নিজস্ব প্রতিবেদক : ‘কোন ত্যাগই বৃথা যায় না’। দেশ, জাতি ও জনগণের জন্য ত্যাগ স্বীকার করলে অথবা ত্যাগ স্বার্থক হলেই মানুষ, সেই ত্যাগকে সম্মানের সাথে মেনে নেন। তাইতো ইতিহাসের শিক্ষাও -‘কোন ত্যাগই বৃথা যায় না’। তেমনটাই সমন্বয়ক কমিটি বিলুপ্ত খবরের ‘সমন্বয়ক শব্দটিও।
জনগণ যেন বুঝেই নিয়েছেন- এই ‘সমন্বয়ক’ কোন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ‘সমন্বয়ক’ শব্দ নয়। এটা তাদের দীর্ঘকালের আকাঙ্খা পূরণের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিয়ে ব্যবহৃত ‘সমন্বয়ক’।
জনগণের ভাষায়, তারা সমন্বয়কদের কথা শুনে উজ্জীবিত হয়েছেন এবং আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রের কর্মজীবি-শ্রমজীবি মানুষের যাঁর সাথে বা যাদের সাথে এ নিয়ে কথা হয়েছে। তারা সবাই প্রায় একইভাবে একই কথা বলেছেনÑ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘সমন্বয়ক কমিটি বিলুপ্ত’। এ খবরও তারা জানেন ও জেনেছেন। তাঁদের মতে স্বৈরাচার হাসিনা সরকার ও তার দোসর এবং সমর্থকরা ক্ষমতা ছেড়ে পালাবে, এমনটা ভাবতে পারেননি। তবে তাঁদের মনে প্রাণে চাওয়া ছিল স্বৈরাচারের পতন। সেজন্য আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিতেও প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু সামনে থেকে সেভাবে কেও বা কোন দলই ডাক দিতে পারেনি।
অথচ আমাদের বাপ-দাদারাও অনেক মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তাঁদের বিশ্বাস ছিল- ‘লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধা-জনতার রক্তের’ দাম হিসেবে ‘শোষণমুক্ত সমাজের’ দেশ হবে। মুসলমান, হিন্দ,ু বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান এমন জাতি-ধর্ম-বর্ণের মধ্যে কোন ভেদাভেদ থাকবে না। সবাই মিলেই যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন। তাঁদের অনেকেই মারা গেছেন। কিন্তু যেমন দেশ করার জন্য যুদ্ধ করেছেন, তেমন দেশ হয়নি।
তাইতো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কথা শুনেই ভেবেছি মুক্তিযোদ্ধা বাপ-দাদাদেরসহ এবং তাদের সমবয়সীদের পরস্পর পরস্পর আলাপচারিতায় যা শুনেছি ‘সেই দেশ’ হবে। মানুষে মানুষে বৈষম্য থাকবে না, ভেদাভেদ থাকবে না। সবাই এক সাথে দেশের জন্য কাজ করবো। এমন বিশ^াস থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা কখন কি বলেন, তা জানার চেষ্টা করেন। সেই কারণেই তারা জেনেছেন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আহ্বায়ক কমিটি’ গঠন করা হয়েছে।
হ্যাঁ, শ্রমজীবি-কর্মজীবি মানুষ যেন অল্প দিনেই রাজনীতির বিশ্লেষকদের মতোই চিন্তা-ভাবনা লালন করতে শিখেছেন। এবং দেশ নিয়ে যেমন ভাবছেন। তেমনি সরকার কি করছেন এবং স্বৈরাচার পক্ষ বাদ দিয়ে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো কি করছেন, বলছেন, তাঁরা মনোযোগ দিয়ে তো দেখছেন ও শুনছেন। তাদের আরেকটি কথায়ও বোঝা যাবে, তারা কতটা সচেতন। কেননা, তারা কষ্টের কথা বললেও, জিনিসপত্রের দাম নিয়ে বলছেন, আগে যারা দাম বাড়িয়েছে এখনও তারাই বাড়াচ্ছে। স্বৈরাচার পক্ষ ভারতের সাহায্যে ষড়যন্ত্রও করছে। এতটা সচেতন কেনইবা হবেনা; কেনইবা বিশ্লেষকের মত কথাবার্তা বলবেন না। ইতিহাসতো বলে- এটাই স্বাভাবিক। কেননা, আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেমন নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। তেমনি আন্দোলনে অংশগ্রহনকারীদের চেতনারও বিকাশ ঘটে।
সেই বিকশিত চেতনায় জনগণ প্রয়োজনে, আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী সমন্বয়কদের নিয়ে গঠিত কমিটি জনগণের আকাঙ্খা পূরনে আবারো আন্দোলনে ডাক দিলে তাতে যোগ দেওয়ার প্রস্তুত রয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। তারা জানেন কেন্দ্রিয় সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহকে আহ্বায়ক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আব্দুল হান্নান মাসউদকে মুখ্য সংগঠক ও উমামা ফাতেমাকে মুখপাত্র করে চার সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে।
গত ২২ অক্টোবর রাজধানীর কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারের এক সংবাদ সম্মেলনে সমন্বয়ক সারজিস আলম এই আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন। দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার আন্দোলন-অভ্যূত্থানে সাহসী ভূমিকা পালনকারী শিক্ষার্থীদের সুসংহত করতে, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত সামনে রেখেই ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলন আহ্বায়ক কমিটি’ গঠিত হয়েছে। আহ্বায়ক কমিটি ইতিমধ্যে পাচ দফা দাবি আদায়ের কর্মসূচী নিয়ে তৎপর রয়েছেন। কর্মসূচীতে পেশকৃত দাবিগুলো সফলতার দিকে এগিয়ে চলছে। সফলতার দিকে এক ধাপ আগানোর মধ্যে রেখেছে ছাত্রলীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে সরকার পক্ষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন জারি। প্রজ্ঞাপন মতে, ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ এর ক্ষমতাবলে। একই আইনের -২-এ তফসিল মতে, ছাত্র সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ সত্তা তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
১৯৪৮ সালে ৪ জানুয়ারী প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগ সরকার বিরোধী ভূমিকা পালনের স্বাক্ষ্য রেখেছে। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ছাত্র সংগঠনটির উদ্দেশ্য আদর্শ পাশ কাটিয়ে, ছাত্রজনতাকে প্রাধান্য না দিয়ে, দলীয় ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশেষত বিগত ১৫ বছরে হত্যাসহ জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী নানা কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল ছাত্রলীগ। গত জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকলে শত শত শিক্ষার্থী ও ব্যক্তি ছাত্রলীগের সশস্ত্র আক্রমনে নিহত হয়েছেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
পাঁচ দফা দাবি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তাদের ঘোষিত পাঁচ দফা দাবি আদায়ে পর্যায়ক্রমে ঘোষিত কর্মসূচী বাস্তবায়নে তৎপর রয়েছে। দাবিসমূহের মধ্য ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের দাবি আদায় হলেও রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনকে পদত্যাগের দাবি বাস্তবায়ন বিষয়ে গণতন্ত্রকামী ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলের সাথে সরকারের মত বিনিময় চলছে। পাঁচ দফা দাবির অন্যান্য তিন দফার মধ্যে রয়েছে অনতিবিলম্বে বিদ্যমান সংবিধান বাতিল সাপেক্ষে রক্তার্জিত সফল গণঅভ্যূত্থান প্রেক্ষাপটে নতুন সংবিধান রচনা করা। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন, ২০১৮ সালের একাদশ ও ২০২৪ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা করা। জুলাই আগস্ট আন্দোলনে ভূমিকা পালনকারী গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক দলের মতামত ভিত্তিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা। পাঁচ দফার আরেকটি দাবি মতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে জুলাই বিপ্লবের আলোকে ‘প্রোকলেমেশন অব রিপাবলিক’ ঘোষণা করা।
