Sat. Jul 12th, 2025
শুরুতে গুলিবিদ্ধ ফয়েজ আহমেদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথাফয়েজ আহমেদ

শুরুতে গুলিবিদ্ধ ফয়েজ আহমেদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা। মুক্তিযুদ্ধে কেউ যোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধ করতে চাইলেই যে, অস্ত্র হাতে পাবে এবং যুদ্ধ করবে এমন কোন কথা নেই। অন্তত আমর জীবনে আমি তাই দেখেছি। ঢাকায় আমি আহত হই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার ১ দিন আগেই। সে এক আরেক ইতিহাস। ঢাকায় সামান্য চিকিৎসার পর যখন আমি বিক্রমপুরে নিজ গ্রামে গেলাম মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করতে। তখন এক বিব্রতকর, বিচ্ছিরি পরিস্থিতির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হলাম। বাড়ি থেকে আধ মাইল দুরে শ্রীনগর থানার  ১৯ জন পুলিশ কনস্টেবল নিজ নিজ রাইফেল সাধারণ মানুষের কাছে বিলিয়ে দিয়ে ২৭ তারিখে সাদা পোষাকে পালিয়ে গেছে। এপ্রিল মাসে শেষের দিকে গ্রামের যুবকদের ডেকে যখন মুক্তিযুদ্ধ কথাটা বললাম তখন এর কোন অর্থ তারা খুঁজে পেল না। তারা প্রথমে বললো কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে এবং অস্ত্র কোথায়? অস্ত্র শিক্ষাই বা কে দেবে? এতদিন তারা শ্লোগান দিয়ে রাজনীতি করেছে অস্ত্র হাতে তুলে নেবার কথা বাস্তবে তারা ভাবেনি। যুদ্ধ করার চাইতে আমার মত একজন আহত লোককে দেখাই যেন তাদের কাছে সবচাইতে বড় কথা ছিল। এই পরিস্থিতিতে অধিকাংশ কৃষকের ছেলে ও কিছু মধ্যবৃত্ত ঘরের সন্তানদের নানাভাবে মোটিভেশন দেয়ার সময় খবর আসলো যে ধলেশ্বরী পার হয়ে একদল সৈন্য সৈয়দপুর দিয়ে বিক্রমপুরে প্রবেশ করেছে। অপর একদল সৈন্য লৌহজং দিয়ে শ্রীনগর থানার দিকে আসছে। এই খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে যে সামান্য মুক্তিবাহিনী গঠন করার চেষ্টা করেছিলাম, তা পণ্ড হয়ে গেল। অবশ্য আর ছ’ মাস পরে এই শ্রীনগরেই পাকিস্তানী সেনাদের সাথে গ্রামে ছেলেদের সাথে যুদ্ধ হয়েছিল। একটা হিসাব মতে শ্রীনগরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় গেরিলারা ৩৯ জন পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাকে হত্যা করেছিল।

আমি তারপরেই মে মাসের দিকে ঢাকায় বা বাইরে কোথাও আশ্রয় না পেয়ে কুমিল্লা দিয়ে এক সন্ধ্যায় আগরতলা পাহাড় অঞ্চলে উপস্থিত হই। আমরা ৭/৮ জন ছিলাম একসাথে; তার মধ্যে আমার এক হিন্দু ডা: বন্ধুর স্ত্রী ও শালী ছিলো। এই দলে আমাদের দেশের বিশিষ্ট নেতৃ জাহানারা ইমামের শহীদ পুত্র রুমিও ছিলেন। আমরা ৮/৯ জনের ভিতরে কামাল লোহানী ছিলেন প্রধান পরামর্শক। তিনি বিভিন্ন গ্রাম ও লোকের সঙ্গে পরামর্শ করে আমাদের ভারতের ভূমিতে নিয়ে যেতে সহায়তা করেছিলেন। আমাদের সাথে রুমিসহ যে চারজন যুবক ছিলেন তারা প্রকৃত পক্ষেই মুক্তিযোদ্ধা। এই রুমিই পরে শহীদ হন। আরেকজনের খবর আমরা এখনো জানি না। কামাল লোহানী ও অন্যান্যদের নিয়ে ত্রিপুরার এক পাহাড়ি অঞ্চলে এক থানার উন্মুক্ত স্থানে আমরা আশ্রয় নেই। আমাদের মধ্যে প্রত্যেকেই চেয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা হতে। সবাই চেয়েছিলেন অস্ত্র। কেউ লেখনীর কথা ভাবেননি। কলম আমাদের কাছে তখন ছিলো অস্পৃশ্য। আর অস্ত্র ছিলো পরম প্রাপ্য।

আরও পড়ুন- মুক্তিযুদ্ধের বিজয় কি সত্যিই দূরে (?)

পরের দিন আগরতলায় আহত আমাকে সবাই একটা জিপ থেকে নামিয়ে দিলো কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে। লোকজন আমাকে বললেন যে, আমরাই চিকিৎসা করবো এবং আপনাকে কোলকাতায় পাঠাবো। লোহানী ও অন্যান্যরা সেই জিপে কে কোথায় কোন ক্যাম্পে হারিয়ে গেল তারপরে আর দীর্ঘদিন জানি না।

আগরতলায় যখন আমি চেষ্টা করলাম খালেদ মোশারফ, বাসার ও জিয়াউর রহমানের সাথে যোগযোগ করতে তাতে আমি ব্যর্থ হই। কেউ তাদের বর্ডার এলাকার সুযোগ সন্ধান দিতে পারছিলো না। অস্ত্র ধারণের কথা শুনে বাংলাদেশেরই অনেক যুবক আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকতো। তাদের কি একটা কথা ছিলো তখনও আমি জানি না। আমি বলতাম আমি সাধারণ একটা লোক, ঢাকায় সরকারী কাজ করতাম; আমি যুদ্ধ করতে চাই। কোন সাড়া পেতাম না।

কমান্ডারদের সন্ধান করতে যেয়ে আমি কারো কারো কাছ থেকে বাধা পেলাম। বাংলাদেশ অঞ্চলে আখাউড়া থেকে পাকিস্তানীরা যে গোলা বর্ষণ করতো তাতে সন্ধার পর থেকে আগরতলা শহর মুহুর্মুহ কম্পিত হয়ে উঠতো। অনেক রাতেই আমার ঘুম হয় নাই। তখন একদিন খবর আসলো ১২ জন প্রগতিশীল ছেলেকে আগতলার জঙ্গলে হত্যা করা হয়েছে। আমাকে আমাকে একজন যোদ্ধা জানালেন, এটা মুক্তিযুদ্ধের সবার অধিকার থাকলেও সবাইকে অস্ত্র দেয়া হয় না। এই ব্যাপারে কলহের কারণে উক্ত ঐ ১২ জন প্রগতিশীল ছেলের মৃত্যু হয়েছে। আগতলার শহর আর বর্ডার এলাকার পরিস্থিতির মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ ছিলো।

একদিন আমাকে চিকিৎসার পর পার্টি থেকে কোলকাতার পথে বিমানে উঠিয়ে দেয়া হলো। আমি আসামের গৌহাটি হয়ে ঐ ছোট বিমানে ৬ ঘন্টায় শিলিগুড়ির ওপর দিয়ে ঘুরে কোলকাতায় পৌঁছাই।

এখনকার বাস্তবতা আর একটু ভিন্ন ধরণের। তখন সমস্ত শ্রেণী ও মতামতের প্রগতিশীল ও কমিউনিস্টরা বিক্ষুব্ধ অবস্থায় ছিলো। তারা সাবই আওয়ামীলীগের একটি শ্রেণীর বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখছিলেন এবং বলছিলেন যে কমিউনিস্টদের যুদ্ধে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। সেজন্য তারা মে মাসের শেষের দিকে শিয়ালদহস্থ টাওয়ার হোটেলের একটি হলে তিনদিন যাবৎ এক আলোচনা সভায় মিলিত হয়। আমি সেই হোটেলে বিভিন্ন পরস্পর বিরোধী কমিউনিস্ট নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করি। তাদের প্রত্যেকের অভিযোগ হচ্ছে আওয়ামীলীগ নামীয় যুবকরা প্রগতিশীলদের হাতে অস্ত্র গ্রহণের বিরোধীতা করছে এবং যুদ্ধে যেতে দিচ্ছে না। এই অভিযোগ প্রত্যেকটি কর্মী ও নেতার।

মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে এই জাতীয় বিভাজন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ছিলো তাতে কোন সন্দেহ নেই। আগরতলাতেই অস্ত্র নিয়ে এই দ্বন্দ্ব ও কলহ দেখে এসেছি। এরা সবাই বিভিন্ন যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রাণ দিতে এসে বিমুখ হয়েছে। ৩০ শে মে সমস্ত  প্রগতিশীল কমিউনিস্ট নেতা ও কর্মীর সমন্বয় কমিটি নামে একটি কমিটি গঠন করেন। সেই দিনেই তারা সম্মেলন থেকে বেড়িয়ে সমন্বয় কমিটির প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করেন।

তাজউদ্দীন সাহেবের নিকট কাজী জাফর, মেনন প্রমুখ অভিযোগ করেন যে, কমিউনিস্ট ও প্রগতিশীলদের মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামীলীগের কর্মীরা অস্ত্রধারণ করতে দিচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধ কোন রেগুলার আর্মি দ্বারা পরিচালিত যুদ্ধ নয়। এই যুদ্ধে দেশের জন্য শিশু থেকে আরম্ভ করে বৃদ্ধ পর্যন্ত যোগদান করতে পারে। তাজউদ্দিন সাহেব সমস্ত কথা শুনে তাদেও সাথে একমত হলেন কিন্তু জানালেন যে, তার পক্ষে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়।

কারণ পার্টিও নির্দেশ ছাড়াই একটি উপদল, আওয়ামীলীলে নামে এই ব্যবস্থা অবলম্বন করেছে। তিনি জানতেন যে, তার বিরোধী কোন ব্যক্তি এই জাতীয় সিদ্ধান্ত করে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে। এর পিছনে একটি রাজনীতি কাজ করেছে। সেই রাজনীতির উচ্চ পর্যায়ে অন্য একটি দেশের হস্তক্ষেপ ও পরামর্শ রয়েছে। সুতরাং তিনি নিরুপায় অবস্থায় প্রগতিশীল নেতৃবর্গকে চা খাইয়ে বিদায় করিয়ে দেন। এর পরবর্তীতে প্রগতিশীলরা যার যার পথে মৈত্রী সন্ধান করে যুদ্ধে যাবার চেষ্টা চালায়। আমি একটি ছেলেকে চিনি যে কোনদিনই ছাত্রলীগের নয় বরং ছাত্র ইউনিয়নে সর্বদা কাজ করেছে। সে ছাত্রলীগের কর্মীকে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রকারীদের জানান যে, এই ছেলেটি ছাত্রলীগের একজন নেতা এবং তার বন্ধু। ছাত্রলীগের এই ছেলেটিকে মুক্তিযুদ্ধের একটা ইউনিটের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আমি পড়ে গেলাম এদের মধ্যে একজন অস্ত্রহীন সৈনিক হিসেবে। আমাকে কোন ইউনিটে নেয়া হয়নি শেষ পর্যন্ত আমি স্বাধীন বাংলার সচিবালয়ে গিয়ে এক বন্ধু সেক্রেটারীর নিকট সাক্ষাৎ করি। তাদের জানাই যে, আমি যুদ্ধ ক্ষেত্রে অস্ত্র হাতে শত্রুর মোকাবেলা করতে চাই। কোন পথেই সেটা সম্ভব হয়ে উঠছে না।

আরও পড়ুন- উনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান প্রেক্ষিতে জানুয়ারির সতর্কবার্তা

বহু আওয়ামীলীগ নেতা ও কর্মীর সাথে আমি পরিচিত ছিলাম, এটা একটা সমস্যা ছিলো। বন্ধু সেক্রেটারী নুরুল কাদের আমাকে যুদ্ধ ক্ষেত্রে দেখতে চান না। তবুও তিনি আমার অনুরোধে প্রধান সেনাপতি ওসমানীর সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু প্রধান সেনাপতির সাথে দেখা করতে চাইলে তাঁর স্টাফ অফিসার কারো একজনের সাথে কথা বলতে হয়। একটু পরে যিনি আমার সামনে এসে চেয়ারে বসলেন তিনি ক্যাপ্টেন শিশু। কিছুটা আহত বলে তাকে হেড কোয়ার্টারে রাখা হয়েছে। শিশু আমাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন আমি আওয়ামীলীগ করি কি না। আমি কোনকালে ছাত্রলীগের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলাম কি? এই দুটো প্রশ্নেরই উত্তরে আমি বললাম ‘না’। আমি আরও বললাম যে মুক্তিযুদ্ধে যেকোন লোকই অংশগ্রহণ করতে পারে। তিনি সরাসরি বললেন, আপনাকে নেয়া যাবে না।

এরপর তিনি আবার  হাসিমুখে প্রধান সেনাপতির কক্ষের দিকে চলে গেলেন।

এই সেক্রেটারিয়েটের সবাই আমার বনধু তারা কেউ চান না যে আমি যুদ্ধে যাই। ক্যাপ্টেন শিশুর প্রশ্ন হচ্ছে যিনি আওয়ামীলীগের বা ছাত্রলীগের না হোন তাকে যুদ্ধে যেতে দেয়া হবে না- এই কথাটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এর পূর্বে আমি ‘জয় বাংলা’ সাপ্তাহিক পত্রিকার অফিসে গিয়েছিলাম। বালু হাক্কাক লেন- এর একটা বাড়িতে ‘জয় বাংলা’ অফিস। গিয়ে দেখি আমার খুব পরিচিত ঘনিষ্ঠ এক এমপি আব্দুল মান্নান টেবিলের সামনে বসা। তার চারদিকে আমার বন্ধু মাহাবুব উল্লাহ মুকুল ও লোহানীসহ অন্যনা জায়গা দখল করে আছেন। একজন উঠে গিয়ে আমাকে বসতে দিলেন ঠিকই কিন্তু তাতে আলোচনা বন্ধ হয়ে গেল। আমি কবে কলকাতায় এসেছি কি অবস্থায় আছি তাও জিজ্ঞেস করা হলো না। হঠাৎ করে মান্নান সাহেব সবাইকে বললেন, চলুন সময় হয়ে গেছে। তিনি আমার দিকে চেয়ে হাসলেন কিন্তু তার সাথে আমাকে যেতে বললেন না। তারা তখন সবাই মিলে সেই বিকেলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র উদ্বোধন করতে গেলেন। সম্ভবত সেই দিনটা ছিল ২৪ শে মে।

 কোথাও তখন আমার কোন যুদ্ধে যাবার সুযোগ মিললো না। তখন আমি জনৈক উত্তরবঙ্গীয় এক ব্যক্তির সাথে পরামর্শ করে উত্তরবঙ্গে যুদ্ধ ঘাঁটি ও শরণার্থীদের এলাকায় যাওয়ার আয়োজন করলাম। এভাবে একদিন আমি ভারতের মালদহ দিনাজপুর অঞ্চলের বর্ডার এলাকায় চলে যাই। আমি ভেবেছিলাম এই অঞ্চলে হয়তো আওয়ামীলীগ সংক্রান্ত প্রশ্নটি উত্থাপিত হবে না। তখনকার এক শরণার্থী শিবিরে কয়েকজন যুবক আমাকে ধরলেন। তারাও আমার মতো অস্ত্রহীন মুক্তিযোদ্ধা। তাদের কাছে জানতে পারলাম মে মাসের দিকে যারাই অস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশ করছে, তাদের হাত থেকে ভারতীয় বর্ডারের সৈনিক ও পুলিশরা অস্ত্র কেড়ে নিচ্ছে। তারা বলছে সরকারী নির্দেশে আমরা এই কাজ করছি। তারা বললেন, আশংকা রয়েছে এইসব অস্ত্র নকশালীরা হয় কিনে, না হয় ছিনিয়ে নিয়ে যাবে। তখনকার কংগ্রেসী সরকার বর্ডার অতিক্রমকারী সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে এইভাবে নিরস্ত্র করেছিলেন এবং তাদের সিংহভাগই যুদ্ধে যোগদান করতে পারেনি।

আমি সে সময় জলপাইগুড়িতে রাত কাটাতাম আর দিন কাটতো শিলিগুড়িতে।

হঠাৎ একদিন টেলিগ্রামে আসলো কোলকাতা থেকে এক বন্ধুর, যথাশীঘ্র সম্ভব কোলকাতায় প্রত্যাবর্তন করার জন্য। আমি ভাবলাম, যুদ্ধ ক্ষেত্রে যাওয়ার এই বুঝি একটা সুযোগ আসলো। আবার শিলিগুড়ি থেকে রেলে চড়ে কোলকাতায় উপস্থিত। কোলকাতায় আমাকে সেই বন্ধু জানালেন যে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে লেখকের অভাব দেখা দিয়েছে। উক্ত রেডিওতে নিউজ, কথিকা, সঙ্গীত, যুদ্ধ সংক্রান্ত তথ্যাদি ইত্যাদি প্রতিদিনই পরিবেশন করতে হয়। তাদের কথামত আমি লেখা শুরু করলাম আর চেষ্টা করতে লাগলাম কিভাবে যুদ্ধে যাওয়া যায়। ভারতীয় সরকার কোন সময়ই চাননি যে স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামীলীগ ছাড়া অন্য কেউ ক্ষমতা গ্রহণ করুক। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেও আওয়ামীলীগ ভিন্নমতবলম্বী পরিহার করেছে।

কিন্তু একদিন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন সাহেবের আহ্বান আসলো তাঁর সাথে দেখা করার জন্য। তিনি বললেন, ফয়েজ সাহেব সমস্তটাই এখন যুদ্ধক্ষেত্র; লেখুন অথবা বন্দুক ব্যবহার করুন একই কথা। আমি চাই আপনি স্বাধীন বাংলা বেতার ফিল্ডে অংশ নিন। তিনি সর্বশেষে বললেন, যুদ্ধের সময় মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ বলে একটা কথা আছে, সেটা প্রপাগান্ডামূলক। আমাদের বেতারে এই জাতীয় একটি লেখা আমি মনে করি একান্ত প্রয়োজন। সেই থেকে আমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নিয়মিত একটি কলাম লিখতাম। মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ সংক্রান্ত যার নাম ছিলো ‘পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে’। ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানীরা আত্মসমর্পণ করার সময় আমার শেষ লেখা ‘পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে’ এই রেডিওতে পাঠ করা হয়।

আমার নিকট বন্ধুদের মধ্যে যারা স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে কোলকাতায় যেতে পেরেছিলেন তারাই কেবল এই রেডিওতে নিজেদের নাম উচ্চারণ করতে পেরেছেন। যুদ্ধ ক্ষেত্রে আমি যুদ্ধ করিনি তাজউদ্দিন সাহেবের ভাষায় ‘সমস্ত কর্মকাণ্ডই মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র’, সেক্ষেত্রে আমি বিচরণ করেছি। [গণপ্রহরীর পুরোনো ফাইল থেকে]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *