মোবাইল বা কম্পিউটার নিয়ে কি ব্যস্ত আপনার সন্তান। বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে সন্তানরা স্বাভাবিকভাবেই প্রযুক্তিগত দিকে ঝুঁকবে। মেধার বিকাশ কিংবা বিশ্বকে হাতের মুঠোয় দেখতে গিয়ে যেন সন্তান অতিরক্ত আসক্ত না হয় সেজন্য খেয়াল রাখতে হবে। একজন সচেতন মা নিজ সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে ভেবে থাকেন এবং ভাবছেনও। আর এটাই স্বাভাবিক। একইভাবে পরিবারের বাবা-ভাইবোন, দাদা-দাদী, নানা-নানীসহ উভয় সদস্যরাও ভেবে থাকেন । এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভবিষ্যত বলতে আমরা কি বুঝি। প্রশ্নটা শেষ হতে না হতেই উত্তর পাওয়া যায় ও যাবে। তাহলো সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যত। যাতে মানুষের মতো মানুষ হয়। এই প্রশ্নাত্তোরও সঠিক। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে শ্রেণী বিভক্ত সমাজে বেশীর ভাগ মা-ই এমন সঠিক উত্তর দিতে পারবেন না। কারণ, তাদের ভাবনা সন্তানটা কবে বড় হবে। কর্মক্ষম ও কর্মঠ হবে । সেদিন সে বাবার সাথে বা দাদা, চাচা ও ভাইয়ের সাথে কর্ম (কাজ) করে অর্থ উপার্জন করবে। সন্তান বড় হতে থাকবে। তাদের সংসার জীবনের দুঃখও কমতে থাকবে। এভাবেই একদিন সংসার তাদের সুখের হবে। আসলে কি তা হচ্ছে? আর যারা উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনা করেন। তাদের চাওয়া কি পূরণ হচ্ছে। উভয় ক্ষেত্রেই সহজ প্রশ্নাত্তোর হবে না। কার,ণ শ্রেণী বিভক্ত সমাজে মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার মত মৌলিক অধিকার ভোগের সুযোগ থাকে না ৷ সে কারণে বেশীর ভাগ মায়ের সন্তানই শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ পায় না। তাতে মায়েদের চাওয়া পূরণ হয় না। যে মায়েরা উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনা করে, তাদের সবার চাওয়াও পূরণ হয় না। আমরা শ্রেণী রাজনীতি নিয়ে এখানে ভাবছি না ও ভাববো না। আমরা ভাববো সন্তানদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ, জীবন ধারণ ব্যবস্থা, সমাজ ব্যবস্থা। কারণ একদিকে প্রযুক্তির অবদানে আবিষ্কৃত মোবাইল বা কম্পিউটার ও গণমাধ্যমের বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। আরেক শ্রেণীর মায়ের সন্তানরা সামন্তবাদী ধারায় পরিচালিত সমাজে দারিদ্রতার জন্য ধনী গোষ্ঠীর আশ্রয়ে থেকে হুকুম মানতে গিয়ে এবং বস্তি- ফুটপাত-রেল ষ্টেশন, নৌবন্দর, বাস টার্মিনালে থাকার জন্য মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। অপরাধ জগতের আশীর্বাদে মাদক দ্রব্য বেচাকেনার সাথে জড়িয়ে যায়। কেউবা নেশাগ্রস্থ হয়ে মা-বাবার চাওয়া পূরণের পথ থেকে দূরে চলে যায়। যত কম সংখ্যকই হোক অপরাধীর খাতায় নাম লিখে ফেলে। আরেক শ্রেণীর মায়েদের সন্তানরাও এক অংশ মাদকাসক্ত হয়ে ভুল পথে চলে যায়। অপর অংশ মোবাইল বা কম্পিউটার দিয়ে খেলা ও কার্টুন নিয়ে ব্যস্ত থাকতে থাকতে এক পর্যায় আসক্তি হয়ে যায়, সেই সবে ডুবে থাকে । তাদেরকে এ পথে উৎসাহিত করে থাকে পশ্চিমা অপসংস্কৃতিসহ প্রতিবেশী দেশের অপসংস্কৃতির বাহক বা মাধ্যম নাটক, সিরিয়াল সিনেমা প্রভৃতি পড়াশুনার চাপতো আছেই। খেলাধূলার সুযোগ নেই ।
আমাদের আলোচনা মোবাইল ও কম্পিউটারের পদায় খেলা ও কার্টুন নিয়ে ব্যস্ত থাকা বিষয়ের। সেটাই এখন আলোচ্য। ইন্টারনেট সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য যা বলছে-তারই অংশ তুলে ধরছি। ইট, কাঠ আর কংক্রিটের শহরে আটকা পড়ে যাচ্ছে শিশুদের বর্ণিল শৈশব। প্রশস্ত খেলার মাঠে দৌড়ঝাঁপ করে খেলাধূলার সুযোগ তাদের নেই। চার দেয়ালের মাঝের একঘেয়ে জীবনযাপনে বড়দের পাশাপাশি তারাও হয়ে যাচ্ছে যান্ত্রিক। কিন্তু শিশু বয়সের স্বভাব-সুলভ চঞ্চলতা কি আটকে রাখা যায়? শিশুরা তাই খেলাধূলার আনন্দ খুঁজে ফিরছে মাউসের বাটন টিপে, কম্পিউটারের পর্দায়। অনেক সময় এ গেমসের প্রতি তাদের আকর্ষণটা চলে যাচ্ছে আসক্তির পর্যায়ে। শিশুরা গেম খেলবেই। কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে যেন সেটা মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়৷ অতিরিক্ত ভিডিও গেমসে আসক্ত থাকা শিশুর মানসিক ও শারীরিক উভয় ধরনের বিকাশের জন্য ক্ষতিকর ।
আসক্তির কারণ
- শিশুর স্কুলসহ বাড়িতে খেলার জায়গা থাকে না। তাই বিনোদন হিসেবে গেমস খেলে। কার্টুন দেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকে ।
- শিশু বেশির ভাগ সময় কাজের লোকের কাছে বড় হয়। কাজের লোক শিশুকে ম্যানেজ করার সহজ মাধ্যম হিসেবে কম্পিউটারের সামনে তাকে বসিয়ে রাখে ।
- স্কুলসহ বাড়িতে পড়ার চাপের কারণে শিশুর খেলার সময় কমে গেছে। তাই অল্প সময়ে খেলতে কম্পিউটার বেছে নেয়।
- যানজট, নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদির কারণে মা- বাবা শিশুকে খেলতে নিয়ে যাওয়া, বেড়াতে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। তাই শিশু কম্পিউটারে গেমস খেলে সময় কাটায় ৷
- অলস সময় কাটাতে শিশু টিভিতে বা গেমসে আসক্ত হয়।
- গেমস খেলা দুটোই যেহেতু এক পাক্ষিক, অর্থাৎ এখানে অন্য পক্ষের সঙ্গে ভাবের আদান- প্রদান হয় না, ফলে বাধাগ্রস্ত হয় শিশুর মানসিক ও সামাজিক বিকাশ।
ক্ষতির দিক
- অতিরিক্ত কার্টুন দেখা মোবাইল বা কম্পিউটার স্ক্রিনে বসে থাকা শিশুর চোখের জন্য ক্ষতিকর।
- ভিডিও গেমসের অধিকাংশই মারামারি ও সহিংসতাপূর্ণ। এগুলো থেকে শিশু সহিংস হয়ে ওঠে। অনেক সময় মারামারি শেখে এবং খুব সহজেই আক্রমণাত্মক হয় ।
- অনেক সময় শিশু কার্টুনের চরিত্রের নেতিবাচক দিকগুলোই শেখে ।
- শিশুর পড়াশোনায় মনোযোগ কমে যায়; স্কুলের প্রতিও তৈরি হয় অনীহা ।
কী করবেন
- শিক্ষণীয় বা বুদ্ধি বৃদ্ধিতে সহায়ক এমন গেমস নির্বাচন করুন। কার্টুন নির্বাচনেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করুন।
- শিশুকে সমবয়সী অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলার সুযোগ করে দিন ।
- মা-বাবাসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা শিশুকে সময় দিন, যাতে সে নিঃসঙ্গ না থাকে ।
- বাড়িসহ স্কুলের পরিবেশে খোলা জায়গায় খেলার পরিবেশ করে দিন।
- শিশুর খেলা ও পড়ার রুটিন করে দিন । যাতে তার পড়ার চাপ না পড়ে আর খেলাধূলার পর্যাপ্ত সময় পায় ।
- শিশুকে মাঝে মধ্যে বেড়াতে নিয়ে যান ৷ এতে তার মানসিক বিকাশ ঘটবে।
- শিশুর বয়স অনুযায়ী তাকে বইপড়া, সাইকেল কিনে দেয়া, রঙ করা ইত্যাদিতে ব্যস্ত রাখুন ৷
- যেসব শিশুর সব কিছুতেই আগ্রহ বেশি, তার আগ্রহ না কমিয়ে বরং রুটিন করে কম্পিউটারে গেমস খেলতে দিন ।
- আধুনিক যুগে শিশুকে কম্পিউটার থেকে দূরে রাখা যাবে না, উচিতও নয়। বরং শিশুকে ইন্টারনেট জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। তবে ইন্টারনেট ব্যবহারে সতর্ক থাকুন ।
- সর্বোপরি সব ব্যাপারে মা-বাবাকে শিশুর সার্বক্ষণিক সঙ্গী হতে হবে।