নিজস্ব বার্তা প্ররিবেশক: লেখক-গবেষক বদরুদ্দীন উমরকে ভোলা যাবে কি। বদরুদ্দীন উমর কি শুধুই লেখক-গবেষক? না। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন সমাজ বিশ্লেষক, শতাধিক বইয়ের লেখক হলেও তিনি শুধু লেখক ও গবেষক ছিলেন না। তিনি জীবিকা অর্জনে বুদ্ধি বিক্রেতা বুদ্ধিজীবিও ছিলেন না। তিনি সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, নয়াউপনিবেশিবাদ, সামন্ত-আমলা-মুৎসদ্দি, পুঁজিবাদ বিরোধী সমাজতান্ত্রিক ভাবুক, তত্ত্বচর্চার মহিরুহ গণআন্দোলনে বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকা পালনকারী বুদ্ধিজীবি, লেখক-গবেষক, সাংবাদিক-রাজনীতিক ব্যক্তিত্ব এবং আদর্শবান শিক্ষক। এখানেই শেষ নয়। তবে আজকের শিরোনাম ভিত্তিক এই প্রতিবেদনের ভূমিকায় আলোচিত অংশটুকুই দৃঢ়তার সাথে জানান দিচ্ছে-‘লেখক-গবেষক বদরুদ্দীন উমরকে ভোলা যাবে না। তিনি মরেও অমর হয়ে থাকবেন তার লেখনী এবং সমাজ বদলের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রত্যক্ষ ভূমিকার মধ্য দিয়ে।
লেখক-গবেষক বদরুদ্দীন উমরকে ভোলা যাবে কি’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে তাঁর ৯৪ বছর বয়সকাল পর্যন্ত সময়ের শৈশব-কৈশর ও যৌবনকাল তথা ছাত্রজীবন থেকে শিক্ষাকতার পেশাগত জীবনে অর্জিত বিভিন্ন ক্ষেত্রভেদের পরিচিতির প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে মাত্র। এরই মধ্যে গত রোববার ৭ সেপ্টেম্বর সকালে রাজধানীর একটি হাসপাতালে জীবন প্রদীপ নিভে যায় জ্ঞানের আলো ছড়ানো শতাধিক বইয়ের লেখক-গবেষক বদরুদ্দীন উমরের। প্রথম আলো প্রতিকার উপসম্পাদকীয় কলামের নিয়মিত লেখক, যিনি নিজেও লেখক-গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর একটি লেখায় লিখেছেন-‘পাক-ভারত উপমহাদেশে বিশেষত : বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা বুঝতে অর্থাৎ আমাদের দেশে ‘সেক্যুলার রাজনীতি’র যে দার্শনিক বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা এবং ইতিহাস বিষয়ের যে গবেষণা সাতচল্লিশ পরবর্তী আমাদের এই সমাজে বদরুদ্দীন উমরই ছিল পথিকৃত। তারপর ঐ লেভেলে আর কেউ করতে পারেনি’।
সমাজতন্ত্রমুখী মার্কসবাদী তাত্ত্বিক বুদ্ধিজীবি বদরুদ্দীন উমর-এর বিচরণ ছিল লেখার জগতে, শিক্ষাঙ্গনে, সংবাদপত্র জগতে এবং রাজনৈতিক ও সাংষ্কৃতিক অঙ্গনে। এসবের প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে তাঁকে অমর করে রাখার মতো অবদান। যুগের ও সময়ের বিবেচনায় এবং সেই সময়কালের বাস্তবতায় এমন কিছু ভূমিকা বা কার্যক্রম মণীষীরা করেছেন- যা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে থাকে। যেমন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা বিদ্রোহী কবিতা ঝড় তুলেছিল পাক ভারত উপমাহাদেশে। তেমন ঝড় না তুলতে পারলেও লেখক-গবেষক রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর এর লেখা ‘সাম্প্রদায়িকতা’ ও ‘সাংষ্কৃতি’ বিষয়ক বই দুটি দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত জ্ঞান বিকাশে পড়ুয়া, রাজনৈতিক ও সাংষ্কৃতিক সচেতন মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। লেখক-গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের লেখা বলছে- বদরুদ্দীন উমরের রাজনৈতিক সামাজিক চিন্তাভাবনার বহি:প্রকাশ ঘটেছে বামপন্থীদের ‘সরুতহাল’ বইটি। সেটিও কম আলোচনায় আসেনি।
ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতে, বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুতে দেশের বাম রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হলো এবং একইভাবে আমাদের সাংষ্কৃতিক জগৎ অন্যতম প্রধান ব্যক্তিকে হারাল। তিনিও একজন আপনজন হরালেন। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুতে ওই প্রজন্মের যাঁরা ধর্মীয় রক্ষণশীল একটি পরিবেশ থেকে বাঙালি মুসলমানকে বের করে এনেছিলেন, তাঁদের আর কেউ বেঁচে রইলেন না। তিনি লিখেছেন, বদরুদ্দীন উমর ভয়ভীতি, লোভ-লালসা ও হতাশাকে শত্রু বিবেচনা করতেন হেতু কোনটিই তাঁর মধ্যে বিন্দুমাত্র কাজ করেনি। এমনকি স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত সমালোচনা করার যখন কেউ সাহস করতেন না তখন উমর ভাই ছিলেন ব্যতিক্রম। সেই সময়কালে সমালোচনা করেছেন ধারাবাহিকভাবে। এমনকি উমর ভাই তাঁর এক সমালোচনায় তুলে ধরেছেনÑ শেখ মুজিব পার্লামেন্টে দাড়িয়ে নিজেই এক সময় বলেছিলেন, ‘সিরাজ সিকদার কোথায়? কিন্তু ওই বছরেরই আগস্টে ইতিহাসের প্রতিশোধ হয়েছিল; যখন দেশের মানুষ বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব কোথায়?’ অনেক সময়ই ইতিহাসে প্রতিশোধের রূপে ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটে। উমর ভাই অনেক ক্ষেত্রেই অদ্বিতীয় ছিলেন উল্লেখ করে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, আমাদের দেশে লেখা-পড়ার চর্চা কম থাকলেও উমর ভাই ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি রাজনীতির কাজে এবং লেখার মাধ্যমে তিনি জ্ঞান চর্চার বিকাশ ঘটিয়েছেন।

লেখক-গবেষক বদরুদ্দীন উমরকে ভোলা যাবে কি শিরোনামের প্রশ্নাত্তরে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বিবিসিকে মুক্ত চিন্তার ধারক ও শ্রমিক শ্রেনীর শ্রেনীচেতনাকে লালনকারী লেখক-গবেষক বদরুদ্দীন উমর সম্পর্কে যা বলেছেন, তাতে লেখক-গবেষক বদরুদ্দীন উমরকে ভোলা যাবে না। অধ্যাপক আনু মোহাম্মদের মতে, অক্সফোর্ডে পড়াশোনা ও গবেষনাকালে বদরুদ্দীন উমর আন্তর্জাতিক বামধারার ব্যক্তিদের সংস্পর্শে থেকেছেন তাঁদের সাথে আলোচনা ও পড়াশোনা থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক দায়বোধ তৈরী হয়। এটাকে সমৃদ্ধ করেছে তাঁর পড়াশোনার বিষয়ের রাজনীতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্র বিজ্ঞান ও দর্শন বিষয়গুলো। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে খন্ডকালীন কর্মজীবন শুরু করেন। পরে সেখান থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে কিছুকাল সেখানে শিক্ষকতা করেন। তবে তিনি এক সময় রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার তাগিদ অনুভব করেন। তিনি বাম ধারার চীনাপন্থি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন। ১৯৬৮ সালে শিক্ষকতা ত্যাগ করে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোট ও কৃষক ফেডারেশনে জড়িত থাকা অবস্থায় একজন নেতা ছিলেন। তিনি জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি ছিলেন। গবেষকদের মতামত ভিত্তিতে আনু মুহাম্মদ বলেছেন, রাজনীতিক বুদ্ধিজীবি বদরুদ্দীন উমরের লেখা বইগুলো উপলব্ধি, আত্মঅনুসন্ধান ও বাঙ্গালীর লড়াইয়ের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। আনু মুহাম্মদের মতে লেখক বদরুদ্দীন উমরের লেখা ‘পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ বইটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সংবাদপত্র জগতে বিচরণকালে শ্রমিক শ্রেণীর দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি সংবাদপত্রে কাজ করেছেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান কমিউিনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক মতাদর্শ ভিত্তিক সাপ্তাহিক গণশক্তি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনি দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকায় কাজ করেছেন। একটানা ত্রিশ বছরের বেশি সময়কাল থেকে ‘সংষ্কৃতি’ নামে রাজনৈতিক সাময়িকী সম্পাদনা করেছেন। হোলিডেসহ বিভিন্ন কাগজে কলাম লিখেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলা একাডেমি ১৯৭৩ সালে ‘বাংলা একাডেমী পুরুষ্কার’ ঘোষণা করলেও সরকারের সাথে নীতিগত পার্থক্য থাকায় তা গ্রহণ করেননি। এছাড়া বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা থেকে পুরুষ্কার ঘোষনা করলেও তিনি তাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে গণমাধ্যমকে তাঁর প্রদত্ত বিবৃতির মাধ্যমে সরকার ঘোষিত পুরুষ্কার গ্রহন তাঁর পক্ষে সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দিয়েছেন।
১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে জন্মগ্রহন করেন। বদরুদ্দীন উমর। তাঁর বাবা আবুল হাশিম ছিলেন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও মুসলীলীগ নেতা। ১৯৫০ সালে স্নাতক ও ১৯৫৫ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে ১৯৬১ সালে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যলয় থেকে পিপিই ডিগ্রী অর্জন করেন। সারসংক্ষেপে নিসংকোচে বলা যায়, বদরুদ্দীন উমরকে ভোলা যাবে না। তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর লেখায় ও আপোষহীন ভূমিকার জন্য। বদরুদ্দীন উমরের আত্মার শান্তি কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেছে গণপ্রহরী।
আরও পড়ুন- শুরুতে গুলিবিদ্ধ ফয়েজ আহমেদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা
