স্বপন চৌধুরী : রংপুর মেডিকেল কলেজে লাগামছাড়া অনিয়ম-দুর্নীতিতে রোগীরা পর্যদুস্ত। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতি দুই মিনিটে একজন করে রোগী আসছেন। কাউন্টারে নাম ও রোগ লেখানোর পর্ব শেষ করে ভর্তি ফি ২৫ টাকার স্থলে নেওয়া হচ্ছে ৫০ থেকে ১০০ টাকা। কেউ টাকা দিতে না চাইলে রোগীকে ফেলে রাখা হচ্ছে বাইরেই। মিটমাট হলেই কেবল ট্রলিতে তোলা হয়। গন্তব্যে পৌঁছাতে দিতে গুণতে হচ্ছে আরও ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। পুরো ব্যবস্থাটাই নিয়ন্ত্রণ করে দালাল চক্র। বিভাগের দুই কোটি মানুষের চিকিৎসার ভরসারস্থল রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অনিয়ম-দুর্নীতি লাগামছাড়া। হৃদরোগে আক্রান্ত সংকটাপন্ন বাবাকে বাঁচাতে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন ছেলে গোলাম রব্বানি। জরুরি বিভাগের সামনে এসে তাড়াহুড়ো করে ভর্তির টিকিটও নেন। কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন অন্তত পাঁচজন যুবক, প্রত্যেকের হাতে ট্রলি (স্ট্রেচার)। কিন্তু কেউ রোগীকে তুলছেন না, সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে দাবি করেন ৫০০ টাকা। নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ থেকে আসা গোলাম রব্বানি শেষ পর্যন্ত ৩০০ টাকা দিতে রাজি হয়ে বাবাকে নিয়ে যান ওয়ার্ডে।
চিকিৎসাসেবা নিতে এসে সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি রোগীরা
ভর্তি থেকে শুরু করে লাশ বের করা পর্যন্ত গুনতে হয় টাকা
সরেজমিনে দেখা যায়, রোগী ভর্তি থেকে শুরু করে মৃত্যুর পর লাশ বের করা পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয়। শুধু ট্রলি ভাড়া নয়, ওয়ার্ডে যাবার পর বেড পেতে দিতে হয় ৫০০ টাকা, সকল ধরনের পরীক্ষা বাইরে থেকে করাতে বাধ্য করা হয়। স্যালাইনের সুই থেকে শুরু করে সকল ওষুধ কিনতে হয় বাইরে থেকে। প্রতিদিন রোগী ও তাদের স্বজনরা দালাল, সিন্ডিকেট ও মাস্তানদের দ্বারা হেনস্তা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, এতদিন হাসপাতালটি ছিল শুধুমাত্র চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী ইউনিয়নের সিন্ডিকেটের দখলে। ৫ আগস্টের পর তাদের সঙ্গে বাইরের কিছু মানুষের যোগ দেওয়াসহ একটি রাজনৈতিক দলের কয়েকজন নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
আরও পড়ুন- ক্যান্সার মানেই জীবন শেষ নয়
হাসপাতালে ঢোকার প্রধান ফটকের সামনেই দাঁড়ানো অ্যাম্বুলেন্সে মায়ের লাশ নিয়ে কেবলই উঠেছেন পীরগাছার চৌধুরানী এলাকার আজিজার রহমান। পাশে তখনো পড়েছিল ওয়ার্ড থেকে লাশ বহন করে আনা স্ট্রেচার। অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে স্বজনদের কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাম্বুলেন্সের দরজা বন্ধ করা ঠেকিয়ে বকশিশ চাচ্ছিলেন আয়া। মাত্রারিক্ত ৫ হাজার টাকা দাবি করে বসেন অ্যাম্বুলেন্স চালক। পদে পদে বাধা পেরিয়ে কী করে মায়ের লাশ নিয়ে যাবেন-এই চিন্তায় বেশি কাতর ছিলেন শোকে স্তব্ধ আজিজার। ২০০ টাকা বের করে দেন আয়াকে, সাড়ে ৩ হাজার টাকায় অ্যাম্বুলেন্স চালককে রাজি করিয়ে মুক্তি পান তিনি। স্ট্রেচার নিয়ে যাবার সময় প্রশ্ন করলে রাশেদা বেগম নামের ওই আয়া বলেন, ‘খুশি হয়ে আমাকে ২০০ টাকা দিলো লাশের লোক।’ অ্যাম্বুলেন্স স্টার্ট করার প্রাক্কালে মায়ের লাশ নিয়ে বসা আজিজার রহমান বলেন, ‘হাসপাতালে আসার পর থেকে পদে পদে খরচ করেছি। তার পরও ঠিমকত চিকিৎসা না হওয়ায় মারা গেলেন মা। শেষে তার লাশ নিয়েও শুরু হলো ব্যবসা। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরও লাশ নিতে বাধা আসে। বেড থেকে নামিয়ে স্ট্রেচারে তুলতে দুই হাজার টাকা নেন হাসপাতালের লোকজন।’ সদ্য প্রসূত সন্তান অসুস্থ হয়ে পড়লে সম্প্রতি চেম্বারে এক চিকিৎসককে দেখান গঙ্গাচড়ার ইব্রাহীম আলী। ওই চিকিৎসক তাকে ক্লিনিকে ভর্তি করানোর পরামর্শ দেন। কিন্তু অর্থের যোগান না থাকায় তিনি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান। কিন্তু শিশুটিকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে নিতে হবে বলে ওয়ার্ডবয়রা তার কাছে সাড়ে তিন হাজার টাকা দাবি করেন। সন্তানকে বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত তাকে ১২০০ টাকা দিতে হয়েছে। ইব্রাহীম বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এভাবে টাকা নেওয়া হয়, তা জানা ছিল না।’ গাইনি ওয়ার্ডে সন্তান প্রসব করেন তারাগঞ্জের ইকরচালী এলাকার চাঁদ মিয়ার স্ত্রী নূরুন্নাহার বেগম। সঙ্গে থাকা চাঁদ মিয়া বলেন, ‘রাতে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার আগে ওষুধের স্লিপ হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। সাড়ে তিন হাজার টাকার ওষুধ এনে দিয়েছি। আমার স্ত্রীর স্বাভাবিক ডেলিভারী হয়েছে, কিন্তু ওষুধগুলো আর ফেরত দেওয়া হয়নি।’ রংপুর মেডিকেল কলেজের অর্থোসার্জারি বিভাগের জুনিয়র কনসালট্যান্ট এ বি এম রাশেদুল আমীর জানান, চিকিৎসার জন্য তার মাকে হাসপাতালে নিয়ে যান পরিবারের সদস্যরা। রোগী ভর্তি ফি ২৫ টাকার স্থলে দাবি করা হয় ২৫০ টাকা। চিকিৎসকের মা পরিচয় জানার পরও ৫০ টাকা ফি গ্রহণ করা হয়। আইসিইউতে তার ব্যক্তিগত সহকারীর কাছে জোর করে ২০০ টাকা নেন কর্মরত দুই ব্যক্তি। এসময় ‘চিকিৎসকের মা’ পরিচয় দিলেও তারা টাকা ছাড়েননি; বরং বলেছেন, ‘যে স্যারের মা হোক, টাকা দিতে হবে।’ হাসপাতালের পরিচালক বরাবর তিনি লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন।
আরও পড়ুন- ডপলার রাডারে আবহাওয়ার তথ্য জানার দ্বার খুলল উত্তরে
অনুসন্ধানে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে কর্মচারী সিন্ডিকেটের মূলহোতা হিসেবে কাজ করছিলেন এই হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি শাহিনুর রহমান শাহিন ও সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান নয়ন। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় দালালচক্রের অর্ধশতাধিক সদস্য কাজ করেন। নানা অপকমর্মের কারণে খুনের মামলার আসামি সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান নয়ন সাময়িক বরখাস্তসহ আত্মগোপনে আছেন। তবে সিন্ডিকেটে যুক্ত হয়েছেন হাসপাতালের ভেতর ও বাইরের অনেকেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাধারণ কর্মচারীরা জানান, আত্মগোপনে থাকলেও আশিকুর রহমান নয়ন সিন্ডিকেটের নেপথ্যে রয়েছেন। আউটসোর্সিংয়ে কাজ করে সিন্ডিকেটে রয়েছেন নয়নের ভগ্নিপতি রতন ও ফুপাতো ভাই মুকুল, রয়েছেন ওয়র্ড মাস্টার হাসান ও মানিক। আরও আছেন কর্মচারী ইউনিয়নের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক আব্রাহাম লিংকনের বড় ভাই নগরীর ধাপ এলাকার রায়হান ও একই এলাকার রাহাত। বর্তমানে এই সিন্ডিকেটের পাশে যুবদলের কয়েকজন নেতা দাঁড়িয়েছন বলেও জানান তারা। এ ব্যাপারে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও আশিকুর রহমান নয়নকে ফোনে পাওয়া যায়নি। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি শাহিনুর রহমান শাহিন নিজে এ কাজে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন। তবে ভর্তি বাণিজ্যের বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, এই কাজে কর্তৃপক্ষ জড়িত রয়েছে। ওয়ার্ড মাস্টার মানিক নিজে সিন্ডিকেটে যুক্ত নন দাবি করে বলেন, সিন্ডিকেট আছে তবে আগের তুলনায় তাদের দৌরাত্ম কমেছে। রংপুর মহানগর যুবদলের আহবায়ক নুরুন্নবী চৌধুরী মিলন বলেন, ‘আমার জানামতে মেডিকেলের সিন্ডিকেটে যুবদলের কেউ নেই। হয়তোবা যুবদলের নাম ভাঙিয়ে সিন্ডিকেট সদস্যরা ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করেছে। তবে দলের যদি কেউ ওই সিন্ডিকেটে সংশ্লিষ্ট থাকে, তাহলে দল তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে।
আরও পড়ুন- গাইবান্ধার উন্নয়ন: সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটির সুনাম ও ঐতিহ্য আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এখানে চিকিৎসক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ; ওষুধ, খাদ্য ও নির্মাণকাজের ঠিকাদারি, সরকারি বরাদ্দসহ নানা বিষয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে এলেও প্রতিকার মিলছে না। রংপুর বিভাগের দুই কোটি মানুষের চিকিৎসার ভরসাস্থল এই হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবার পরিবেশ উন্নত এবং এর অনিয়ম দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশিকুর রহমান বলেন, সমস্যা অনেক। দীর্ঘদিনের ধরে চলে আসা সব সমস্যার সমাধান তো চাইলেই সম্ভব নয়। সিন্ডিকেট নাই বলবোনা, তবে আগের চেয়ে অনেকাংশে তাদের দৌরাত্ম কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। সিন্ডিকেটমুক্ত রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গড়তে সর্বাত্মক চেষ্টা চলানো হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
