Mon. Sep 1st, 2025
মুক্তিযুদ্ধের ঘাঁটি এলাকা ও সিরাজ সিকদারের মৃত্যুবার্ষিকীমুক্তিযুদ্ধের ঘাঁটি এলাকা ও সিরাজ সিকদারের মৃত্যুবার্ষিকী

কেএস মৌসুমী : মুক্তিযুদ্ধের ঘাঁটি এলাকা ও সিরাজ সিকদারের মৃত্যুবার্ষিকী। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের বরিশালের পেয়ারাবাগান খ্যাত এলাকাকে মুক্তিযুদ্ধর ঘাঁটি এলাকা হিসেবে গড়ে তুলে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার প্রধান সংগঠক নেতা কমরেড সিরাজ সিকদারের ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকী পালনের আহ্বান জানানো হয়েছে।

 পেশাগতভাবে শ্রমিক পরিচয়দানকারী এক ভদ্রলোক বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন ও বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের যৌথ মুখপত্র ‘আন্দোলন’ পত্রিকার একটি কপি নিয়ে গণপ্রহরী ডেস্কে হাজির। আন্দোলন পত্রিকার সাথে ম্যাগাজিন সাইজের পুরনো গণপ্রহরী পত্রিকায় ‘অবশেষে মুক্তিযুদ্ধের পেয়ারা বাগান ঘাঁটি এলাকার ৫০ বর্ষপূর্তি উদযাপন (!) শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের একটি ফটো অনুলিপি দিয়ে দুটো বিষয় নিয়ে একটু খবর প্রকাশের অনুরোধ জানান। গণপ্রহরী পত্রিকাটি তাঁর কাছে সংরক্ষিত রয়েছে বলেও জানান। ভদ্রলোককে এক কাপ চা খাওয়ার অনুরোধ করলে তিনি কাগজটি দিয়েই তার পেশাগত কর্মক্ষেত্রে ফিরে যাবেন মর্মে অনুমতি নিয়ে এসেছেন বলেই, বিদায় নেন।

আন্দোলন পত্রিকাটিতেই মাওবাদী নেতা কমরেড সিরাজ সিকদারের ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের আহ্বান জানানো হয়েছে। ওই সময়ের ডেস্কের সিদ্ধান্ত মতে বিষয়টি নিয়ে কদিনের চলার পথে কথায় কথায় জনমত জানার চেষ্টা। তাতে ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী বাকশালী মুজিব সরকার বন্দি অবস্থায় এই বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ সিকদারকে হত্যা করে রক্ষী বাহিনী তাদের গাড়ীর সাথে রশি দিয়ে বেঁধে টেনে হেচড়ে সাভার থেকে ঢাকায় নিয়ে আসে। খবরটি নিশ্চিত হয়ে শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় সংসদে দাড়িয়ে গর্ব করে বলেছিলেন- আজ কোথায় সিরাজ সিকদার?

মুক্তিযুদ্ধের ঘাঁটি এলাকা ও সিরাজ সিকদারের মৃত্যুবার্ষিকী শিরোনামে প্রতিবেদনের জনমতে বাম প্রগতিশীল দেশ প্রেমিক রাজনীতিকদের অনেকেই শেখ মুজিব-হাসিনার স্বৈর শাসন ও ভারতের কর্তৃত্ব নিয়ে কথা বলতে বীর মুক্তিযোদ্ধা কমরেড সিরাজ সিকদারকে হত্যা ও সংসদে শেখ মুজিবের দাম্ভিক উক্তিটি আলোচনায় বলে থাকেন। অনেকের মতে রুশ-ভারতের নীল নকশায় এবং ভারতের আগরতলায় ভারতের প্রতিনিধি ও আওয়ামী নেতৃবৃন্দের পূর্ব পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রমূলক সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক, পাকিস্তানের সামরিক সরকারের দেওয়া নির্বাচনে নির্বাচিত পাকিস্তানী এমএনএ, এমপিএ-দের নিয়ে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। ফলশ্রুতিতে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব ছিনতাই হয়। সে কারণেই পতিত স্বৈরাচার হাসিনা সরকার দেশকে ভারতের অনুগত রাষ্ট্রে পরিণত করে।

উপরোক্ত বাস্তবতায়ই এক নদী রক্ত দিয়েও বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি আসেনি। আজকে শহীদদের আত্মত্যাগকে স্বার্থক করতে দুনিয়ার মজদুর, নিপীড়িত জাতি ও জনগণকে এক হতে হবে। সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ-আমলা-মুৎসদ্দি-পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা বদলাতে হবে, সমাজ বদলাতে হবে। অন্যথায় একাত্তরে ভৌগলিক স্বাধীনতার পরও বার বার যেমন জীবন দিতে হচ্ছে ছাত্র-জনতাকে তেমনটাই দিতে হবে মুক্তির জন্য। কেননা, প্রকৃত স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রই আসেনি। এইতো জুলাই-আগস্টের রক্ত দিয়েও বৈষম্যহীন বা বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে নেই গণঅভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকার। সেক্ষেত্রে শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখাও হয়েছে সুদৃঢ় পরাহত।

মুক্তিযুদ্ধের ঘাঁটি এলাকা ও সিরাজ সিকাদারের মৃত্যুবার্ষিকী শীর্ষক প্রতিবেদনের জনমতে দেশপ্রেমিক প্রগতিশীল বিপ্লবাকাংখী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী ভিন্ন ভিন্ন জন ভিন্ন ভিন্ন মতামত প্রকাশ করেছেন। অনেকেই রাজনৈতিক চেতনায় ও পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থাধীনে পরিচালিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার বাস্তবতায় এমন কর্মসূচী অনেক আগে থেকেই করে আসা উচিত ছিল মন্তব্য করেন এবং আক্ষেপের সাথে কেও বলেছেন ‘অবশেষে পেয়ারা বাগান আলোচনায় এলো (!)’ আবার কেউ বলেছেন, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য বাস্তবায়নে শুধু পেয়ারা বাগান ঘাঁটি এলাকা এবং কমরেড সিরাজ সিকদার নয়, দেশের নাটোরের আত্রাই, পাবনা, খুলনার ডুমুরিয়া ও নরসিংদীর শিবগঞ্জসহ আরো অনেক এলাকায় যেসব সংগঠন ও ব্যক্তির নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল এবং যার যার সুবিধা অনুযায়ী এবং যার যার চিন্তা- চেতনা ও রাজনৈতিক লাইন নিয়ে মুক্তাঞ্চল বা ঘাঁটি এলাকা গড়ে তুলে যুদ্ধ করেছেন। আবার কারো মতে সেদিনের সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের সরাসরি হস্তক্ষেপের সাথে ভারতে আশ্রিত নেতৃবৃন্দের ভূমিকা ও সীমান্ত এলাকার বাস্তবতা এবং মুক্তাঞ্চল সমূহে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন ও ব্যক্তিদের অনেকেরই নানাবিধ সুবিধাবাদী পন্থা অবলম্বন করা ইত্যাদি তথা সবগুলো যুদ্ধ ও বাস্তবতার সবকিছুকেই মূল্যায়ন করে তাদের অবদানকে তুলে ধরতে হবে। যাতে করে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে ইতিহাস তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দেয়। সেই সাথে জনগণের অর্থে পরিচালিত রাষ্ট্রের দেয় সুবিধাদিসহ জনগণের মৌলিক অধিকার ভোগ নিশ্চিত করতে হবে। কেননা, কোন ত্যাগই বৃথা যেতে পারে না- এটা ইতিহাসের স্বাক্ষী ।

প্রসঙ্গত : উল্লেখ্য যে, ইতিহাস বিকৃত করার অভিযোগ নিয়ে আলোচনা দেশে আছে। তবে আলোচনায় তেমনটা নেই ইতিহাসে সত্যকে পাশ কাটানো; যা আড়াল করাও ইতিহাস বিকৃত করার সামিল । যদি সেই সত্য ‘সূর্য পূর্ব দিকে উঠে পশ্চিম দিকে অস্ত যাওয়ার মতই সত্য হয় । তেমন একটি উদাহরণ তুলে ধরেই উপরোক্ত ত্যাগের অবদান সম্বলিত তথ্য সংগ্রহ ও মূল্যায়নে অর্ন্তভূক্ত করা বিষয়ে ভাবতে আহ্বান জানাবো। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জামুকা কর্তৃপক্ষ সহ সরকারের আশু হস্তক্ষেপ কামনায় যে কথাটি না বললেই নয়।

তাহলো, স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা হিসেবে শোষণমুক্ত সমাজের স্বাধীন দেশের জন্য মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী গড়ার মধ্য দিয়ে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করা হয়। জনগণতান্ত্রিক সরকার গঠনের লক্ষ্যে বিপ্লবাকাংখী ছাত্র যুবকদের সমন্বয়ে ১১নং সেক্টরাধীন ঐতিহাসিক রৌমারী মুক্তাঞ্চল ও প্রথম মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী গড়ে তুলে শেষাবধি মুক্ত রেখে, রাজনৈতিক সচেতন মুক্তাঞ্চলবাসীর সার্বিক সহযোগিতার উপর নির্ভর করে, ভারতে না গিয়ে মুক্তাঞ্চল থেকে যুদ্ধ পরিচালনায় নিয়োজিত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে আজকেও স্বীকৃতি পাননি। এমনকি যারা ইতিহাস লিখেছেন ও রৌমারীর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন তারাও এই সত্য কথাটি তুলে ধরেননি। যদিও সার্বিক ব্যয়ভার বহন করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত মুক্তাঞ্চলবাসী। কারণ বর্ণিত ভূমিকা পালনকারীরা মূলত সাংগঠনিকভাবে পূর্ববাংলা ছাত্র ইউনিয়ন, কৃষক সমিতি, শ্রমিক আন্দোলন ও ন্যাপ (ভাসানী) সমন্বয়ে গঠিত ছিল মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী।

মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী অনুমোদিত এসকে মজিদ মুকুলের নেতৃত্বাধীন ভাসানী বাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা সদস্যদের সাথে সুবেদার আলতাফসহ একটি সেনা দল মুক্তাঞ্চলে গিয়ে যোগ দেন। সংগঠক নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে পরিচালিত যুদ্ধের নীতি কৌশল মেনে ও ভাসানী বাহিনীর প্রধান এসকে মজিদ মুকুলকে যুদ্ধের নীতি কৌশল নির্ধারক-পরামর্শক উপদেষ্টা ও সম্মুখযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। অত:পর মুক্তাঞ্চল টিকিয়ে রেখে যুদ্ধ পরিচালনায় নিয়োজিত মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীটি সেনাবাহিনীর থার্ড বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২ এমএফ কোং হিসেবে অনুমোদিত এবং জেডফোর্স অন্তর্ভুক্ত। ফলে তারা ঐক্য ন্যাপের তালিকায়ও নেই, সরকারের স্বীকৃতও মেলেনি। যদিও কোম্পানী কমান্ডার সুবেদার আলতাফ নামে বহুল পরিচিত অনারারি ক্যাপ্টেন (অব:) আফতাব আলী বীর উত্তম, বীর প্রতীকের স্বাক্ষরিত সনদপত্রসহ তারা আবেদনের পর আবেদন করে যাচ্ছেন। বেঁচে থাকা বাহিনী প্রধানের মাধ্যমে। সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীও মুক্তাঞ্চল রৌমারীতে বিশাল মুক্তিযোদ্ধা জনসমাবেশে আবেদিতদের তালিকাভুক্ত করার কথা দিয়ে এসেছিলেন। যাদের বেশীর ভাগই অনলাইনে ব্যক্তিগতভাবে জামুকায় আবেদনও  করেছেন। যদিও ইতিহাসের শিক্ষা বলছে জাতীয় সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হলে যার যতটুকু অবদান ছিল তা ইতিহাসে উল্লেখ থাকতো এবং শোষণমুক্ত সমাজের স্বাধীন দেশ গড়ার মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যও অর্জিত হতো। তাতে শহীদদের আত্মত্যাগ স্বার্থক হতো। একইভাবে আজকের প্রতিবেদনের আলোচিত বিষয়টিও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকতো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *