Thu. Oct 23rd, 2025
রংপুর অঞ্চলে শ্রমজীবি মানুষের জীবন-জীবিকায় দুর্বিষহ চাপ

স্বপন চৌধুরী : রংপুর অঞ্চলে শ্রমজীবি মানুষের জীবন-জীবিকায় দুর্বিষহ চাপ। রোপা আমন ধানের চারা রোপনের পর সেই ধানের কাটামাড়াই না হওয়া পর্যন্ত (আশ্বিন-কার্তিক মাস) রংপুর অঞ্চলে কৃষি শ্রমিকদের তেমন কাজ থাকেনা। সে কারণে নিম্নআয়ের খেটে খাওয়া মানুষের জীবন ও জীবিকায় নেমে এসেছে দুর্বিষহ চাপ। আয়-রোজগার কমে যাওয়ায় তাদের প্রাত্যহিক খাবারের সংস্থান করতে হিমসিম খেতে হচ্ছে। তার ওপর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্যের আকাশছোঁয়া দামে বর্তমান সময়ে কৃষি শ্রমিকসহ খেটে খাওয়া মানুষদের সংসারে চলছে টানাপোড়েন। সংকটে থাকা কর্মহীন মানুষগুলো চরম বিপাকে পড়েছে। অনেকে অর্ধাহারে-অনাহারে থেকে দিনাতিপাত করছে।

বছরের আশ্বিন-কার্তিক মাসে কৃষিকাজ না থাকায় রংপুর অঞ্চলের লোকজন বেকার হয়ে পড়তেন। মৌসুমি এই বেকারত্বের কারণেই দেখা দিত খাদ্যের অভাব। এটাই ‘মঙ্গা’ নামে পরিচিত ছিল। ১০ বছর আগেও ‘মঙ্গা’ শব্দটি এ অঞ্চলের মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল। মঙ্গার সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করতে হয়েছে তাদের। কিন্তু সেই মঙ্গা এখন নেই। তবে কাজ না থাকার পাশাপাশি চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্যের পাল্লা দিয়ে দাম বৃদ্ধির প্রভাবে আবারও সেই ভয়াবহ দিন ফিরছে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংকটে থাকা মানুষজন।

রংপুর ও রাজশাহী কৃষি অফিস সুত্রে জানা যায়, উত্তরের ১৬ জেলায় সাড়ে ১১ লাখ মৌসুমি কৃষি শ্রমিক রয়েছে। এর মধ্যে রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলে সাড়ে পাঁচ লাখ এবং রাজশাহী-বগুড়া অঞ্চলে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ। এসব মৌসুিম শ্রমিক ধানের মৌসুমে শুধু নিজ জেলার বাইরে অন্য জেলায় গিয়ে আগাম ধানের কাটামাড়াই করে বাড়তি আয় করতেন ছয় থেকে আট হাজার টাকা। এরা শুধু আমন ও বোরো মৌসুমে ধানা কাটামাড়াইয়ের কাজ করে সংসারে স্বচ্ছলতা আনতেন। অন্য সময়ে এরা শহরে রিকশা-ভ্যান চালানো অথবা অন্য কোন পেশা গ্রহণ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। দিন হাজিরায় যেসব শ্রমিক কাজ করেন, তাদেরও মজুরি বেড়েছে কয়েকগুণ। পাঁচ বছর আগে দেড়শ’ টাকায় যে শ্রমিক দিন হাজিরায় কাজ করতেন, এখন তারা ৫০০ টাকার নিচে কাজ করে না। কোন কোন এলাকায় তিনবেলা খাওয়াসহ এই হাজিরা পান তারা। তবে বর্তমান সময়ে মৌসুমি কৃষি শ্রমিকরা বাড়িতেই অবস্থান করছেন। তাদের ভাষ্য মতে, অন্য জেলায় কাজে যেতে যাতায়াত খরচ অনেক বেশি পড়ে। মজুরির টাকায় গাড়িভাড়া দিয়ে পোষায়না। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো না থাকায় নিজ জেলার বাইরে যেতে সাহস পাননা তারা।

রংপুরের কাউনিয়ার শহীদবাগ এলাকার মৌসুমি শ্রমিক দিলশাদ আলী, শরিফ উদ্দিন, রংপুর সদরের গঞ্জিপুর এলাকার আমিন উদ্দিন, মনছুর আলী, গঙ্গাচড়ার গান্নারপাড় এলাকার রহমত আলী, নীলফামারীর জলঢাকার নয়া মিয়া, আশেক আলীসহ অনেকেই জানান, প্রতিবছর অন্য জেলায় গিয়ে ধান আগাম কাটামাড়াই করে ছয় থেকে আট হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেন। এবারে ভয়ে তারা বাড়ি থেকে অন্য কোথাও যাননি। এলাকাতেও কাজের সুযোগ না থাকায় কর্মহীন হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে বলেও জানান তারা।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুরের অতিরিক্ত পরিচালক সিরাজুল ইসলাম জানান, বৃহত্তর রংপুরের পাঁচ জেলায় তিন লাখের বেশি মৌসুমি শ্রমিক রয়েছে। এরা শুধু ধানকাটার সময় কাজ করে। বছরের বাকী সময় অন্য কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। করোনার সময়েও সরকারিভাবে এই অঞ্চল থেকে ৪৫ হাজার শ্রমিককে ধান কাটামাড়াইয়ের জন্য দেশের দক্ষিণ ও হাওরাঞ্চলে পাঠানো হয়েছিল। তবে বর্তমান সময়ে নানা কারণে অন্য জেলায় কাজে যেতে তাদের নিজেদেরই আগ্রহ নেই। উন্নয়ন গবেষকরা বলছেন, প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে কর্মহীন হয়ে পড়ায় খাদ্য সংকটের ফলে সৃষ্ট মঙ্গার কবলে পড়তে হয়েছিল নিম্নআয়ের মানুষকে। কিন্তু সরকারের আন্তরিকতায় মঙ্গা শব্দটাই মুছে গিয়েছিল। উত্তরের জনপদে ফিরে এসেছিল আর্থিক স্থিতিশীলতা ও সুদিন। সেই সুসময় আজ হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। করোনাক্রান্তিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে চাকরি করা রংপুর বিভাগের আট জেলায় দুই লক্ষাধিক মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। এসব মানুষ এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এতে দেশের মানচিত্রে উত্তরাঞ্চলে নতুন করে দারিদ্র্যের হার বাড়ছে। শহর থেকে কর্ম হারিয়ে গ্রামে ফিরে আসা মানুষদের নতুন করে কর্মসংস্থানের অভাব সৃষ্টি হয়েছে। এতে কর্মহীনদের মাঝে হতাশাসহ বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা ।

২০১৫ সালে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) এক গবেষণায় জানা যায়, রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলা রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা ও নীলফামারী মঙ্গা কবলিত। ২০০৮ সালে এসব  জেলার মাত্র ২৩ শতাংশ পরিবার মঙ্গার সময় তিন বেলা খেতে পারতেন। সে সময় ৭৭ শতাংশ পরিবারের সদস্যরাই অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাতেন। ২০১৩ সালে এসে পরিস্থিতির উন্নতি হয়, ৭৪ শতাংশ পরিবারই তিন বেলা খেতে পারে। ‘মঙ্গা নিরসনে সমন্বিত উদ্যোগ’-এর মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলে মঙ্গা জয় করা সম্ভব হয়। এছাড়া ২০০৮ সালে এসব এলাকার একটি পরিবারের বার্ষিক গড় আয় ছিল ৩৫ হাজার ৪০০ টাকা। তবে ২০১৩ সালে সেটি ৪২ হাজার ৭০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে ৭৮ হাজার ১০০ টাকায় দাঁড়ায়। অর্থাৎ আয় বাড়ে ১২০ শতাংশ। একই সঙ্গে মঙ্গাপীড়িত জেলার পরিবারগুলোর জীবনমান, বিনিয়োগ ও সঞ্চয়ের পরিমাণও বেড়ে যায়। কৃষি ও দরিদ্রদের প্রণোদনা প্রদান ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ায় উত্তরাঞ্চলের মানুষ মঙ্গার অভিশাপ থেকে মুক্তি পায়। কিন্তু বর্তমানে সেই মানুষগুলো করোনার সময় কর্মহীনসহ নানা প্রতিবন্ধকতায় দুর্বিষহ জীবন যাপন করতে শুরু করেছে। কর্মহীন হয়ে পড়ায় তাদেরকে আবারো মঙ্গার ভয়াবহ স্মৃতির কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। তারা কৃষির ওপর নির্ভরশীল না থেকে এ অঞ্চলের বাইরে গিয়ে পোশাকশিল্প, ইটের ভাটা, মানুষের বাসাবাড়ি, হোটেল-রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন। অনেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় শহরে গিয়ে রিকশা ও ভ্যান চালাতেন। করোনার পর থেকে এইসব বেশিরভাগ অভিবাসী-শ্রমিকের চলাচল ও আয় বন্ধ হয়েছে। কর্মহীন হয়ে গ্রামে ফিরে অর্ধাহারে-অনাহারে দিনাতিপাত করছেন অনেকে।

তিস্তার চরের আব্দুল মতিন ঢাকার শাহবাগে একটি ছোট্ট গার্মেন্টস এ কাজ করতেন। করোনায় ওই প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাড়িতে ফিরে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘কয় বছর থাকি ওইখানে চাকরি করি কোনমতে সংসার চলছিল। এ্যালা বাড়িত বসি আছি, চরগ্রামে কোন কাম (কাজ) নাই। বউ-ছাওয়া নিয়া খুব কষ্টে আছি।’ রংপুর নগরীর তাজহাট এলাকার হাসেন আলী (৫৫) ঢাকা ওয়ারীতে একটি প্রেসে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করতেন। প্রতি মাসে বেতন পেয়ে বাড়িতে টাকা পাঠাতেন। দুই ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে ভালোই চলছিল সংসার। কিন্তু ওই সময় বাড়িতে ফিরে আসেন তিনি। তাকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এখন খুব কষ্টে জীবনযাপন করছেন তিনি।

রংপুরের উন্নয়ন নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এখন সরকারি কর্মচারি ছাড়া কেউ ভালো নেই। গবেষণা বলছে, প্রায় দুই কোটি মানুষ চাকরি হারিয়ে গ্রামে এসেছেন। এর আগে দেশে চার কোটি মানুষ অসহায় ছিল। তাই আমরা বলছি এখন ৩৫ শতাংশ মানুষ দেশে দরিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। বিশেষ করে কর্ম হারিয়ে পিছিয়ে পড়া রংপুরে দুই লক্ষাধিক মানুষ ফিরে আসার বিষয়টি হতাশাব্যঞ্জক। কর্মহীন মানুষদের মূল ম্রোতধারায় আনতে না পারলে দেশের দারিদ্র্য মানচিত্রে বড় ক্ষতি হবে। সেজন্য কৃষিনির্ভর এই এলাকায় কৃষিভিত্তিক শিল্পকারখানা স্থাপন করে গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর জোর দেন তিনি।

আরও পড়ুন- উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের আশার আলো ‘আইএসসিএইচভি’ প্রকল্প

জ্বালানি তেলের সংকট রংপুরাঞ্চলে : আন্দোলনের হুঁশিয়ারি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *