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনান্তে আত্মার শান্তি কামনা করছি। তবে পত্রিকান্তরে তাঁর সুদীর্ঘ বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন নিয়ে লেখা সম্ভব নয়। তাই উপরোক্ত বর্ণনা দিতে উল্লেখিত বিষয়াদির বাস্তবতায় অতি সংক্ষিপ্তভাবে দু’চারটি দিক তুলে ধরার সাথে কাছ থেকে দেখা একটি ঘটনা বর্ণনা করবো মাত্র ।

 

নদী মার্তৃক কৃষি প্রধান এই দেশের অবহেলিত ও পিছিয়ে থাকা উত্তর জনপদের সিরাজগঞ্জ জেলার ধানগড়া গ্রামের সাধারণ কৃষক পিতা হাজী শরাফত উল্যাখান ও মাতা মজিরন বিবির দ্বিতীয় পুত্র সন্তান হিসেবে আব্দুল হামিদ খান ওরফে চেগা মিয়া জন্ম গ্রহণ ১৮৮৫ সালে। পিতৃ-মাতৃহারা-স্বজন হারা চেগা মিয়া মুসলিম আইনমতে ভুমিহীন হয়েও কারো দয়া বা অনুগ্রহ নিতে চাননি। জ্ঞাতি চাচার আশ্রয়ে প্রাইমারী স্কুলে পড়া অবস্থায় ক্ষুধা ও দারিদ্রতা ঘিরে ধরলেও হার মানাতে পারেনি। বরং জমিদার, জোতদার, মহাজন, প্রজাদের, দালাদের সীমাহীন শোষন, নিষ্পেষন বন্ধ করে দেন।

তাঁর আচার-ব্যবহার ও কর্মস্পৃহার প্রতি ইরাকের বাগদাদ থেকে আসা আধ্যাতিক পীর নাসিরউদ্দিনের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। তিনি তাঁকে সন্তান স্নেহে আবদ্ধ করে আসামে নিয়ে যান। তাঁকে আরবী, উর্দু ও ফার্সি ভাষা শিক্ষা দেন। তীক্ষèবুদ্ধি সম্পন্ন মেধাবী এই সন্তান ১৯০৩ সালে দেওবন্দে লেখা পড়ার জন্য যান। দেওবন্দ মাদ্রাসা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীদের দ্বারা পরিচালিত। সেখানেই তিনি প্রগতিশীল ইসলামী চিন্তাবিদ পন্ডিতদের সংস্পর্শে প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনায় সিক্ত হন। এখন তাঁর সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয় নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে থাকেন।

মওলানা ভাসানী স্বাধীনতার প্রবক্তা

ভাবনা-চিন্তার এক পর্যায় আলোচিত স্বাধীনতার প্রবক্তা মওলানা ভাসানী সিদ্ধান্ত নেন, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভুর কবল থেকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ভারতকে মুক্ত করতে হবে। আর সে কারণে লেখাপড়া করে বেশী সময় নষ্ট করা যাবে না। বরং সারা জীবন শোষিত-বঞ্চিত মজলুম জনগণের জন্য কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। এবং ১৯০৯ সালে আসামের জলশ^রে তার আধ্যাত্মিক শিক্ষক পীর নাসিরুদ্দিন বোগদাদীর কাছে যান। সেখান থেকে তিনি কলকাতায় গিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে যোগদান করেন। টাঙ্গাইলে ফিরে এসে কাগমারীতে এক স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং সশস্ত্র বিপ্লবীদের সাথে লাঠিচালনা ও বন্দুক চালনা শেখেন। ১৯১৩ সনে সশস্ত্র বিপ্লবী রাজনীতি পরিত্যাগ করেন এবং ১৯১৮ সনে হজব্রত পালন করেন।

মওলানা ভাসানীর অতিদ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জনে সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি জনগণের আকাঙ্খা প্রাণ দিয়েই বুঝতে পারতেন। সে ভিত্তিতে কথা বলতেন। এছাড়া ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে প্রগাঢ় জ্ঞান থাকায় এবং সুবক্তা হওয়ায় মানুষকে আকৃষ্ট করার ক্ষমতা ছিল অনেক। তবে তিনি ধর্মান্ধ ছিলেন না। পানি পড়া দিয়েও বলতেন অসুখ বেশী হলে ঔষধ খাওয়াবে। জামাতে নামাজ পড়াতেন ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে নেতৃত্ব করতেন, এক সময় তিনি পীর হয়ে ওঠেন। তিনি ধর্মান্তরিত করনের বিরোধী ছিলেন। অসম্প্রদায়িক শিক্ষানুরাগী এই নেতা ধর্ম কেন্দ্র তৈরী করার চেয়ে সাধারণ ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা কেন্দ্র করেছেন বেশী। শ্রেণী বৈষম্যের শিকার হয়ে বাস্তবতার মুখে শৈশবে ক্ষুধা ও দারিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করার মধ্য দিয়ে জীবন পথের যাত্রা শুরু করেছিলেন।

স্বাধীনতর প্রবক্তা মওলানা ভাসানী সুদীর্ঘ দুর্গম ও পিচ্ছিল পথ অতিক্রম করে মেধা-শ্রম ও ত্যাগ তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছেন। চলার পথে তিনি ছিলেন অবিচল। ফলশ্রুতিতে সকল নির্যাতিত মানুষের অবিসংবাদিত নেতা ও স্বাধীনতার প্রবক্তা মওলানা ভাসানী হন। তিনি হন উপমহাদেশের বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রনায়ক। পাকিস্তানের শোষনের ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রধান প্রবক্তা ও সংগঠক।

স্বাধীনতার প্রবক্তা মওলানা ভাসানী দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে, শিক্ষনীয় অনুবাদ ও রাজনৈতিক ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য অসংখ্য কর্মসূচীর আয়োজন করেছিলেন। যে সকল মহান ব্যক্তিত্ব ও নেতার সংস্পর্শে থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, আত্মবিশ্বাসী হয়েছেন ও পেরেছেন ব্যক্তি স্বাথের্র উর্ধ্বে ওঠতে। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এস কে গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, সুভাষচন্দ্র বসু, মোহাম্মদ আলী, গঙ্গাধর তিলক, আবুল কালাম আজাদ, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মদনমোহন মালব্য, শওকত আলী, সুনেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও হাকিম আজমল খা প্রমুখ।

দেশবন্ধুতো ভাসানীর কর্মে উৎসাহে ভরপুর। মানুষের প্রতি নিবেদীত প্রাণবন্ত ভাসানী ধর্মগতভাবে মুসলমান হলেও সকল ধর্মের কৃষক-শ্রমিকদের সাথে একাত্মতা, নিগুঢ় যোগাযোগ ও এই শ্রেণীর প্রতি অকুণ্ঠ ভালবাসায় মুগ্ধ হন দেশবন্ধু। ভাসানী তাঁর বক্তব্যে মুগ্ধ হয়েই ১৯১৭ সালে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের ৩৩তম অধিবেশনে পর্যবেক্ষক হিসেবে রাজনীতিতে অংশগ্রহন। এই সালেই মহীউদ্দিনের নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘটে। সম্মেলনে স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবী উত্থাপিত হয়। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ১৯৯৯ সালের মার্চ মাসে কুখ্যাত রাউলাট বিলস্ পাশ করলে কংগ্রেস এই আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ভাসানী মাস কয়েকের মধ্যে কংগ্রেসে যোগদান করেন।

১৯২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর কোলকাতায় লাল রাজগত রায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের সভায় প্রতিনিধি হিসাবে যোগ দেন এবং খেলাফত আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় গ্রেফতার হয়ে সপ্তাহখানেক জেলে থাকেন। ১৯২২ উত্তর বঙ্গের অভাবনীয় অভাবসহ বন্যা পরিস্থিতি ভাসানীর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনে বিপুলভাবে সাড়া দিয়েছিল। তখন শান্তাহার জংশনে কোমর সমান পানি। ভাসানী রিলিফ দিতে সাথে গেছেন সেখানে।

একদিন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস বাংলার বিপ্লবী সন্তান সুভাষবসুকে নিয়ে হাজির এবং ত্রাণের পোটলা নিয়ে দেশবন্ধু পানিতে নেমে যান। তখন সকলেই তার সাথে নেমে পড়েন। কথাটা এখানে বলারহেতু যেখানে যেখানে বড় জলোচ্ছাস, বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ সেখানে ছিলেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি হতে থাকেন, জনগণের বিশ্বস্ত। ভাসানী কারাগারে থেকেই কারাবন্দী সকল রাজবন্দীদের মুক্তির জন্য নানাভাবে প্রচেষ্টার সাথে অনশন ধর্মঘট পালন করেছেন ও ৩৫ দিন রোজা রেখেছেন ।

১৯৫৪ সালের ফজলুল হকের নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর মওলানা ভাসানী বিশ্বশান্তি পরিষদের পূর্বপাকিস্তান শাখার সভাপতি হিসেবে সুইডেনের রাজধানী স্কটহোম-এ অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি সম্মেলনে যোগদান করে বাংলায় অবিস্মরণীয় বক্তব্য রাখেন। এই সময়কালের ১২ ডিসেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দী লন্ডনে গিয়ে ভাসানীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি তাঁকে বলেছিলেন, মার্কিনের পরামর্শে পাকিস্তানের চক্রান্তকারীরা যুক্তফ্রন্টে ভাঙ্গন সৃষ্টি করতে চেষ্টা করছে। তাই মন্ত্রীত্বপদে যোগ না দিয়ে, অপেক্ষা করতে বলেছিলেন। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী তাঁর পরামর্শ না শুনে প্রথমে আইনমন্ত্রী ও পরে প্রধানমন্ত্রী হন।

অতঃপর ১৩ মাসের মধ্যে তিনি বরখাস্তও হন। ১৯৫৬ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যোগদানের আগেই ১৯৫৬ সালে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ভুখা মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়ে ৩ জন মিছিলকারীকে হত্যা করে।

সোহরাওয়ার্দী ১২ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যোগদান করে। ঢাকায় এসে পল্টন ময়দানে ভাষণ দেন। ভাসানী দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় সরকারের কাছে দাবী পেশ করলেও দাবী মানে না। মওলানা ভাসানী ৭মে থেকে ১৭ দিন অনশন ধর্মঘটে থাকার পর কেন্দ্রীয় সরকার অর্থ বরাদ্ধ ও বিদেশ থেকে ধান আমদানি করলে অনশন ভঙ্গ করেন। এখানে বলে রাখা ভাল ১৯৫৫ সালের ২১ থেকে ২৩ অক্টোবর মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের দিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে পাকিস্তান-মার্কিন সামরিক চুক্তি সিয়াটো-সেন্টো প্রভৃতি চুক্তি ও স্বায়ত্ত্ব শাসনের পক্ষে-বিপক্ষে নিয়ে বিভক্তি দেখা দেয়। ভাসানী পক্ষ এইসব চুক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির পক্ষে এবং স্বায়ত্ত শাসনের দাবীতে অনড় থাকে।

পক্ষান্তরে সোহরাওয়ার্দী সাহেবরা পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিকে সমর্থনের মধ্য দিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে দাড়ায়। তাদের স্পষ্ট বক্তব্যে বেরিয়ে আসে সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হওয়া ও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা মানেই যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার ও স্বায়ত্ব শাসনের ৯৮ ভাগই দেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রণোদিত সংবিধান মতে পূর্ব বাংলা হয়ে যায় পূর্ব পাকিস্তান ও দেশের নাম হয় ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান। ভাসানী এই সংবিধানকে অগতান্ত্রিক গণবিরোধী বলে আখ্যায়িত করেন।

 

অনুসরনীয় সাংগঠনিক ব্যক্তিত্ব ভাসানী ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাগমারীতে আওয়ামীলীগের কাউন্সিল অধিবেশন ডাকেন। এই সম্মেলনকে কেন্দ্র করে কাগমারী সম্মেলনের ডাক শীর্ষক প্রচার পত্রে ভাসানী বলেন, ‘সাড়ে ৪ কোটি বাঙ্গালীর বাঁচার দাবী স্বায়ত্ব শাসনের ডাক এবং ২১ দফা আদায়ের ডাক। চাষী, মজুর, কামার-কুমার ব্যবসায়ী বুদ্ধিজীবি, শিল্পী তথা সকল শ্রেণীর মিলনের ডাক ইত্যাদি। ভাসানীর চিন্তা চেতনার সাক্ষীর সাংস্কৃতিক সম্মেলনের নামে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহার লাল নেহেরু, মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দুল নাসের, চীনা উপপ্রধানমন্ত্রী, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রমুখ ছিলেন আমন্ত্রিত অতিথি। গান্ধী, নজরুল, মৌলানা মোহাম্মদ আলী, নেহেরু, তিতুমীর, লেলিন, স্তালিন ও গাজ্জালী প্রমুখ মহান ব্যক্তিদের নামে ৫৭টি ৫৭টি তোরণ নির্মাণ করেছিলেন। ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগের এটাই ছিল শেষ নির্বাহী অধিবেশন।

১৯৫৬ সনের শেষ দিকে ভাসানী তার দুরদর্শিতা দিয়ে বুঝে সিদ্ধান্ত নেন তিনি আওয়ামী লীগ করবেন না। এই অধিবেশনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সোহরাওয়ার্দী ও পূর্বপাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান উপস্থিত ছিলেন। অথচ গণদাবীর ২১ দফায় উল্লেখিত স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবী পূরন হয়নি। বরং মার্কিন সাম্রাজ্যেবাদের পক্ষপাতিত্ব করা হচ্ছে। যদিও তিনি ছিলেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ১৮ মার্চ আওয়ালীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন এবং একই বছর ২৫ জুলাই ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ন্যাশনালা আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)গঠিত হয়। তিনি মুসলমানদের প্রচলিত রীতি অনুসারে সাক্ষাতকালে ও বিদায়কালে সালাম বিনিময় করে। মওলানা ভাসানী পাকিস্তানকে বিদায়ী সালাম জানান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৬৯সালের আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে মওলানা ভাসানী বলিষ্ট ভুমিকা পালন করেন এবং আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীদের মুক্তির দাবীতে সোচ্চার হন এবং সফল হন।

১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১২ লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি হলেও পাকিস্তানী শাসকদের কেউ না আসায় ক্ষোভ ও ঘৃনা প্রকাশ করেন। দুর্গত এলাকায় ত্রাণ ব্যবস্থায় অংশ নেয়ার জন্য ন্যাপ নির্বাচন বর্জন করে। ৪ ডিসেম্বর ৭০ ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান দাবী উত্থাপন করেন। উল্লেখ্য, ১৮ জানুয়ারী ৭১ পল্টন ময়দানের জনসভায় স্বাধীনতার ঘোষনাটি প্রদানের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান প্রতি আহবান জানান। ১৯৭১ এর মার্চ মাসে শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলন এর প্রতি সমর্থনও প্রদান করেন। ভাসানী নির্বাচন বর্জন করেন এবং শেখ মুজিবসহ সকলের প্রতি নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানান। উগ্রজাতীয়তাবাদী জোয়ারে ভাসমান শেখ মুজিব শর্তসাপেক্ষে নির্বাচনে অংশ নেন। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করেন। ভাসানী নিশ্চিত ছিলেন নির্বাচনে শেখ মুজিব জিতলেও ক্ষমতা দিবে না ইয়াহিয়া। ঠিক তাই হলো।

অত:পর ‘গোলটেবিল’ নাটক শুরু। মওলানা ভাসানী তাঁর দূরদর্শিতায় বুঝেছিলেন গোলটেবিলের মধ্য দিয়ে সময় কর্তন ও সামরিক শক্তির বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। সেই বিবেচনায় মওলানা ভাসানী পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন জয়ী শেখ মুজিবকে গোলটেবিল বর্জনের আহ্বান জানান। কে শোনে কার কথা। তাই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মোহে গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেন।

তারপর জাতীয় জীবনে নেমে এলো ২৫ মার্চের কালো রাত। ছাত্রজনতা রাজপথে। শুরু হয় যুদ্ধ। মওলানা ভাসানী’র বর্ণাঢ্য জীবনের কথা লিখে শেষ করা দুরূহ। তবে এই মহান মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে তাঁর জীবনের শেষ আন্দোলন ১৯৭৬ সালের ১৬ মে রাজশাহীর ফারাক্কার অভিমুখে বিশাল লংমার্চের নেতৃত্ব দান। ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর তিনি ইহজগত ত্যাগ করেন। জাতি গঠনে ভাসানীর ত্যাগ-তিতিক্ষার মূল্যায়ন অপরিহার্য শর্ত। তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ইতি টানছি।

 

By SK Mazid Mukul

প্রধান সম্পাদক, গণপ্রহরী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *