যানজট এখন যানজটে সীমাবদ্ধ নেই। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ও লেখা লেখিরও শেষ নেই। সভা-সেমিনারে সরকারের কাছে যানজট থেকে মুক্তির দাবী যেমন উত্থাপিত হচ্ছে। তেমনি করণীয় নিয়ে বিশিষ্টজনেরা পরামর্শ কম দেননি ও দিচ্ছেন না। সংবাদপত্রসহ বিভন্ন গণমাধ্যমও করণীয় বিষয়ে দিক নিদের্শশনাও দিচ্ছেন প্রায় নিয়মিতই। বিশেষত রাজধানীকে যানজটমুক্ত করতে সোচ্চার। বেশী বললে বলতে পারি, প্রতিদিনই একাধিক গণমাধ্যমে যানজটের দুর্ভোগ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত-পরিবেশিত হচ্ছে। নিজেও পাঠক প্রিয় গণপ্রহরীতে যানজটের সড়কে দুর্ঘটনার কথা নিয়ে ধারাবাহিকভাবেও বেশ কিছু প্রতিবেদন লিখেছি। যদিও সময়ের অভাবে ও ব্যস্ততার কারণে অনেক দিন লিখতে পারিনি।

আজ বিবেকের তাগিদে বাধ্য হলাম, লেখার মাধ্যমে একটু স্বস্তি পেতে। যখন জীবন দিয়ে নতুন করে বুঝলাম যানজট এখন মহাজট বা মহাযানজটে রূপান্তরিত হয়েছে। ঢাকায় পিতার কর্মস্থল হওয়ায় শৈশব থেকে যাত্রাবাড়ী-কদমতলী থানাধীন ধনিয়া এলাকায় বসবাস। পেশাগত কাজে যোগ দেয়ার পর এলিফ্যান্টরোডস্থ গণপ্রহরী কার্যালয়ে যাতায়াত। পাশাপাশি আইসিটি প্রকল্পের ই-লার্নিং এন্ড আর্নিং ইনস্টিটিউটে একটি প্রশিক্ষন কোর্সে অংশ নিতে কল্যানপুরে যাতায়াত রাজধানীর রাজপথ ধরে। শনিরআখরা থেকে প্রায় নিয়মিত যাতায়াতে জীবন দিয়ে যা দেখছি ও উপলব্ধি করছি সে ভিত্তিতে লিখছি বটে।
তবে গণপ্রহরীর প্রধান সম্পাদক-মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক-কলাম লেখক এসকে মজিদ মুকুলের শিক্ষা-ধৈর্য ও তার লেখাও আমাকে লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে। তিনিতো গণপ্রহরীসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় যানজট ও সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে ঘুরে ফিরে লিখতেন ‘যাজনট থেকে জীবনজট’ নিয়ে। আমি দেখছি, লেখালেখিতে ও বলাবলীতে কাজ যেটা হচ্ছে, তাহলো যানজট থেকে
নগমহাযানজট! সেই মহাযানজট থেকেরবাসীসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আগত মানুষের ‘মুক্তি’ কত দূরে। অর্থাৎ মহাযানজট থেকে মুক্তি কতদূরে (?) প্রশ্নকে সামনে রেখে। কেননা, অপরিকল্পিত নগরায়ন, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেনীর দুর্নীতিবাজ সদস্য ও কথিত মালিক-শ্রমিক সংগঠণের ভূমিকায় নিবন্ধনহীন যানবাহনের জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি। সেই সাথে স্থানীয় মাস্তানদের বিভিন্ন এলাকার ফুটপাত দখলসহ অদৃশ্য কিছু কারণে যানজট জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। এমনকি যানজট কমাতে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং পদ্মাসেতু করা হয়েছে, তাতেও যানজট চেহারার পরিবর্তন হয়নি বরং বেড়েই চলেছে যানজট, নষ্ট হচ্ছে কর্মঘন্টা। তার প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে।

যানজট নিয়ে বেশী বললেও যথাযথ মনে হবে না যে, অফিস আদালত, শিল্প-কলকারখনা প্রধানত রাজধানীতে। সে কারণে রাজধানীতে বসবাসকারী নগরবাসী এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত মানুষের কারণেও যানজট বটে। তবে যানজট কমাতে সেসব রাতারাতি স্থানান্তর করা যেমন সম্ভব নয়। তেমনি কৃষি জমি না কমিয়ে ও পরিবেশকে প্রাধান্য দিয়ে পাশর্^বর্তী এলাকায় স্থানান্তর করাও দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ। এমনকি পরিকল্পনা গ্রহণে ও বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থ যোগানও সম্ভব নয়। তাই এ মূহুর্তে নতুন ভাবে রাজধানীতে আর কোন অফিস বা শিল্প-কলকারখানা নয়। বরং যৌক্তিক বিবেচনায় এবং দেশের মানুষের কর্মসংস্থানে বিভাগীয় শহর এবং বিভাগীয় জেলা শহরের অফিস-আদালত ও শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা যেতে পারে। এতে যানজটও কমবে এবং মানুষের কর্মসংস্থানও হবে। সেই সাথে বিদ্যমান যানজটের আলোচিত যৌক্তিক কারণ সমূহ চিহ্নিত করে কার্যকরভাবে তার সমাধান করতে হবে।
রাজধানীতে চলাকালে সবারই চোখে পড়ে এবং আমিতো অহরহই দেখছি, মতিঝিল অফিসপাড়াসহ বিভিন্ন অফিস ও বানিজ্যিক এলাকার একজন বা একাধিক যাত্রী বহনকারী প্রাইভেট গাড়ীর দখলে রাস্তা/ সড়কের চার ৪ ভাগের ৩ ভাগই। স্ট্রাটেজিক ট্রান্সপোর্ট এসটিপি’র হিসাব মতে, ঢাকায় কমবেশি ১৫% যাত্রী প্রাইভেট গাড়ীতে যাতায়াত করেন। তাদের হিসাব মতেই সড়কের ৭০ শতাংশের বেশি জায়গা তাদের দখলে থাকে। তাহলে ৮৫ শতাংশ যাত্রী বহনকারি গণপরিবহন ৩০ শতাংশ জায়গা ব্যবহারের সুযোগ পান। উপরন্তু ঢাকার সড়কগুলো যে পরিমাণ গাড়ী চলাচল ধারণের ক্ষমতা তার চেয়ে ৩০-৪০ শতাংশ বা তার কিছু বেশি গাড়ি চলাচল করে। তারও বেশি দখলে আছে অবৈধ পার্র্কি ও নানা ধরণের দখলদারদের হাতে।

বিগত সরকারের উন্নয়নের জোয়ারকালে দিনের বেলা শহরে ট্রাক ও আন্তনগর বাসের প্রবেশ বন্ধ করাসহ যানজট নিরসনে নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছে। বিভিন্ন রাস্তায় রিকশা চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। পথচারী পারাপারে ফুটওভার ব্রিজ ও আণ্ডারপাস তৈরী করা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি। বরং নিয়মিত আমার চলাচলে নির্ধারিত রাস্তাসহ বিভিন্ন কাজে বিভিন্ন পথে শুধু দেখছি না, যানজটে অস্থির সময় পার করতে, প্রায় নিয়মিতই দেখছি গাড়ী যেন চলেই না। শণিআখরা থেকে কল্যাণপরু যাতায়াতেই চার-পাঁচ ঘন্টা (সময়ে ছয় ঘন্টাও) সময় লাগে। দু’ঘন্টা সময়ের প্রশিক্ষণ কাজে যাতায়াতে এতটা সময় নষ্ট হচ্ছে, শুধু মহাযানজটের জন্য। এর সাথে যোগ হয়ে থাকে এক লাইনে পরিবহণের রেষারেষি, বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠা নামা করা, ইত্যাদি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সবেমাত্র ট্রাফিক পুলিশসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে।
ইতিমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) শীর্ষ কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের সিটি ট্রাফিক সিষ্টেম বিশেষজ্ঞদের বৈঠককালে পরিবহণ ও ট্রাফিক সিষ্টেম বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন প্রসঙ্গত বলেছেন, যানজটের কারণে প্রতিবছর দেশের অন্তত: ৪০ হাজার কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা এ বিষয়ে সমাধান খুঁজতে নির্দেশ দিয়েছেন। এখন কার্যকর ব্যবস্থা দেখার অপেক্ষাই বলে দিবে মহাযানজট থেকে মুক্তি কত দূরে (?)
