Sat. Jul 12th, 2025
মেজর ডালিম-ই বেতারে মুজিব হত্যার প্রচার করেমেজর ডালিম-ই বেতারে মুজিব হত্যার প্রচার করে

গণপ্রহরী ডেস্ক : মেজর ডালিম-ই বেতারে মুজিব হত্যার প্রচার করে। বঙ্গবন্ধু খ্যাত শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতার জন্য সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের সাথে দফায় দফায় আলোচনা করে সফল হন না। অবশেষে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা না করেই তার পরিবারের ভোরণ-পোষনের দায়িত্ব পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হাতে অর্পন করে সেনাসদস্যদের নিরাপত্তায় পাকিস্তান চলে যান।

অত:পর মুক্তিাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে রক্তার্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। রাষ্ট্রক্ষমতায় বসেই যেন তিনি নিশ্চিত হন, তাঁর দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়েই রাষ্ট্র ক্ষমতা পেয়েছেন। তিনি এ দেশের জনগণের প্রতক্ষ্য ও পরোক্ষ অংশগ্রহণ ও ভূমিকায় এবং বীল মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন-মরণ মুক্তিযুদ্ধে রক্তার্জিত স্বাধীনতাকে এবং মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনকে পাশ কাটিয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসন-শোষণ ও লুটপাটের জগদ্দল পাথর চাপিয়ে দেন দেশের আপামর মানুষের ঘাড়ে। মানুষ আবারো দিশেহারা হয়ে যান।

পক্ষান্তরে তিনি ভারতীয় স্বার্থকে সম্বল করে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর তত্বাবধানে পরিচালিত রক্ষী বাহিনী গঠন করে তার নির্দেশে প্রণোদীত সংবিধানকে সংশোধন করে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় দেশব্যাপী এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন। হাজার হাজার দেশপ্রেমিক-বিপ্লবীদের কণ্ঠরোধ করতে হত্যা করেন। যে দেশের জন্য একমাত্র দল হিসেবে বাকশাল কায়েম করেন। যে দেশের শেখ মুজিব সুস্থ্য শরীরে দেশে ফেরার রোজা রেখেছেন এবং নিয়মিত স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করেছেন। সেই মানুষ শেখ মুজিবের হাত থেকে মুক্তির জন্য উতালা হয়ে উঠেন। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদশে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনা অভ্যূত্থান সংঘটিত হয়। শেখ মুজিব স্বপরিবারে নিহত হন। এ ঘটনা বেতারের মাধ্যমে সেনা অভ্যূত্থাকারীদের পক্ষে মেজর ডালিম-ই প্রথম দেশবাসীকে জানান। ক্ষণিকের মধ্যে মানুষের মুখে মুখে প্রচার হতে থাকে, মেজর ডালিম রেডিওতে (বেতারে) বলেছেন, খুনি মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। সারাদেশ উল্লাসে ফেটে পড়ে।

দীর্ঘদিন পর মেজর ডালিম বীর বিক্রম নামে পরিচিত লে. কর্ণেল শরিফুল হক ডালিম প্রবাসী জীবনে থেকে প্রবাসী সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেনের ইউটিউব চ্যানেলে লাইভ সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন। চব্বিশের আন্দোলন-সংগ্রাম তরান্বিত করতে প্রবাস থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে ক’জন সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন এবং যুক্তিযুক্ত তথ্য জনগণকে উদ্বদ্ধুকরেছেন তাদেরই অন্যতম একজন ইলিয়াস হোসেন। অন্যান্যদের মধ্যে সফল গণঅভ্যূত্থানে সামনের সারিতে না থেকেও দিক-নির্দেশনায় জনগণকে উজ্জীবিত করা সাংবাদিক যোদ্ধা পিনাকী ভট্টাচার্য, কনক সরোয়ার, অধ্যাপক তাজ হাশমী, কর্ণেল আব্দুল হক এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনগণকে বক্তব্যের মাধ্যমে সাহসী করেছেন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহামন, মুনির রশীদ প্রমুখ। এবার দেখা যাক লাইভ সাক্ষাৎকারে বীল মুক্তিযোদ্ধা মেজর ডালিম কি বলেছেন–

শরিফুল হক ডালিম। যিনি মেজর ডালিম নামে পরিচিত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা । তার বিরুদ্ধে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারকে হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকা মেজর শরিফুল হক ডালিম রোববার রাতে প্রবাসী সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেনের ইউটিউব চ্যানেলের লাইভ টকশোতে কথা বলেন। ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর ডালিম (বীর বিক্রম) স্পেশাল লাইভে যোগ দিচ্ছেন’ শিরোনামে লাইভে যোগ দেন সাবেক এই সামরিক কর্মকর্তা। 

টকশোতে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পেছনের ইতিহাস তুলে ধরেন বিদেশে প্রবাসে আলোচিত এই প্রাক্তন সামরিক কর্মকর্তা। এর চুম্বক বিভাগটি হাইলাইট করা হয়েছে যেমন-

শুরুতেই মেজর ডালিম বলেন, আমি দেশবাসীকে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের, যারা ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে আংশিক বিজয় অর্জন করেছে তাদের অভিনন্দন জানাই। সঙ্গে লাল হেলমেট। বিপ্লব যে কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রে একটি চলমান প্রক্রিয়া। সে অর্থে তাদের বিজয় এখনো পুরোপুরি অর্জিত হয়নি। তার আরও সময় দরকার।

২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের নেপথ্যে থাকা শিক্ষার্থীদের উপদেশ দিয়ে তিনি বলেন, ‘পরিপূর্ণতা অর্জনের পর তাদের এমন অবস্থানে থাকতে হবে যেখান থেকে তারা নীতি নির্ধারণ করতে পারে। তাদের চাওয়া, চাহিদা এবং প্রত্যাশা জনগণের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব তাদের।

মেজর ডালিম বলেন, ‘সম্প্রসারণবাদী-হিন্দুবাদী ভারত আমাদের প্রায় তার খপ্পরে ফেলেছে। সেই অবস্থান থেকে ৭১-এর মতো আরেকটি স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। তা না হলে বিপ্লব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।

তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের আগে শেখ মুজিবের চরিত্র ছিল এক। বাঙালি জাতীয়তাবাদের সংগ্রামে তিনি অবদান রাখেন। ২৫ ও ২৬ মার্চ রাতে যখন পাকিস্তানি বাহিনী নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করে। যাতে বিনা কারণে প্রাণ হারায় লাখ লাখ, হাজার হাজার শিশু, নারী ও পুরুষ। তখন সেই অবস্থায় তথাকথিত নেতাদের কাউকে পাওয়া যায়নি। তারা তখন নিজেদের জীবন বাঁচিয়ে বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়। মুজিব নিজে আত্মসমর্পণ করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে। তিনি তাদের সাথে বসতি স্থাপন করেন এবং পরিবারের জীবিকা পাকিস্তানের হাতে ছেড়ে দেন।

ডালিম বলেন, মানুষ তখন দিশেহারা হয়ে পড়েছিল এবং কী করবে বুঝতে পারছিল না। কোথায় যাবে, কিভাবে জীবন বাঁচাবে। সে সময় চট্টগ্রাম থেকে মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ডাক আসে। আমি তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ছিলাম। সেই আহ্বানে দেশের মানুষ আলোর রশ্মি দেখেছিল। এভাবে মৃত্যু এড়াতে লড়াই করতে হবে। এরপর মুক্তিযুদ্ধের ডাকে সাড়া দিয়ে গড়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধ। আমরা বসে থাকিনি। যাদের সাহস ও দেশের প্রতি ভালোবাসা ছিল তারাই সংগ্রামে যোগ দেয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের কারণ জানতে চাইলে মেজর ডালিম বিস্তারিত জানান। তিনি বলেন, ‘খুব স্পর্শকাতর প্রশ্ন। আপনি নিজের গান চালাতে পারবেন না। প্রথমত, ১৫ আগস্ট কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়। আমরা বুঝতে পারি কার স্বার্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে? এটা কি আমাদের স্বার্থে যে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করব? নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য কাজ করছে।’

এই বীর বিক্রম বলেন, ‘নজরুল ইসলাম যখন সাত দফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন, তখন তাজউদ্দিনকে অস্থায়ী সরকার গঠনের অনুমতি দেওয়া হয়। সাতটি ধারা পড়ে স্বাক্ষর করার পর নজরুল ইসলাম ফিট হয়ে যান। এটা একটা দাস রাষ্ট্র যে আমরা ধীরে ধীরে ভারতে অনুগত রাষ্ট্র-অংগ রাষ্ট্রে পরিণত হব।’

মেজর ডালিম বলেন, শেখ মুজিব যখন মুক্তি পান, তিনি কিছুই জানতেন না। দেশ স্বাধীন হলো, নাকি মুক্তিফৌজ বলে কিছু ছিল। তিনি জানতেন না যে হাজার হাজার মানুষ দেশ ছেড়ে প্রাণ হারিয়েছে। মুক্তি পেলে মুজিব ইন্দিরা গান্ধীকে ডেকে বললেন- আমি দেশে ফিরে যাচ্ছি। আমি যাওয়ার আগে আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। তখন গান্ধী বললেন, তুমি না ডাকলে আমি তোমাকে ডাকতাম। নয়াদিল্লি হয়ে ঢাকা যাবেন। মুজিব তাই করলেন, তিনি লন্ডন হয়ে নয়াদিল্লি গেলেন।

মুজিব দেশে ফিরে আসেন। নিজের ক্ষমতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মুজিবকে দিয়ে ভারত নিরাপত্তা বাহিনী তৈরি করেছে। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে দুর্বল করে সেনাবাহিনীকে শুধু নামেই রাখবে। মুজিব একদলীয় স্বৈরাচারী, স্বৈরাচারী শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিজেকে আজীবন রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করার কথা ভাবছিলেন। এই ব্যাংকের সকল সদস্য। এরপর মুজিবের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তার নিষ্ঠুরতা এমন অসহনীয় পর্যায়ে চলে গিয়েছিল, যে মানুষ একদিন মুজিবের জন্য প্রার্থনা করেছিল- এই মুজিব আমাদের চোখের মণি। মানুষ সেই মুজিবের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছিল আমাদের বাঁচানোর জন্য. মুজিবের হাত থেকে বাঁচাও, আমরা মরে যাচ্ছি।’

টকশোতে মেজর ডালিম বলেন, ‘মুজিব মরেনি, মুজিব সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন’। সামরিক অভ্যুত্থান এখন আর খালি হাতে মার্বেলের খেলা নয়। উভয় পক্ষের গুলিবিনিময় এবং উভয় পক্ষের হতাহতের ঘটনা ঘটে। মুজিবের পক্ষে যেমন কিছু লোক মারা গিয়েছিল, তেমনি কিছু মানুষ সামরিক অভ্যুত্থানকারী বিপ্লবীদের পক্ষেও প্রাণ হারায়। এটাই বাস্তবতা। কিন্তু বিপ্লবীরা জিতেছে, ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে।  

তিনি বলেন, ‘মুজিবের মৃত্যু ও বাকশালের পতনের খবর শুনে শহর, বন্দর ও গ্রামে লাখো মানুষ আনন্দ মিছিল বের করে। যেসব রাজনৈতিক নেতা বা দল আন্ডারগ্রাউন্ড ছিল তারাও জনসমর্থন নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। এভাবেই ১৫ আগস্টের বিপ্লবী সামরিক অভ্যুত্থান জনগণের স্বীকৃতি পায়।

জাতীয় সঙ্গীত প্রসঙ্গে মেজর ডালিম বলেন, “বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবর্তে কাজী নজরুল ইসলাম বা অন্যান্য বিখ্যাত স্থানীয় কবিদের গান হতে পারত। একজন বিদেশী কবির গানকে জাতীয় সঙ্গীত করার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল বলে মন্তব্য করেন তিনি।

শেখ মুজিবের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে মেজর ডালিম বলেন, মুজিব পরিবারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী ছিল তা আমার বইয়ে স্পষ্টভাবে লেখা আছে। সেটা ব্যক্তিগত হোক বা পারিবারিক। কিন্তু আমরা তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। তারা আমাদের বহিস্কার করলে আমরা মেনে নিলাম। তিনি নিজেই আমাকে আর নূরকে রেখেছিলেন।

শেখ মুজিবকে জাতির পিতা উল্লেখ করে মেজর ডালিম বলেন, একজন মুসলিম হিসেবে আমি কাউকে জাতির পিতা, জাতির মাতা, জাতির ভাগ্নে মানি না। এগুলো সঠিক বক্তব্য নয়।

এ সময় মেজর ডালিম তাঁর স্ত্রী অপহরণের বিষয়ে ইলিয়াসের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি একটি মজার ঘটনা। যদিও আমার বইয়ে। আমার এক কাজিন আছে। তার নাম পারভিনা। কর্নেল অলিউল্লাহর সাথে তার বিয়ে ঠিক করলাম। যে আমাদের চেয়ে জুনিয়র। বিয়ে ও অনুষ্ঠান হবে লেডিস ক্লাবে। আমরা উভয় পক্ষই জানি। তখন আমরা কী করলাম, সব আয়োজনের দায়িত্ব আমাদের ওপর বর্তায়। পরিচিত অনেক লোকের সাথে, কাকে রাখব আর কাকে ছেড়ে দেব? দুই পক্ষের দুই থেকে তিন হাজার মানুষকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।

যথারীতি বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হয়। তখন বাপ্পী নামে আমার একজন শালা ছিলেন। তিনি ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। ছুটিতে দেশে আসছেন। অনুষ্ঠানে তিনিও উপস্থিত ছিলেন। আমি ও নিন্মি দুই দলের আয়োজক বলা যায়। সবার খেয়াল রাখা। ছেলেরা যেখানে বসে সেখানে বাপ্পি বসে থাকে। তখন লম্বা চুলের ফ্যাশন ছিল। তিনি অন্যান্য অতিথিদের সাথে বসে ছিলেন। তার পেছনের সারিতে গাজী গোলাম মোস্তফা, তার স্ত্রীও অপর পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন। আমাদের দিক থেকে নয়। মানে ছেলের পক্ষ। পেছনের সিটে বসে আছেন গাজী গোলাম মোস্তফার ছেলে ও স্বজনরা। তাদের একজন পেছন থেকে বাপ্পির চুল টেনে ধরে। বাপ্পী ভদ্র মানুষ, বিদেশে থাকেন, বিদেশে বড় হয়েছেন, কিছু বলেনি। আবার চুল টেনে ধরে।

দ্বিতীয়বার টানার পর বাপ্পী পিছন ফিরে দেখেন একটা ছেলে। তারপর বলল, তুমি চুল টেনেছো? তিনি বলেন, হ্যাঁ, তিনি বলেন কেন? তিনি বলেন, আমরা এত সুন্দর চুল দেখছি। এটা কি সত্যিকারের পরচুলা? আচ্ছা, ভেবে দেখুন, সে ভার্সিটিতে পড়ে, আর এই ছোট ছেলেটি স্কুলেও যায় নি, অথবা ৬ষ্ঠ বা ৭ম শ্রেণীতে পড়তে পারে। অন্তত। তখন বাপ্পি বলেন, দুষ্টু ছেলে। তুমি আর এখানে বসো না। অন্য কোথাও গিয়ে বসো। তারা বেরিয়ে গেল। আমরা কিছুই জানি না। আমি আর নিচের সবাই এত ব্যস্ত, দুদিকে খেয়াল রাখা, খাওয়া-দাওয়া। হঠাৎ দেখি রেডক্রসের দুটি মাইক্রোবাস। আরেকটি সবুজ গাড়ি। গাড়ির আগে ও পেছনে দুটি মাইক্রোবাস এসে থামল। দুটি মাইক্রোবাস থেকে সাদা পোশাক পরা প্রায় আটজন নেমে পড়েন। আর গাজী গোলাম মোস্তফা নামলেন প্রথম গাড়ি থেকে। তার স্ত্রী উপস্থিত থাকলেও মেয়ে মহলে। তিনি গাড়ি থেকে নেমে চিৎকার করতে থাকেন মেজর ডালিম কোথায়? ডালিম কোথায়? বেশি বাড় (দাপট) বাড়ছে। আর সহ্য করতে পারছি না। আমি ভাবলাম কে এমন চিৎকার করছে? একটা ছেলে এল। তিনি এসে বললেন, গাজী গোলাম মোস্তফা তোমাকে খুঁজছে, চিৎকার করছে। তার সঙ্গে আট-দশজন লোক বন্দুক নিয়ে আছে। মনে রাখবেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য সারা দেশে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। আর ঢাকা সদর ছিল একটি রেসকোর্স। আমরাও সেই অভিযানে জড়িত ছিলাম। যাই হোক, বেরিয়ে এলাম। আমি গোলাম মোস্তফার দাড়ানো বারান্দার সামনে। আমি বললাম, আমি মেজর ডালিম। তুমি এসো, বেগম সাহেবাতো ভেতরে আছে, তুমি এসো। বর এবং কনের জন্য প্রার্থনা করে যান।

তিনি বললেন, হারামজাদা আর্মি বাহিনী বাড়ছে, আজ আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব। দেখলাম চার-পাঁচজন লোক স্টেইনগান নিয়ে আমার চারপাশে। আর চার-পাঁচজন দাঁড়িয়ে আছে। আমি বললাম, এটা কি? আমি একজন…(অস্পষ্ট) ব্যক্তি। আমার সেখানে প্রায় চার বা পাঁচটি স্কট আছে। ওয়্যারলেস আছে। আমি যে কোন সময় যে কাউকে কল করতে পারি…. এ কি ধরনের অবস্থা। একটা হুলুস্থল কান্ড এরকম বিয়ের মধ্যে । আমি বললাম, কিছু হয়নি। ব্যাপার কি? তুমি এত উত্তেজিত কেন। বললেন, মাইক্রোতে ওঠো। আমাকে মাইক্রোতে ঠেলে দিচ্ছে। আমি বললাম, কি ব্যাপার? এটা একটা বিয়ে বাড়ি। একটা মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। আর তুমি আমাকে বলছো- ওঠো। চার-পাঁচজন লোক জামাকাপড় ধরে আমাকে তুলে নিল। খবর ভিতরে ঢুকে গেল। নিন্মি আমার শাশুড়ি, আমার খালা শাশুড়ি মানে মেয়ের মা। তিনি বেরিয়ে এলেন। বললেন, কী ব্যাপার?! তারা আমাকে এভাবে মাইক্রোবাসে ঠেলে দিতে দেখেছে। মাইক্রোবাসে উঠলাম। তারাও গাড়িতে উঠে পড়লেন। উঠে দেখি চুল্লু আর আলম নামে দুজন।. তাদেরও পিটিয়ে রক্ত ​​বের করা হয়েছে। মুখ থেকে রক্ত ​​পড়ছে। তারাও মাইক্রোবাসে আহত হয়েছেন। তখন খালা গাজীকে বললেন, কি করছেন সাহেব? গাজী! আমার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। তারা বরের পক্ষ থেকে এবং মেয়ের দিক থেকেও। কি হয়েছে? তারা ব্যস্ত। আমি কি তাদের সঠিকভাবে শেখাবো?। তখন আমার স্ত্রী বললেন, তুমি তাকে (আমাকে) একা নিয়ে যেতে পারবে না। তুমি আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যাও। ঠিক আছে চলুন। তাকেও মাইক্রোবাসে ধাক্কা দেয়। তখন আমার খালা বললেন, মি. গাজী, আপনি বাড়াবাড়ি করছেন। আপনি আমাকে যেখানেই নিয়ে যেতে চান, আমি আপনার সাথে যাব।

গাজী ঢাকা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মেজর ডালিম বলেন, ‘তিনি তখন আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন না, তিনি রেডক্রসের চেয়ারম্যানও ছিলেন।’ মেজর ডালিম বলেন, ‘তখন গাজী ছিলেন ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় লাঠিয়াল সর্দার। অশিক্ষিত মূর্খরা সাধারণত রেড ক্রসের চেয়ারম্যান হয় না। কিন্তু তাকে তৈরি করা হয়েছিল লুটপাটের সুবিধার্থে। যাইহোক, এটি অন্য বিষয়। তারপর আমাদের নিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে প্রথম ফার্ম গেটের দিকে। খামারের গেট দিয়ে ঢোকার পর দেখলাম পাহারাদার ছাউনি দেখে রক্ষীবাহিন যাচ্ছে কিনা ! তারপর ভাবি কি করা যায়। এরই মধ্যে আমার খালা ও নিন্মী তাদের শাড়ি ছিঁড়ে চুল্লু ও আলমকে ব্যান্ডেজ করে, যেখানেই ক্ষত ছিল। আমি হঠাৎ বললাম, গাড়ির ড্রাইভার থামাও। মেইনটাইমে স্বপন ও বাপ্পী কিছু অতিথিকে গাড়িতে করে বাসায় নিয়ে গেলেন হয়তো বা গাড়ি আসতে দেরি করছে। তাই গাড়ি থামাতে বললাম। ড্রাইভার গাড়ি থামাল। আমার গাড়িতে স্টেইন বন্দুক নিয়ে প্রায় চারজন লোক। তারপর লোকটি স্টেইনগান নামিয়ে গাজীর কাছে গেল। গাজীও তখন থেমে যায়। তখন মনে হলো ওরা তাকে বলছে- তোমাকে ডাকছে। এরপর গাজী আমাদের মাইক্রোবাসে আসেন। তখন আমি গাজীকে বললাম, গাজী সাহেব আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন জানি না। তবে একটা কথা মনে রাখবেন, আপনি আমাদের রেডক্রস মাইক্রোবাসে করে নিয়ে এসেছিলেন হাজার হাজার মানুষের উপস্থিত দেখেছে। আপনি আমাদের সাথে যাই করুন না কেন, কিন্তু পার পাবেন না আপনি। গাজী একথা শুনে হতবাক হয়ে যান।

আমি বললাম, মি. গাজী, আপনাকে একটা পরামর্শ দেই। … আপনি আগে অনুমতি নিন, নতুবা আপনি বাঁচতে পারবেন না। এদিকে আমার ছোট ভাই স্বপন (বীর বিক্রম) লেডিস ক্লাবে ফিরছে। ঘটনা শোনার সঙ্গে সঙ্গে স্বপন সোজা ঢাকা সেনানিবাসে চলে যান। সেখানে তিনি বলেন, তাকে বিয়ে বাড়ি থেকে অপহরণ করা হয়েছে। এই বিয়েতে জিয়াউর রহমান, শফিউর, খালেদ মোশাররফসহ সবাই উপস্থিত ছিলেন। এ খবর পেয়ে এমপি ইউনিটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সর্বত্র অবহিত করেন। এরপর কর্মকর্তারা সবাই ঢাকা শহরে চলে আসেন। তারা আমাদের অপহৃত অফিসারের স্ত্রীকে খুঁজতে থাকে। গাজীর বাড়িতে একদল অফিসার পাঠানো হয়। সেখানে যারা ছিল তারা সবাই ধরা পড়েছে।

মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ নারীর সম্ভ্রমহানি প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে মেজর ডালিম বলেন, কীভাবে এই ত্রিশ লাখ শব্দের জন্ম হলো তার ইতিহাস আমার বইয়ে লেখা আছে।। মুজিব লন্ডন ও ভারত হয়ে বাংলাদেশে আসতে কয়েক ঘণ্টা লন্ডনে যাত্রাবিরতি করেন। তাদের সংগঠিত করেছিল পাকিস্তান সরকার। তার সাথে দেখা করতে গেলেন বিবিসির বাংলা বিভাগের প্রধান সিরাজ ভাই। আর বাংলাদেশ মিশনের দায়িত্বে আছেন রেজাউল করিম। তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা যার সাথে আমিও কিছুদিন কাজ করেছি। জানাশুনা আছে।

একপর্যায় এই দুজন মুজিবুর রহমানের কাছে যায়। তখন মুজিব তাদের জিজ্ঞেস করলেন। সিরাজ ভাই নিজেই আমাকে এ কথা বলেছেন। সিরাজ ভাইয়ের সাথে আমার আগে থেকেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। আমি যখন ছাত্র ছিলাম। তখন তিনি বাংলা বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। ডেভিড ফ্রস্ট মুজিবের সাক্ষাৎকার নিতে আসেন। মুজিব তখন সিরাজ ভাই ও রেজাউল করিম সাহেবকে আলাদা করে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন বাংলাদেশ কি সত্যিই স্বাধীন হয়েছে?? নাকি আমাকে কোথাও নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করা হচ্ছে? তখন সিরাজ ভাই বললেন, মুজিব ভাই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আপনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যাচ্ছেন। কিন্তু ভারতে যাচ্ছেন কেন?? আমরা তা বলতে পারি না। এটা আপনার সিদ্ধান্ত। তারপর জিজ্ঞেস করলেন (সাক্ষাৎকার নিতে) ক্ষতি কত? বলছে তিন লাখের মতো। তিন লাখ। তারপর তিন লাখ টাকা।. সিরাজ ভাই আমাকে পরে বলেন, মুজিব ভাই ডেভিড ফ্রস্টের সাথে ইংরেজিতে কথা বলবেন আমি কখনো ভাবিনি। আমি জানি তুমি বাংলায় বলবে। যখন সাক্ষাত্কারের কথা আসে, ডেভিড ফ্রস্ট এই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করেন যে এই তথাকথিত স্বাধীনতায় প্রাণহানি সম্পর্কে আপনি কী মনে করেন…? মুজিব বললেন তিন লাখকে থ্রি মিলিয়ন বলেন। সেখান থেকে যে রেকর্ডটি বাজতে শুরু করে তা চলতেই থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *