গণপ্রহরী রিপোর্ট : সাম্যবাদী কবি নজরুলকে ভুলবার নয়। কারণ সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার বিপরীত শব্দই হচ্ছে সাম্যবাদ। আর সেই সাম্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী কবি-জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকীতে কবির আত্মার প্রতি গণপ্রহরী পরিবার পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদনেই আজকের এই ছোট্ট প্রতিবেদন।
প্রতিবেদনের শুরুতেই গণপ্রহরী দৃঢ়তার সাথে সাম্যবাদী কবি নজরুল ইসলাম স্বশরীরে আমাদের মাঝে নেই বটে। কিন্তু তাঁর লেখা কালজয়ী কবিতা ও গান থাইপাহাড় ও হিমালয় পর্বতমালাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উঁচু পাহাড়-পর্বতের চুড়ায় কবির অশরীরি আত্মার কণ্ঠে যেন উচ্চারিত হচ্ছে। কবির আবৃত্তি করা কবিতা ও পরিবেশিত গানের ফাঁকে যেন কবির কণ্ঠে ঘোষণা হচ্ছে- সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই-সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে দেশী-বিদেশী শোষকদের প্রতিনিধিত্বকারী দালাল সেবাদাস শাসকদের কালাকানুনের শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে ঐক্য গড়ে তোলার বিকল্প নেই। আবার এ তাগিদও আসছে- ‘ঐক্যবদ্ধভাবে সাম্যের সমাজ গড়তে এগিয়ে চলো। ঘোষণা ও তাগিদ উভয়ই পাহাড়ের চূড়া থেকে বাতাসে ভেসে আসছে। আর তা আসবেই না-বা কেন? তাঁর লেখাইতো মুক্তির পথ দেখাচ্ছে, দেখাচ্ছে স্বাধীনতা অর্জনের পথ। শিক্ষা দিচ্ছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত।
সাম্যবাদী কবি নজরুলকে ভুলবার নয়। ভুলবেনইবা কিভাবে। মানুষের জীবনপথের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ছিল তাঁর উপস্থিতি। কবি ছিলেন রণক্ষেত্রে। আবার তিনি ছিলেন কলমযোদ্ধা হিসেবে কলম হাতে সাংবাদিকতায়। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বিদ্রোহের অগ্নিশিখা, ন্যায় ও সত্যের পথে সংগ্রামের চিরন্তন অনুপ্রেরণা। তিনি যুব সমাজকে শৃঙ্খল ভাঙতে শিখিয়েছেন। অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে অদম্য সাহস জুগিয়েছেন। তাইতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান ঢাবি প্রাঙ্গনে কবির মাজারের পাশে খোলা মঞ্চে আয়োজিত আলোচনা সভায় বলেছেন, চব্বিশের গণঅভ্যূত্থানের মূলে ছিল কবির অসাম্য ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার শিক্ষা। উপাচার্য আরও বলেছেন, ‘কবি নজরুল বৈষম্যের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন; তাঁর চেতনা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছেন, গানের ক্ষেত্রে কবি নজরুল ছিলেন পরিপূর্ণ একজন মিউজিশিয়ান’।
গত ২৭ আগস্ট বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শায়িত কবি কাজী নজরুল ইসলামের মাজারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে ফাতেহা পাঠ করার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আয়োজিত মাজার সংলগ্ন খোলা মঞ্চে কবির স্মরণে গৃহিত কর্মসূচিতে উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় উপাচার্য তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম অসাধারণ বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী ছিলেন। তিনি রণাঙ্গনের যোদ্ধা ছিলেন। আবার কলম হাতেও যুদ্ধ করেছেন। তিনি কখনও ভুল করলে তা শুধরে নিয়েছেন। কবির কাছ থেকে প্রতিদিন শেখার রয়েছে। আলোচনা সভার আগে উপাচার্যের নেতৃত্বে অন্যান্য শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ অপরাজেয় বাংলা থেকে শোভাযাত্রা নিয়ে কবির মাজারে উপস্থিতি হয়ে কবির মাজারে পুষ্পার্ঘ্য অপর্ণ ও ফাতেহা পাঠ করেন।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রাজনীতিক অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভীর নেতৃত্বে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যু দিবস উপলক্ষে কর্মসূচি পালিত হয়। রিজভী তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, কবি নজরুলের চেতনাকে ধারণা করেই বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেছেন, জুলাই-গণঅভ্যূত্থানসহ জাতীয় আন্দোলন সংগ্রামের অনুপ্রেরণাও ছিলেন কবি নজরুল।
এছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করে। কবির মাজারে শ্রদ্ধা জানায় সংষ্কৃতি মন্ত্রণালয়, নজরুল ইন্সস্টিটিউট ও জাতীয় যাদুঘর।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৯ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে পরিবেশিত ‘সাম্যবাদী কবি নজরুলকে ভুলবার নয়’ শীর্ষক প্রতিবেদনের এপর্যায়ে উল্লেখ্য, কবির নাতনি খিল খিল কাজী সকালে তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কবির মাজারে পুষ্পর্ঘ্য অর্পণ করে তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত করেন। অত:পর খিলখিল কাজী সাংবাদিকদের মাধ্যমে কবিকে নতুন প্রজন্মের মাঝে তুলে ধরতে শুধু দিবসকেন্দ্রিক স্মরণ করার মধ্যে সীমিত থাকা নয়, দেশের সকল পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যাতে কবির কবিতা ও গান গাইতে পারে এবং তাঁর সম্পর্কে জানতে পারে, সে বিষয়ে দায়িত্বশীল কর্তপক্ষের উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। কবি পরিবারে পক্ষে আহ্বানের সাথে গণপ্রহরী পরিবার একাত্মতা প্রকাশ করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহনে সরকার ও সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।
জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জৈষ্ঠ্য বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাক নাম ছিল দুখু মিয়া। মাত্র ২৩ বছর সৃষ্টিশীল জীবনের অধিকারী কবি কাজী নজরুলের যেন ধুমকেতুর মতোই বাংলা সাহিত্য জীবনে বা বাংলা সাহিত্যে আবির্ভাব ঘটেছিল। পরাধীন ভারতবাসীকে যেমনি দ্রোহের তেমনি মানবতার প্রেম ও সাম্যের চেতনায় জাগিয়ে তুলেছিলেন। এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
উপসংহারে পৌঁছার আগ মুহুর্তে আবারো উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, ‘সাম্যবাদী কবি নজরুলকে ভুলবার নয়’। কেননা, কবি নজরুলের বিদ্রোহী কবিতাই শুধু বাংলা কাব্যে ঝড় তোলেনি, ভারতবাসীকে শাণিত পংতিমালায় শুধু জাগিয়ে তোলেনি, তাঁর কবিতা ও গান শ্রমজীবি মানুষের শক্তি জুগিয়েছে ও সাহসী করে তুলেছে, সর্বোপরি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে উজ্জীবিত করেছেন সংগ্রামী ভারতবাসীকে। তিনি তা পেরেছিলেন দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়ায় কৈশোরেই জীবনের দু:খ-দর্দশাকে আপন করে নিতে পেরছিলেন বলেই। তাইতো তিনি লেটো দলে গান করেছেন, কখনও সেনাবাহিনীর সৈনিক হয়েছেন, কখনও আবার সাংবাদিক হয়ে শোষিত মানুষের কথাই লিখেছেন। কবি নজরুলের এসব অভিজ্ঞতাই তাঁর সাহিত্য বলুন বা তাঁর লেখালেখি বলুন সবকিছুতেই গভীর দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাস্তবভিত্তিক করেছেন।
কবি নজরুলের বিচরণের আরও একটি ক্ষেত্রে ছিল, যা অনেকে ভুলে গেছেন কিংবা কেও হয়তো জানেনই না। যেমন ১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারি কলকাতার ক্রাউন থিয়েটারে মুক্তি পাওয়া ‘ধ্রুব’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছিলেন কবি নজরুল। এবং তা যুগ্মভাবে পরিচালনার পাশাপাশি চলচ্চিত্রটিতে অভিনয়ও করেছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। চলচ্চিত্রের পোশাক পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে পরনে ছিল সিল্কের লম্বা কোর্তা, মাথায় ঝঁকড়া চুল ও গলায় মালা পরিহিতÑনারদ চরিত্রে চমকে দিয়েছিলেন দর্শকদের। চলচ্চিত্র গবেষকদের মতে কাজী নজরুল ইসলামই প্রথম মুসলমান চিত্রপরিচালক, যার নির্মিত একমাত্র চলচ্চিত্র ‘ধ্রুব’। সবাক যুগের প্রথম দিকের চলচ্চিত্র হিসেবে ‘ধ্রুব’ সিনেমাটি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। এরও দুই দশক পর তথা ১৯৫৬ সালে ঢাকায় মুক্তি পায় ‘মুখ ও মুখোশ’ নামে এই অঞ্চলের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক সিনেমা। সূত্রমতে ১৯৩১ সালে ভারত উপমহাদেশে হিন্দি চলচ্চিত্র ‘আলম আরা’ প্রথম সবাক চলচ্চিত্র।
উপসংহারে বার বারই উল্লেখ্য যে, দ্রোহের কবি মানবতার প্রেমের কবি সাম্যবাদী কবি নজরুলকে ভুলবার নয়। আমরা ভুলিওনি ভুলবোও না। যদিও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম গভীর অভিমানে, ব্যথিত হৃদয়ে বেদনা বিধুর সুরে লিখে গেছেনÑ ‘তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু, আর আমি জাগিব না।/ কোলাহল করি সারাদিনমান কারো ধ্যান ভাঙ্গিব না।/ নিশ্চল নিশ্চুপ/ আপনার মনে পুড়ির একাকী গন্ধবিধুর ধূপ’।
সাম্যবাদী কবি নজরুলকে ভুলবার নয়, শীর্ষক প্রতিবেদনের উপসংহারের সমাপ্তি টানতে একটি কথা না লিখলেই যেন নয় (!) ১৯২২ সালে প্রকাশিত কবির লেখা ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মধ্য দিয়ে বাংলা কাব্যে অভূতপূর্ব ঝড় তুলেই ক্ষান্ত হননি। তিনি তার প্রকাশিত ধুমকেতু নামে পত্রিকায় রাজবন্দীর জবানবন্দী লিখেও আলোড়ন ফেলেছিলেন। তাঁর কলমে প্রকাশ পেয়েছে অসাম্প্রদায়িক চেতনা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তিনি যেমনি ইসলামী গজল লিখেছেন তেমনি তিনি শ্যামা সংগীত ও ভক্তিগীতিও রচনা করে গেছেন। কবি নজরুল সৃষ্টির সেরা সকল ধর্মের মানুষের ঐক্যের মধ্য দিয়ে সাম্য প্রতিষ্ঠার দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। তাইতো-‘কবি নজরুলের মৃত্যু নেই। জাতীয় কবি নজরুল যুগ যুগ জিও’। [গণপ্রহরীর প্রিন্ট কপির ফাইলবন্দি থাকায় লেখাটি যথাসময়ে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। তবে পাঠকের অনুরোধে তা প্রকাশ করা হলো।
আরও পড়ুন- সুকান্ত : কবি ও মানুষ
