‘সংখ্যালঘু’ কথাটি জাতীয় ইতিহাস ঐতিহ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। কেননা, এ দেশ মুক্তিযুদ্ধের ফসল। সেই মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, এ দেশের মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রিষ্টানসহ সকল ধর্ম-বর্ণের বীর জনগণের দামাল সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা। জীবন দিয়েছেন সকল ধর্ম-বর্ণের বীর শহীদরা। একই ভাবে সম্ভ্রম ও হারিয়েছেন সকল-ধর্ম-বর্ণ, জাতি-উপজাতির মানুষ। সে দেশে কেন সংখ্যালঘু বিষয়টা নিয়ে কথা। কেনইবা জাতি ধর্ম-বর্ণের আলোচনা।
ইতিহাস স্বাক্ষ্য দিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ-সামস্তবাদ-আমলা-মুৎসদ্দি-পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ধর্মই হচ্ছে সাপম্প্রদায়িকতা, উগ্র-জাতীয়তাবাদ ও বর্ণ বৈষম্যকে ব্যবহার করে শাসন-শোষণকে নিশ্চিত করা। তারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাার উগ্র জাতীয়তাবাদী দাঙ্গা বাধায় ও বর্ণ বিভেদ তৈরী করে। এ ক্ষেত্রে ‘সংখ্যালঘু’ কথাটি কেন-সে নিয়ে ইতিহাসের আলোকে দু’চারটা কথা তুলে ধরা আবশ্যকীয় করে তুলেছে, বিদ্যমান পরিস্থিতি। সে নিয়েই আজকের আলোচনা।
‘সংখ্যালঘু’ কথাটি জাতীয় ইতিহাস ঐতিহ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে’ শীর্ষক আলোচনার শুরুতে দেশের পিছিয়ে থাকা উত্তর জনপদের রংপুর অঞ্চলে (অঞ্চলভেদে) চুটকি হিসেবে ব্যবহৃত আঞ্চলিক প্রবাদ তুলে ধরছি। একজন ব্যক্তি কারো কোন গোপন বা ঝুঁকিপূর্ণ কথা শুনলে, তা যতক্ষণ সে অন্য কাকেও বলতে না পারে ততক্ষণ তার পেটটা ফুলতে থাকে। কোথায় কোন যুগে কে বলেছেন। আর তা কেবা শুনেছেন তার কোন স্বাক্ষ্য বা ভিত্তি নেই।
তবে চুটকিটির মূলে রয়েছে একজন ব্যক্তি তার বিশ্বস্ত অপর একজনের একটি গোপন কথা শুনেছেন। তৎক্ষনাতই তার পেটটা ফুলতে থাকে। সে তখন কমপক্ষে একজন মানুষ খুজে বেড়াতে থাকেন। কাকেও না পেয়ে অবশেষে তারই বাড়ীর বাহির আঙ্গিনায় গরুকে পানি খাওয়ানো মাটির বড় গামলায় (কেও বলেন চাড়া কেওবা বলেন চাড়ি) কাছে গিয়ে পানি দেখে সেই পানির কাছাকাছি মুখ নিয়ে তারই ছবির কাছে ‘শোনা গোপন কথাটি’ বলতে থাকেন।
দৃশ্যটি তার প্রতিবেশি চাচার চোখে পড়ে, যার দশা উক্ত ব্যক্তিটির চল্লিশার মতই। সে দ্রুত তার কাছে গিয়ে জানতে চায়, কার সাথে সে কথা বলছে। ব্যক্তিটি বলে চাচা অমুক আমাকে তার গোপন একটা কথা বলে। শোনার পরই আমার পেটটা ফুলতে থাকে। এদিক সেদিক খোজাখুজি করে কাকেও না পেয়ে, এখানে আমার ছবিটা দেখে ‘ছবিকেই’ বললাম ৷ এই যে, পেটটার ফুলাটা কমে গেল। তা আপনি কাকেও বলেন না যেন। অমুক মানা (নিষেধ) করেছে। তখন থেকে এটা চালু।
আমার দশাটাও প্রায়ই একই রকম। শিরোনামের বিষয়টি মাথায় চেপেছে। এটা যতক্ষণ না কারও সাথে মত বিনিময় করবো ততক্ষণ অস্থিরতায় থাকতে হয়। সমস্যাটা এখানেই । শিরোনামের লেখাটা দু’ক্লাস পড়া ও গণিত শাস্ত্রের ধারাপাতের শতকিয়ার ‘এক থেকে দশ’ পর্যন্ত’ পরিমাপের জ্ঞানবুদ্ধি নিয়েতো লেখাটা দূরুহ। তাই জ্ঞানী-মহাজ্ঞানী, সাহিত্যিক- সাংবাদিক, আইনজীবি-সংস্কৃতি সেবী এবং শিক্ষা-রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত গুরুত্ববহ পদবীধারী সামরিক- বেসামরিক আমলা আমলা প্রমুখদের হৃদয়িক সহানূভূতি কামনা করেই বিজ্ঞ-জ্ঞানী পাঠকদের সামনে লেখাটা তুলে ধরছি।
উপরোক্ত লেখায় যাঁদের সহানুভূতি আশা করেছি, তাদের সদয় অবগতির জন্য বলতে হচ্ছে। আপনাদের মর্যাদা-খ্যাতি আরো সমৃদ্ধ হোক কামনা করছি। সেই সাথে অবগত করছি যে, ক’টি যৌক্তিক কারনে লিখতে বাধ্য হলাম । প্রথমত বিবেকের তাগিদ। দ্বিতীয়ত-লিখবো লিখবো করে দেড় যুগের বেশি সময় অতীত হয়ে গেছে। তৃতীয়ত-বয়স ও জটিল রোগ সংক্রান্ত কারনে শারীরিক অবস্থা বলছে-সময় ফুরিয়ে আসছে। এছাড়া প্রসঙ্গত আরেকটি কারন রয়েছে। তাতে ভাবছিলাম লিখবো লিখবো ভাবতেই কেও না কেও লিখবেন। হয়তো লিখেছেনও। যা আমার দৃষ্টিতে পরেনি। জানলে কৃতজ্ঞতা জানাতাম ও জানাবো।
তবে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যারা বিশ্বাসী, এবং সেই চেতনায় উদ্বদ্ধু হয়ে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনে সম্ভাব্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছি। আর যারা দিনে রাতে এমনকি ঘুমেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন ও লেখালেখি করেন।

তারা শিরোনাম বিষয়ে লিখেছেন কি-না বা সংখ্যালঘু শব্দটি যে, সাম্্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদ-আমলা-মুৎসদ্দি-পুঁজিবাদী শাসন-শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত, তা সহজবোধ করে লিখেছেন কি-না তা এ মূহুর্তে আমার চোখে পড়েনি। তবে সম্প্রতি ইসকনের ভূমিকায় এবং ভারতে বাংলাদেশ পতাকার অবমাননা, পোড়ানো এবং হাই কমিশনের অফিস হামলা নিয়ে মতামত সম্বলিত লেখা কম হলেও লিখেছেন। এই ক্ষনে হয়তো কেউ ভাবছেন লেখার মধ্য দিয়ে জানতে চাচ্ছি ‘সংখ্যালঘু’ কথাটি নিয়ে। সেখানে জাতীয়তাবাদ কেন। প্রশ্নটা সঠিকই।
কিন্তু আমাদের অঞ্চলের ‘চুটকিতে’ বলেছি কারনে লিখতে চাইনি। আজকের আলোচ্য বিষয়ের সংখ্যালঘু ও জাতীয়তাবাদের জনক ও তার সমর্থকরা একই বৃত্তের ও একই শ্রেনীর অর্থ্যাৎ ‘বোতলের রং বদল হলেও মদ একই’। এবার আমি শিরোনাম বিষয়ক লেখায় ।
সুধী পাঠক, ক’টা লাইন আগেই লিখেছি আমার শিরোনামের ‘সংখ্যলঘু’ ও প্রসঙ্গত আসা ‘জাতীয়তাবাদ’ এর জনক এবং সমর্থকরা একই শ্রেণী ও বৃত্তের। আমরা কম-বেশী সকলেই জানি যার অতীত নেই, তার ভবিষ্যৎ নেই । আমাদের অতীত আছে। যেহেতু অতীত বলছে ‘আমরা মানুষ’। একইভাবে আমরা ছিলাম ভারতবর্ষের বা ভারত উপমহাদেশের মানুষ। মানুষকে বলা হয় সামাজিক জীব। অর্থ্যাৎ সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করেন। তারা বাঁচার জন্য প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম করেছেন। সমাজবদ্ধভাবে জীবন যাপন করেছেন।
সংখ্যালঘু কথাটি ইতিহাস-ঐতিহ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আর এই উত্থাপিত প্রশ্নটির মধ্যেই রয়েছে আরও একটি প্রশ্ন অর্থাৎ দুটি প্রশ্ন। এক, আমরা কি মানুষ ৷ দুই, আমরা কি ভারতবর্ষের মানুষ। শেষ প্রশ্নাত্তর বলছে, আমরা যতই ধারাবাহিকতার ফলশ্রুতি হইনা কেন; আমরা ভারত উপমহাদেশের মানুষ নই । আমরা বাংলাদেশের মানুষ। তাহলে প্রথম প্রশ্নাত্তোর কী হবে? আমরা কী বলবো-আমরা মানুষ নই। তা তো বলতে পারি না । যদি নাই বলতে পারি, তবে ভারতবর্ষীয় বা ভারত উপমহাদেশীয় মানুষওতো বলতে পারি না। এক এক করে এমন অনেক প্রশ্নই সামনে চলে আসবে। আর সব প্রশ্নেরই প্রেক্ষাপট-অতীত- বর্তমান ও সমাধান বিস্তারিত ভাবে লেখা রয়েছে ভারতবর্ষের সুদীর্ঘ ইতিহাসে। যে ইতিহাস এখানে লেখা সম্ভব নয়।
তবে অতীত যেহেতু আছে। সেহেতু ‘অতীত’ উত্থাপিত প্রশ্ন দুটিসহ আরো দু’চারটি প্রশ্ন দেখা দিলে অতীত সেটুকুর উত্তর কমপক্ষে আমাদের সামনে তুলে ধরবে। অতীত বলছে, আমরা ভারতবর্ষের মানুষ এবং সমাজবদ্ধভাবে বসবাসকারী মানুষ ৷ ঘুরে ফিরে একই কথা আসছে। যা ‘বর্তমান’ মেনে নিচ্ছে না। কেনইবা মানবে ৷ মানুষ হলে ‘সমাজবদ্ধ মানুষ’ ভাগ হবে কেন। তারপর আবার ভারতবর্ষই বা ভাগ হলো কেন?
সাথে একটু বাড়িয়ে বললো, ভারতবর্ষ থাকতেই অভিভক্ত বাংলাকে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ (পূর্ব বাংলা ও বর্তমান বাংলাদেশ) হিসেবে ভাগ করতে পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে পূর্ববঙ্গকে সব ক্ষেত্রে সর্বদিক থেকে পিছিয়ে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ উন্নত আর পূর্ববঙ্গ অনুন্নত। বর্তমান এসব মানুষকে ভাগ করেছে। ভাগ করেছে ভারত উপমহাদেশ (ভারতবর্ষকে)। ‘বর্তমান’ আরো বলছে ‘অতীত’ যেদিন বর্তমান ছিল ঘটনাবলী তখনকার। তাই অতীতের কাছে জানতে হবে এবং অতীতকেই বলতে হবে। কারা বা কে কেন ও কীভাবে ভাগ করেছে মানুষ, ভাগ করেছে ভারতবর্ষ ও পার্থক্য করেছে দুই বাংলার মধ্যে। এও জানা যাবে ‘সুবিধাভোগী’ কারা। এবার দেখা যাক অতীত কি সমাধান দেয়।
‘অতীত’ নিজেও একসময় ‘বর্তমান’ ছিল তা, সরাসরি স্বীকার না করে কৌশলের আশ্রয় নেয়। যেন, ধরি মাছ না ছুই পানি’। উপরোক্ত আলোচনা সমূহ ও তার প্রেক্ষাপটেইতো প্রশ্নাবলির উদ্ভব। বর্তমানও একসময় ‘অতীত’ হওয়ার পর ‘ভবিষ্যত’ যখন বর্তমান হবে এমন প্রশ্নই তারো সামনে আসবে। সে কারনে আগেভাগেই ভারতবর্ষের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে সমগ্র জাতির সামনে তুলে ধরতে হবে নানাভাবে। হ্যাঁ, অতীতের এই বক্তব্যই যথাযথ। তারপরেও উত্থাপিত সমাধানতো যত সংক্ষেপে হোক অতীতকেই তা প্রশ্নের বলতে হবে। অতীত বলছে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ‘ভারতবর্ষ’ দখলের আগে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়নি।
ভারতবর্ষকে চিরস্থায়ী দখলভোগ করতে হলে ভারতবর্ষের মানুষের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করতে হবে-এটাই সম্রাজ্যবাদের বিশ্লেষণ। সেই কারণে পূর্ব পরিকল্পনা মতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা সৃষ্টি করে। রাজনৈতিক ভাষায় এই দাঙ্গাকে বলা হয় সাম্প্রদায়িকতা। আর এই সাম্প্রদায়িকতারই সৃষ্টি ‘সংখ্যালঘু’। যে ধর্মের মানুষ যে অঞ্চলে বা যে দেশে “কম’। সেই ‘কম’ অর্থই সংখ্যালঘু। আর যারা বেশি তারা সংখ্যাগুরু। ইতিহাস-ঐতিহ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করা সংখ্যালঘু যে সাম্রাজ্যবাদ ও তাঁর দালাল শোষক-শাসকদের সৃষ্টি তা নিয়ে গণচীনের চেয়ারম্যান ‘মাওসেতুঙ’ বলেছেন, সাম্রাজ্যবাদ যা করে, তা কবর রচনার জন্যই করে। যেমন, ভিন্ন কোন দেশের নয়, ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসেই স্বাক্ষ্য দেয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ শুধু নয়, বিশ্ব পরিস্থিতিও বলছে, সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য বিস্তার ও তার শাসন-শোষণ বজায় রাখতেই এক ধর্মের মানুষ দিয়েই আরেক ধর্মের মানুষ হত্যা ও নির্যাতন করে। উগ্র-জাতীয়তাবাদ ও বর্ণবাদের ক্ষেত্রেও একই ভূমিকা। আলোচ্য বিষয়ের সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি বিশ্বকে দান করেছে। এখানেই শেষ নয়। এটা মাথায় রেখেই দু’বঙ্গের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করেছে।
অপরদিকে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ উপমহাদেশের আসামে সৃষ্টি করে জাতীয়তাবাদ। অহমিকাভাষার আসামীদের দিয়ে আসাম থেকে ‘বাঙ্গালী খেদাও’ নামে সাইনবোর্ড তুলে বাংলা ভাষাভাষি মানুষের সাথে দাঙ্গা সৃষ্টি করে ও লাইন প্রথা চালু করে। এটাকে রাজনৈতিক ভাষায় বলা হয় উগ্রজাতীয়তাবাদ। এশিয়া-আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানির নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলন সংগ্রামের ফলে- অবশেষে ব্যর্থ হয়। মুৎসদ্ধি পুঁজিবাদী বুর্জোয়াদের হৃদয়ে লালিত হতে থাকে জাতীয়তাবাদ নামের সাম্রাজ্যবাদি ‘মন্ত্র’।
এদিকে ইতিহাস স্বাক্ষ্য দিচ্ছে-ষোড়শ শতকে ইউরোপের বুর্জোয়া শ্রেণী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে সামান্তবাদ উচ্ছেদ করে দেশে দেশে বুর্জোয়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করছিল। একইসাথে সাম্রাজ্যবাদি যুগের ইতিহাস বলে এক জাতি কর্তৃক আরেক জাতিকে দখল করা নির্যাতন-দমন-নিপীড়ন চালানোর ইতিহাস । অর্থাৎ এক জাতির বুর্জোয়া শ্রেণী অন্য জাতির সকল মানুষকে শোষন করা বুঝায়। উগ্র-জাতীয়তাবাদী জোয়ারে বয়ে যাওয়াকালে মুক্তিযুদ্ধ হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অথচ সভ্যতার ইতিহাস হলো শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। অর্থাৎ এক শ্রেণীর বিরুদ্ধে আরেক শ্রেণীর সংগ্রাম । প্রাক সামাজ্যবাদী যুগে বুর্জোয়া শ্রেণীর শ্রমশোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ৷

লেখার এ পর্যায়ে আমরা কি পেলাম। তার সারসংক্ষেপ করা বাঞ্চনীয় আমরা উপরোক্ত আলোচনার সারসংক্ষেপকেই সহজ সরলভাবে বলতে পারি যে, একই বৃন্তে দুটি ফুলের মতো পেলাম, এক ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা। আরেকটি উগ্র-জাতীয়তাবাদ। ভারত উপমহাদেশে কি দেখছি। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ঘরে বসে অর্থাৎ সীমানা নির্ধারন করে পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান (ভারত ও পাকিস্তান) নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। ঠিক দুই অবিভক্ত বাংলাকে দু’ভাগ করার মতোই ভাগ। তবে উন্নয়ন-অনুন্নয়ন বিবেচনায় নয়। মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসীদের নেতৃত্বে অর্থাৎ শাসন-শোষনের ক্ষমতা দিয়ে আমাদের পূর্ব বাংলাকে (পূর্ব পাকিস্তানকে) হাজার মাইলের ব্যবধানে। (মাঝে ভারত) পশ্চিম পাকিস্তান মিলে পাকিস্তান করেছে। পূর্ব বাংলার এক সংখ্যাগরিষ্ট অংশের মানুষের ভাষা বাংলা ও পাকিস্তানের ভাষা উর্দু। উগ্রজাতীয়তাবাদের রোপিত বীজে একটু পানি সেচ দিয়ে গেল ৷ যার ফলশ্রুতি আজকের বাংলাদেশ। আমাদের দেশসহ বিশ্বের কোন কোন দেশে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, কোন দেশে উগ্রজাতীয়বাদী আন্দোলন-সংগ্রাম ও কোথাও সশস্ত্র যুদ্ধ। মূলত সাম্প্রদায়িকতা ভিত্তিক মৌলবাদী জঙ্গীদের সন্ত্রাসী হামলতো চলছেই ৷ আর মৌলবাদ সকল ধর্মেই বিদ্যমান।
সুধী পাঠকদের সাথে শেষ কথা বলে ইতি টানবো আজকের এই লেখার। আমাদের জাতীয় ইতিহাস গৌরবের অহংকারের। এই লেখার প্রাসঙ্গিক কারন হলো একটি জাতি হয় এক ভাষা-সংস্কৃতি, ভূখন্ড একই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবন ব্যবস্থার জন্য। হাজার বছরের আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে সহস্রাধিক বছরে আন্দোল-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতির জন্ম। সেই বাঙালির বাংলাদেশে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দ কেন ব্যবহার হবে। অন্য ভাষাভাষি মানুষের জাতিসত্তার প্রতি আমাদের সম্মান আছে ও থাকবে স্বীকৃতি। কিন্তু একই ভাষার, একই সংস্ক”তির, একই ভূ খন্ডের এবং একই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জীবন যাপনকারীরা কেন ‘সংখ্যালঘু’ বলে আবার কতকাল সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদের আধিপত্ত বিস্তারের মদদ যোগাবো আমরা।
উগ্র জাতীয়তাবাদ নামের সাম্রাজ্যবাদী মন্ত্রে উজ্জীবিত রাখার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত লক্ষ্যে শোষণ মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা পরিপন্থি বলে আমরা মনে করি । স্বাধীনতার তেপ্পান্ন বছরেও সে কারনে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। এমনকি লক্ষ্য অর্জনের ভূমিকা পালনকারি গণতান্ত্রিক সরকার ও গণতন্ত্রই প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সে কারনে আজকে যেমন ‘সংখ্যালঘু ‘র প্রশ্নতুলে বাংলাদেশকেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে একটি গোষ্টি ও প্রতিবেশ বন্ধু দাবিদার প্রতিবেশী ভারত। কারণ হিসেবে উল্লেখ্য, ভারতে মৌলবাদী-হিন্দুত্ববাদী মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপি এই অপতৎপরতা চালাচ্ছে।
অসাম্প্রদায়িকতার সাইনবোর্ডধারী সম্প্রসারণবাদী ভারতের জন্য এহেন অপতৎপরতা ভারতের জন্যই ক্ষতি বয়ে আনবে। ভারতের অসাম্প্রদায়িকতার বিশ্বাসী বীরজনগণের সাথে যেহেতু বাংলাদেশের জনগণের বিরোধ নেই সেহেতু ভারতীয় শাসক শ্রেণীকে মোকাবিলা করতে হবে-‘সংখ্যালঘু’ কথাটি জাতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে-এমন যৌক্তিক জনমতকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে। এবং সকল ধর্ম-বর্ণ-জাতি-উপজাতি সকল মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সকল প্রকার ষড়যন্ত্র অপৎপরতা মোকাবিলা করেই বিশ্বকে আবারো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে হবে- এদেশে সংখ্যালঘু-উপজাতি, বর্ণ বৈষম্য নেই, সবাই বাংলাদেশী।

প্রধান সম্পাদক, গণপ্রহরী