Thu. Jul 10th, 2025
‘শ্যামপুর চিনিকল’ আখচাষিদের মাঝে শঙ্কা কাটছেনাশ্যামপুর চিনিকল

স্বপন চৌধুরী : ‘শ্যামপুর চিনিকল’ আখচাষিদের মাঝে শঙ্কা কাটছেনা। ‘চিনিকল বন্ধ করি আগের সরকার তো হামার কপাল খাইছে। আখ চাষ কইরবার না পায়া খ্যায়া-না খ্যায়া দিন কাটাওছি। মিল চালু করবে বলি ইউনুস সরকার আসি হামার আখ চাষ কইরবার কইল। কিন্তুক সময় আসি গেইল, এ্যালাও ক্যানবা কোনো খবরে নাই!’ পুরোদমে ফের আখ চাষের আশায় জমি ফেলে রেখে হতাশার এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন শ্যামপুর চিনিকল এলাকার আখচাষি দবির আলী। বন্ধ থাকা রংপুরের শ্যামপুর চিনিকলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের আখ রোপনের অনুমতি দিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। যাতে চিনিকল ঘিরে ফের আশার আলো দেখেছিলেন স্থানীয়রা। কিন্তু অনুমতির প্রায় ৬ মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কার্যকর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এতে দবির আলীর মতো নতুন করে আবারও হতাশা বিরাজ করছে চিনিকল এলাকার আখচাষিদের মাঝে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পাঁচ বছর আগে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার রংপুরের শ্যামপুর সুগার মিল, পাবনা সুগার মিল, পঞ্চগড় সুগার মিল, সেতাবগঞ্জ সুগার মিল, রংপুর সুগার মিল ও কুষ্টিয়া সুগার মিলে চিনি উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। সে সময় সংস্কার ও আধুনিকায়নের উদ্দেশ্যেই কারখানাগুলো আপাতত বন্ধ করা হচ্ছে বলে জানানো হলেও ৫ বছরে চিনি কলগুলো চালুর কোন উদ্যোগ নেয়নি বিগত সরকার। এমনকি বন্ধ চিনিকলগুলো চালুর জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রস্তাবনা পাঠালেও সে সময় কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বন্ধ চিনিকল চালু করতে একটি টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করে। সেই অনুযায়ী চিনিকল এলাকায় আখ চাষের অনুমতিও দেওয়া হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত আখ চাষে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। শ্যামপুরের আখচাষি সামছুজ্জামান বলেন, বর্তমান সরকার চিনিকল এলাকায় আখ রোপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিষয়টি শুনে শ্যামপুর এলাকার আখচাষিদের মধ্যে আশার আলো জেগেছিল। কিন্তু দীর্ঘদিনেও বীজ-সারসহ আনুসাঙ্গিক বিষয়ে কোন অগ্রগতি না থাকায় আমরা হতাশ।

শ্যামপুর চিনিকল এলাকা ঘুরে দেখা যায়, আখ চাষের আশায় জমি ফেলে রেখে অপেক্ষার প্রহর গুণছেন চাষিরা। অনেকে নিজ উদ্যোগে কিছু জমিতে আখের চারা রোপনও করেছেন। তারা জানান, বাপ-দাদার আমল থেকে আখ চাষ করছেন। বিগত সরকার চিনিকল বন্ধ করে দেওয়ায় তারা দিশেহারা হয়ে পড়েন। দীর্ঘ পাঁচ বছর বিকল্প ফসল উৎপাদনের চেষ্টা করেও লোকসান গুণতে হয়েছে। নতুন করে আখ চাষের অনুমতির খবরে তাই তারা আশায় জমি ফেলে রেখেছেন। এলাকার বড় আখচাষি আব্দুস সোবহান ও সাহেব আলী জানান, আগে চিনিকল এলাকায় ৭০টি ইক্ষু উন্নয়ন সহকারী পদ ছিল। তারা চাষিদের আখ চাষে উদ্বুদ্ধসহ বিভিন্ন পরামর্শ দিতেন। এখন পর্যন্ত তাদের মাঠ পর্যায়ে দেখা যায়নি। এছাড়া ৬টি সাবজোন ছিল, যেখান থেকে চাষিদের বীজ-সার সরবরাহ করা হত। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন সাবজোন গঠন করা হয়নি। আব্দুল কুদ্দুস, রওশন আলীসহ স্থানীয় চাষিরা জানান, আখের জমিতে অন্য ফসল ভালো হয়না। তার পরও বেঁচে থাকার তাগিদে বিগত পাঁচ বছর বিকল্প উৎপাদনের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু লাভ হয়নি। সরকারের অনুমতির খবরে নতুন করে আখ চাষের আশায় ফেলে রাখা জমি দেখিয়ে তারা বলেন, আর ক’দিন পরে আখ রোপনের মৌসুম শুরু হবে। এখন পর্যন্ত বীজ-সার সম্পর্কে কেউ যোগাযোগ করেনি। মিল চালু থাকাকালে ৬ হাজারের বেশি আখচাষি থাকলেও এখন চাষির সংখ্যা প্রায় শুন্যের কোঠায় বলেও জানান তারা। আখচাষি ও চিনিকল রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ রংপুর জেলার আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন বাবলু বলেন, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের জনস্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্তের ফলে শ্যামপুর চিনিকল পাঁচ বছর যাবৎ বন্ধ আছে। যদিও এই চিনিকল হাজারো আখচাষি, শ্রমিক এবং শ্যামপুর এলাকার বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন ছিল। চিনিকলটি বন্ধ হওয়ায় এই অঞ্চলের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাই অবিলম্বে বিগত সরকারের জনস্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত বাতিল করে শ্যামপুর চিনিকল চালুসহ চাষিদের আখ চাষের পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান তিনি।

চিনিকল চালু রাখতে ৬০ হাজার মেট্রিক টন আখের প্রয়োজন। পর্যাপ্ত আখ পাওয়া যাবে কিনা এ নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্টরা। দেখা যায়, বর্তমানে বন্ধ থাকায় শ্যামপুর চিনিকল জনমানবহীন ভুতরে অবস্থায় রয়েছে। যন্ত্রপাতি-যানবাহন পাহারা দেওয়ার জন্য রয়েছে হাতেগোনা কয়েকজন গার্ড এবং দুই-একজন কর্মকর্তা। যদিও বন্ধ হওয়ার প্রাক্কালে শ্যামপুর চিনিকলে ৪৪৭ জন শ্রমিক কাজ করতেন। একজন এমডিসহ মোট ৪০ জনের মত কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন। এদের অন্য চিনিকলে বদলি করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। বর্তমানে ১৬/১৭ জন গার্ড রয়েছে শুধু পাহারা দেওয়ার জন্য। 

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বন্ধ ছয় চিনিকল চালু করতে গঠিত টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য আলতাফ হোসেন বলেন, শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, সচিবসহ কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকের পরে আখ চাষের অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু আখ চাষ করতে যেসব প্রস্তুতি গ্রহণ করা দরকার তার কিছুই এখন পর্যন্ত হয়নি। বন্ধ চিনিকল চালু করতে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে একটি বাজেট অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অর্থ ছাড় দিলে চিনিকল এলাকায় আখ চাষ করা শুরু হবে। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে শ্যামপুর চিনিকল এলাকায় আড়াই হাজার একর জমিতে আখ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। পরের বছর চার হাজার একরে আখ চাষ করা হবে। এই সিদ্ধান্ত শিল্পমন্ত্রণালায় থেকে নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

আরও পড়ুন- পানি সংকট : দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্পে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *