গণপ্রহরী রিপোর্ট : সড়ক-মহাসড়ক নাকি এগুলো মৃত্যুকূপ! সড়ক। মানুষের জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে সড়ক। কেননা, মানুষের জীবনে সড়ক দিয়েই এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাতায়াত করতে হয়। সড়কের অবস্থান ও পরিধিভেদে সড়ক কোথাও মহাসড়ক আবার কোথাও পথ বা রাস্তা। এর সবগুলোরই ব্যবহার মানুষের প্রয়োজনে। এটা আমরা জীবন দিয়েই উপলব্ধি করছি, সড়ক যেমন যোগাযোগের মাধ্যম। তেমনি উন্নয়নের ক্ষেত্রে অপরিহার্য শর্ত। কিন্তু সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় নৈরাজ্যের কারণে দেশব্যাপী ক্রমবর্ধমান হারে নিত্যদিনই ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। সেসব দুর্ঘটনার সংখ্যা এবং দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা সাধারণ জ্ঞানে বিবেচনা করলেই সহজেই বা নির্দ্বিধায় বলা যায়- সড়ক-মহাসড়কগুলো মৃত্যুকূপে রূপান্তরিত হয়েছে। কেও আবার প্রশ্নাকারে শিরোনামের কথাই ব্যক্ত করেন, ‘সড়ক-মহাসড়ক নাকি মৃত্যুকূপ?’
যে সড়ক-মহাসড়ক মানুষের জীবনের সাথে জড়িয়ে এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে যোগযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। সেই সড়ক নিয়ে বা সড়ককে কেন মৃত্যুকূপ বলা হচ্ছে। মূলত: দেশব্যাপী প্রতিদিনের দুর্ঘটনা ও সেসব দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যাই তা বলছে। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিবেশিত সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত খবরা-খবর ভিত্তিতে জনমতে যা জানা যায়। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানিসহ সাবির্ক ক্ষয়ক্ষতিকে গণমাধ্যমকর্মীরা ও যাত্রী কল্যাণ সমিতি জনগণের সামনে তুলে ধরছেন। এবং যাত্রী কল্যান সমিতি প্রাপ্ত তথ্য প্রকাশসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন নিবেদন করে চলছেন।
কিন্তু যাঁরা পরিবহন ব্যবস্থার নৈরাজ্য বন্ধ করতে পারেন, যাঁরা নতুন আইন প্রণয়ন করতে পারেন ও বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে পারেন এবং যাঁরা মানুষের জানমালের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে শ্রম আইন ভিত্তিতে যথাযথ বেতন-ভাতায় দক্ষ ও অভিজ্ঞ চালক নিয়োগদানসহ ভাল মানের যানবাহন সড়কে চালাতে পারেন এবং জানমালের নিরাপত্তা বিধানে যান চলাচলে প্রতিযোগীতা নয়, নিরাপদ যাতায়াত ও পরিবহন নিশ্চিত করতে পারেন; তাঁরা তা করছেন না বলেই ‘পরিবহন ব্যবস্থায় নৈরাজ্য চলছে তো চলছেই। জানমালের ক্ষয়ক্ষতিও হয়েই চলছে’। এসবের জন্য জাতীয় ও নাগরিক জীবনে যেমনি দু:সহ যন্ত্রণা পোহাতে হচ্ছে, তেমনি ক্ষয়ক্ষতিরও কারণ হচ্ছে। তা নিয়ে নীতি-নির্ধারক ও যানবাহন মালিক পক্ষের কোনো উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আছে বলে মনে হয় না। অথচ নিত্যদিনই ঘন্টা-মিনিট বিরতিতে তথা অহরহ সড়ক-মহাসড়কে ঝড়ছে তাজা প্রাণ, দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচেছ মৃত্যুর মিছিল।
পক্ষান্তরে, দুর্ঘটনা ঘটলেই ‘দুর্ঘটনায় কারো হাত নেই, ইচ্ছা করে কাওকে মারা হয় না, দুর্ঘটনা দুুর্ঘটনাই ইত্যাদি পুরোনো কাসুন্দি ঘাটা শুরু হয়ে যায়। তবে হ্যাঁ, ক্ষেত্র বিশেষে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়, তদন্তও চলছেতো চলছেই। এসব যেন সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে নিয়মিত সংষ্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। একইভাবে এহেন সংষ্কৃতির ডামাডোল এক সময় থেমে যায়। ফলে জবাব দিহিতার বিষয়টিও আড়ালে চাপা পড়ে যায়। এভাবেই সড়ক মহাসড়কে দুর্ঘটনা শুধু স্বাভাবিক ঘটনায় পর্যবসিত হয়নি, দুর্ঘটনা পর্যবসিত হয়েছে নিয়মিত ঘটনায়। যেন সড়ক-মহসড়কে মানুষের জীবনের মূল্য হচ্ছে ‘ভীষণ, ভীষণ সস্তা’। এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে সচেতন জনগণ যদি মানবাধিকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে মৃত্যুর মিছিল সৃষ্টিকারী এহেন বেপরোয়া দুর্ঘটনাকে পদ্ধতিগত সহিংসতা হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে; নৈরাজ্যমুক্ত পরিবহন ব্যবস্থা ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে সোচ্চার না হন, তাহলে প্রকারন্তরে দায় ঘাড়ে চাপবে। নীতি-নির্ধারক ও মালিক কর্তপক্ষ কেউই দায় এড়াতে পারে না ও যথাযথ পদক্ষেপ নিলে পারবেও না।
আরও পড়ুন- প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ নিয়ে আমাদের কথা
সড়ক-মহাসড়ক না-কি এগুলো মৃত্যুকূপ শীর্ষক আজকে প্রতিবেদনের এ পর্যায়ে-সামনে থাকা সম্প্রতি যাত্রী কল্যাণ সমিতির আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পরিবেশিত ‘তথ্যই’ বলে দিবে সড়কে চলাচলকারী পরিবহন ব্যবস্থায় নৈরাজ্যের জন্য প্রতিদিন ২২ জন মানুষ প্রাণ হরাচ্ছেন। গত ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ শনিবারের সংবাদ সম্মেলনে যাত্রী কল্যাণ সমিতি পরিবেশিত তথ্য মতে, বিগত ১১ বছরে ৬২ হাজার ৬১৯টি সড়ক-মহাসড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ৮৬ (ছিয়াশি) হাজার ৬৯০ জন এবং আহত হয়েছেন ১ লাখ ৫৩ হাজার ২৫৭ জন। রাজধানী ও অন্যান্য মহনগরসহ জেলা শহর, জনব্যস্ত বন্দর সমূহ ও অনেক উপজেলা পর্যায়ে নাগরিকদের সীমাহীন ভোগান্তির ‘যানজট সমস্যা’। শুধুমাত্র রাজধানীতেই যানজটে প্রতিদিন কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে ৩২ লাখ। এতে করে বছরে জ¦ালানি অপচয় হচ্ছে ১১ হাজার কোটি টাকার এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি ৯৮ হাজার কোটি টাকা।
দেশের মানুষ আশা করেছিলেন-গণঅভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের সময়কালে চলমান সংষ্কার প্রক্রিয়ার আওতায় পরিবহন ব্যবস্থার নৈরাজ্য থেকে বহুলাংশে রেহাই পাবেন। এবং বিদ্যমান পুরোনো ব্যবস্থারও অবসান হবে। যদিও অনস্বীকার্য যে, দুর্ঘটনা স্থায়ীভাবে বন্ধ করা যাবে না। বিশ্বব্যাপী দুর্ঘটনা ‘দৈবচয়ন’ হিসেবে আখ্যায়িত। এবং স্বীকৃত যে, দুর্ঘটনা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। কিন্তু বাংলাদেশের দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হিসেবেও দৈবচয়ন শব্দটি কি যথার্থ? নিশ্চয়ই নয়।
কারণ, বিশ্ব যখন সড়কের শৃঙ্খলা স্থায়িত্ব করতে সচেষ্ট। তখন বাংলাদেশে সড়কের অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্যের জন্য জনগণকে (নাগরিদেরকে) জীবন দিয়ে আহত হয়ে ও সময় অপচয় করার মধ্য দিয়েই সড়ক -মহাসড়কে চলার খেসারত দিতে হচ্ছে। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সবচেয়ে অগ্রসর হচ্ছে রাজনৈতিক দল। প্রতিবেদনে আগেই বলা হয়েছে ‘কেউই দায় এড়াতে পারবেনা’ অথচ রাজনৈতিক দলগুলো নীরব ভূমিকা পালনে স্বচ্ছন্দ বোধ করে চলছেন। যেন সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বা মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হওয়া অব্যাহত থাকলেও তাদের কোন দায়-দায়িত্ব বা করণীয় নেই। এ বিষয় জনগণের ভাবনা কি। সাদামাঠা চোখে তাঁরা আপাগোড়াই দেখে আসছেন-ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল, পরিবহন মালিক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও এক শ্রেনীর শ্রমিক নেতৃবৃন্দ (সাধারন শ্রমিকদের কল্যানের নামে) যোগসাজসে যাত্রীদেরকে জিন্মি করে চাঁদাবাজিসহ অবৈধ আয়ের মুখ্যম মাধ্যম করে নিয়েছেন পরিবহন খাত।
গণপ্রহরী মনে করে সচেতন সকলেই স্বীকার করবেন যে, রাজনীতিতে ২০১৮ সালে দুই বাসের পাল্লাপাল্লিতে দুই শিক্ষাথীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে নিরাপদ সড়কের আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। যে আন্দোলন গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নাগরিক সমাজ নির্বাচনী ইশতেহারে আশা করে, সড়ক-মহাসড়কগুলো অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্যমুক্ত করে নিরাপদ সড়কের উদ্যোগ নিবেন এবং উন্নত গণপরিবহন অন্তর্ভুক্ত করবেন। সেইসাথে সভাসমাবেশে জনগণকে আশ্বস্থ করতে জানান দিবেন- পরিবহন খাতের নৈরাজ্য ও অরাজকতার জন্য ভূলনীতি ও দুর্নীতি দায়ী। আসন্ন নির্বাচনে গঠিত সরকার সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যানজট ও দুঘটনারোধে বিজ্ঞানসন্মত যৌক্তিকসংস্কার প্রক্রিয়ায় কার্যকর পদক্ষেপ নিবেন। এ পথ প্রশস্থ করতে অন্তর্বতী সরকার জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজের অগ্রগতি সাধন করবেন বলে আশাবাদ থাকছে।
পরিশেষে দৃষ্টি আকর্ষন করা যাচ্ছে যে, মটরসাইকেল ও অটোরিক্সার জন্য সড়কে পৃথক লাইন থাকা দরকার। এজন্য অত্যাবশ্যকীয় করনীয় উদ্যোগ গ্রহন করা যেমনি প্রয়োজন তেমনি গণপরিবহন চালক কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করার পাশাপাশি নির্দিষ্টহারে বেতন-ভাতা প্রদানের বাধ্যবাধকতা প্রয়োজন। একইভাবে সড়কের শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা ও বাধাহীনভাবে ট্রাফিক আইন প্রয়োগকে গুরুত্ব দিতে হবে। যাতে মানুষ দৃঢ়তার সাথে বলতে পারেন- ‘আমাদের দেশের সড়ক- মহাসড়ক মৃত্যুকূপ নয় জাতীয় উন্নয়নে ও মানুষের নিরাপদ যাতায়াতের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম’।
আরও পড়ুন- গোপন নথি নয়, নাগরিকের শক্তি
