Thu. Jul 10th, 2025
রিক্সাচালকের ভাবনাই যেন আলোচনায়

ভাষ্যকার : সেদিন এক রিক্সায় শাহবাগ থেকে সদরঘাট যাচ্ছিলাম। যে রিক্সাচালকের ভাবনাই যেন আলোচনায়। রিক্সাটায় উঠতেই রিক্সাচালক বেচারা জানতে চাইলেন আমি কেমন আছি। ভালো আছি বলেই, আমি তাকে বললাম, তুমি আমাকে জানো নাকি? ক্যান স্যার, কিছুদিন আগে আপনাকে ইত্তেফাক থেকে প্রেসক্লাবে নিয়ে এসেছিলাম।

আপনি আমার কথা শুনে আমাকে আমার ভাই-বোন ও মেয়েকে লেখা-পড়ার জন্য কষ্ট হলেও ঢাকায় থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমি ঢাকায়ই থাকি। আপনি আমাকে ওইটুকু সময়ে ভালো ভালো কথা শুনিয়েছেন, মনে সাহস জুগিয়েছেন। তা স্যার, আপনি কি সাংবাদিক? বললাম কেন? প্রেসক্লাবে আসলেন তো তাই। বেয়াদবি নিয়েন না, স্যার। আরে না, আমি আসছি বিএনপির এক আলোচনা সভায়। তারও কিছুদিন পর বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আমার জীবন আমার সংগ্রাম’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করার অনুষ্ঠানে এসেছিলেন না?

ওই দিনইতো আপনাকে একজন মহিলা সাংবাদিক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা দিল। আমি সালাম দিলে আপনি বললেন কেমন আছ। ভদ্র মহিলা গণপ্রহরী নামের সাপ্তাহিক পত্রিকাটি বিএনপি’র মহাসচিব, আমাদের পরিবারের সবারই প্রিয় মানুষ। খুব ভালো মানুষ। ভদ্র মহিলার কাছ থেকে হাসিমুখে পত্রিকাটি হাতে নিয়েই গাড়ীতে উঠে পত্রিকাটি পড়তে পড়তেই চলে যান। সাংবাদিক মহিলাও পত্রিকাটি তার হাতে দিতে পেরে খুশি হলেন। তিনিও আমার রিক্সার যাত্রী হয়ে গুলিস্তান পর্যন্ত যেতে আপনার মতোই কথা বলতে বলতে গেলেন। তাকে খুব আন্তরিক ও বুদ্ধিমতি মনে হলো। এসব কথা রিক্সাচালক বেচারা গুছিয়ে কথাগুলো একাধারে বলে যাচ্ছিল। আমি বললাম, আমারতো নামার সময় হয়ে এলো। তা তোমার ভাই-বোন ও মেয়ের লেখা পড়া কেমন হচ্ছে?  তোমরা কেমন আছ?

তার সুন্দর উপস্থাপনায় নিজেও মুগ্ধ হয়ে গেলাম। জানতে চাইলাম- তোমার লিখাপড়া? ওই রকম না, স্যার। বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পাশ করার পর কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। অভাবে আর লেখা পড়া করা সম্ভব হয়নি। পুলিশে ভর্তির চেষ্টা করেছিলাম। কপালে জোটেনি। দুঃখের কথা বলে কি হবে স্যার। এখন পরিশ্রম হলেও ভালই আছি। ভাইবোন ও মেয়ে আপনাদের দোয়ায় ও আল্লাহর রহমতে খুব মেধাবী হয়েছে। জানিনা আল্লাহ ভাগ্যে কি রেখেছে। বিএনপি পরিবারের জন্য আমার চাকরি হয়নিতো, তাই ভয় হয়। রিক্সাচালক বেচারার আবেগপ্রবণ কথাগুলো প্রেক্ষিতে দুঃখে ভারাক্রান্ত মনে একটাই শান্তনা দেওয়ার। এখনতো সেই সরকার নেই। আর সেই সরকার আর ক্ষমতায়ও আসবে না। তুমি ভাইবোন ও মেয়েকে উচ্চ শিক্ষিত করো। ছোট ছেলেটাও বড় হোক। ওকে পড়াশুনা করাবে। শিক্ষা থাকলে আর কর্ম জানলে তার জন্য যা করার সরকারই করবে। আমার গন্তব্যস্থলে-।

রিক্সা থেকে নামতেই, চলতি মাসেরই ৪ তারিখের প্রথম আলো পত্রিকা সিটের নীচ থেকে বের করে দেখিয়ে বলতে থাকলো আগের মতই। আমার পরিবারের সেই প্রিয় নেতা বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আওয়ামীলীগ নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে নিবে। আমি শুনে প্রথমে বিশ্বাস করিনি। পরে বিশ্বাস নিয়ে বের হয়ে আগে পত্রিকা কিনে পড়লাম। আপনিতো জানেনই। তারপরও কি আশাভরসা থাকে।

বেচারা রিক্সাচালক হলো অদ্ভুত এক মানুষ। কি তার দূরদর্শী চিন্তা! আজকে সেই রিক্সাচালকের ভাবনাই যেন আলোচনায়, সবার। আমি হতবাক হয়ে গেলাম। বিনয়ের সাথেই বললাম, ছোট ভাই, তোমার সময় নষ্ট হলে তোমারতো ক্ষতি হয়ে যাবে। সাথে সাথে বললো, আপনি কি কিছু বলতে চান, স্যার। বললাম স্যার, না, ভাই বললেই হবে। সে বুঝে ফেললো, আমি কিছু না কিছু বলতে চাই। সে রিক্সাটা সাইড করে দাঁড়ালো। পাশেই ফুটপাতে এক চায়ের দোকান। আমি সেদিক আগাতেই সে বললো, না স্যার ছোট ভাই বলেছেন- চা আমি নিয়ে আসছি। ভাবছিলাম চা খেতে খেতে কথা বলবো। সে চা আনার সময়টুকুতে আমি ভেবে নিলাম-মহাসচিব মহোদয়, তার চিন্তা চেতনায় ও দলীয় দৃষ্টি কোন থেকে কথা বলেছেন। অন্তর্বর্তী সরকারও হয়তো সংবিধান ও গণতান্ত্রিক অধিকার বিষয়ক চিন্তা থেকে দলটি নিষিদ্ধ করেনি। সে চা নিয়ে হাজির। তা ছোট ভাই আওয়ামীলীগ নির্বাচন করলে অসুবিধা কি? বিএনপি তাদের কাছে পারবে না বলে মনে হয়?

বেয়াদবি মাফ করবেন বড় ভাই। আমি কাজের ফাঁকে একটু আধটু বিশ্রাম করে নেই। আজকে না হয় তা নাই করলাম বা কম করলাম। কিন্তু আপনার সময়তো মহামূল্যবান বলেই আমার বিশ্বাস। তাই, আগে কৃতজ্ঞতা জানাই, সময় দেওয়ার জন্য। আবারো সেই স্যার বলতে হাত নারতেই বুঝে গেল। শুরু করলো তার কথা। শুধু বিএনপি না, বিএনপিসহ যে দলগুলো আন্দোলন করেছে, লাখ লাখ মানুষ তাদের ডাকে সাড়াও দিয়েছে। সরকারের পতন হয়নি। তবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়াম্যান বিদেশে থেকেও সারাদেশে ঢাকা থেকে গ্রাম পর্যন্ত মোবাইলে যোগাযোগ রেখেছেন। কর্মীদের মনোবল ঠিক রেখেছেন, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। তার জাতীয় সরকার গঠন প্রস্তাবের ভিতর-বাইর সেভাবে জানিনা, বুঝিও না।

গণঅভ্যুত্থানে রিকশাওয়ালাদের অংশগ্রহন
গণঅভ্যুত্থানে রিকশাওয়ালাদের অংশগ্রহন

তারপরও বলবো সবাই মিলে জাতীয় সরকারের ভিত্তি ঠিক না করে যদি নির্বাচনে যায়। তাহলে নিজেদের ঐক্যতো থাকবেই না। বরং বিভক্তি হবে। আর এই পরিস্থিতিতে এবং দেশের মানুষের দুঃখকষ্টের সুযোগ নিয়ে আওয়ামীলীগ যদি নির্বাচন করে তাদের লুটের টাকার ছড়াছড়িতে। আর ভারতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে এবং জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলের ভূমিকায় নির্বাচনের ফলাফল হিতেতো বিপরীতও হতে পারে। বড় ভাই ছাত্রজনতার আন্দোলনে শহীদ ও আহতরাতো কাকেও এমন ক্ষমতা দেয় নি, তাদেরকে (ছাত্রজনতা) যারা গুলি করে হত্যা করেছে; তাদেরকে আবার রাজনীতির অধিকার দেওয়ার। ভুল বললাম কি? ভুল হলে মাফ করবেন। রিক্সা চালাতে চালাতে দশজনের দশ কথা শুনতে শুনতে এটাই বুঝেছি। ছাত্রজনতা যা করেছে, তা সংবিধানে লেখা আছে এমন কথাতো শুনিনি।

আমি লজ্জিত হলাম। তার যুক্তিযুক্ত সোজাসাপ্টা কথায়। কারণ তার কথা প্রেক্ষিতে যুক্তি দিয়ে নাকচ করার চেষ্টা করা আমার কাছে অযৌক্তিক মনে হতে থাকলো। এও মনে হলো আমার মতো ভাষ্যকারের ভাষ্য নয়, রিক্সাচালকের বক্তব্যই মূলত: ভাষ্যকারের ভাষ্য হলে পাঠক প্রিয় ভাষ্য হতো। কেননা, রিক্সাচালকের ভাবনাই যেন আলোচনায় এখন। তাইতো রিক্সাচালকরাও স্বতঃস্ফুর্তভাবে অংশ নিয়েছিলেন আন্দোলনে।

এমনিতেই নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে জনমনের মধ্যে যে বিদ্যমান অস্থিরতা চলছে। গার্মেন্টস সেক্টরে যে পরিস্থিতি সর্বক্ষেত্রেই যেন অস্থিরতা। সংবিধানে এর সমাধান আছে বলে মনে করিনা। এদিকে আওয়ামীলীগ নিষিদ্ধের দাবী উঠছে। অথচ ক্ষমতার অংশীদার হতে সংবিধান মতে বিরোধী দল হয়ে সুবিধাভোগের ক্ষেত্রে হাত তোলা ‘পাটির্’ জাতীয় পার্টি (জিএম কাদের-চুন্ন-রওশান এরশাদ গং) জাপাসহ ১৪ দল জোটভুক্তভাবেই সবকিছু করেছে এবং তা অব্যাহত রাখতে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য ‘গণহত্যা’ চালিয়েছে। তাই গণরায়কে সম্মান দিয়ে শহীদদের আত্মত্যাগ ও আহতদের রক্ত এবং তাদের স্বজনদের চোখের পানিকে স্বার্থক করতে যা যা করার, তা করতে হবে। এবং তা করতে হবে জনগণ নতুন করে হতাশাগ্রস্থ হওয়ার আগে। তবে স্মরণ সাপেক্ষ যে, শহীদদের রক্তের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করে কারও রক্ষা হয় না, হবে না। ভাষ্যকার হিসেবে এর চেয়ে আর বেশি কোন ‘ভাষ্য’ এ মুহুর্তে নেই। রিক্সাচালক ভাল থাকুন এই কামনার সাথে তাঁর কথাগুলো বিবেচনারও অনুরোধ থাকলো এই অধম ভাষ্যকারের ভাসা কথার ভাষ্যে।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *