Tue. Aug 19th, 2025
‘সেগুন কাঠ-এর ধৈর্য’: টেকসই উন্নয়ন ও সমাজ গঠনের গভীর পাঠ

সুদীপ্ত শামীম : ‘সেগুন কাঠ-এর ধৈর্য’: টেকসই উন্নয়ন ও সমাজ গঠনের গভীর পাঠ। একটা সেগুন গাছ, আমাদের পরিচিত টেকসই কাঠের জন্য অন্যতম শ্রেষ্ঠ উৎস। কিন্তু এই গাছটা যখন লাগানো হয়, তখন সেটা খুব ছোট, নরম আর দুর্বল একটা চারা। রোদ-বৃষ্টি, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, পোকামাকড়—সব কিছু সামলে তবেই সে গাছ হয়ে ওঠে। তবে তাড়াহুড়ো করে কাটা যায় না। কারণ, কাঠের মান নির্ভর করে বয়স আর পরিপক্বতার ওপর। একে কম বয়সে কাটলে কাঠ হয় নরম, টিকে না, পচেও যায় দ্রুত। তাই ভালো কাঠ পেতে হলে অপেক্ষা করতে হয়। চার দশক, কখনো পাঁচ। এই অপেক্ষা শুধু কাঠের মান নয়—সময়ের সঙ্গে গাছের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা কঠিন ও মূল্যবান আঁশের গভীরতা নির্ধারণ করে। এই রূপকটি শুধু গাছ নয়—একটা জাতির উন্নয়ন, সমাজের পরিণতি, কিংবা একটি শিশুর ভবিষ্যৎ গঠনের ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য। আমরা অনেক সময় চাইলেই সবকিছু একদিনে পেতে চাই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কোনো টেকসই পরিবর্তন বা গভীর অর্জন হুট করে আসে না।

সমাজ গড়ার ক্ষেত্রেও প্রয়োজনসেগুন কাঠ’–সদৃশ ধৈর্য
আমরা প্রায়ই চাই—অল্প সময়েই বড় কিছু অর্জন করতে। শিক্ষায়, অর্থনীতিতে, নাগরিক আচরণে কিংবা রাজনৈতিক সচেতনতায় হঠাৎ করে আমূল পরিবর্তন দেখব, এমনটি আমরা আশা করি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা কি সেই পরিবর্তনের বীজটিকে রোপণ করেছি? রোপণ করলেও আদৌ কি গাছটিকে সময় দিচ্ছি বেড়ে ওঠার? একটু ভাবুন, যেভাবে একটি ভালো সেগুন কাঠ পেতে হলে দীর্ঘ চার দশক অপেক্ষা করতে হয়, সেভাবেই একজন মানুষ, একটি প্রতিষ্ঠান কিংবা একটি সমাজকে গড়ে তুলতেও প্রয়োজন হয় সময়, ধৈর্য, যত্ন ও ধারাবাহিক পুষ্টির।
একজন আদর্শ শিক্ষক—যিনি শুধু পাঠ্যপুস্তক নয়, বরং শিক্ষার্থীর অন্তর্দৃষ্টি ও মূল্যবোধ গঠনে ভূমিকা রাখবেন—তাঁকে রাতারাতি তৈরি করা সম্ভব নয়। তাঁর নিজের শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, ত্যাগ, ও জীবনবোধ—এসবের সমন্বয়ে তিনি একজন ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ হয়ে ওঠেন। একজন সাংবাদিক, যিনি তথ্য যাচাই করে সত্য প্রকাশে অটল থাকবেন, তাঁকে গড়েও সময় লাগে। একজন সরকারি কর্মকর্তা, যিনি দায়িত্ববান, সেবাধর্মী এবং দুর্নীতিমুক্ত থেকে মানুষের জন্য কাজ করবেন, এমন একজন মানুষ সমাজে প্রস্তুত হতে বহু বছরের প্রস্তুতি, নৈতিক চর্চা ও সততা দরকার হয়।
একজন রাজনীতিক—যিনি শুধু জনপ্রতিনিধি নন, বরং নীতিনিষ্ঠ পথপ্রদর্শক হবেন—তাঁর চরিত্র, সাহস, সহানুভূতি, ও নেতৃত্বগুণ গড়ে উঠতে হয় অভিজ্ঞতা ও মূল্যবোধের অনুশীলনে। এমন ব্যক্তি সমাজকে আলোকিত করতে পারেন, কিন্তু তাঁকে গড়ে তুলতে সমাজকে সময় দিতে হয়, সহানুভূতি দিতে হয়, এবং উৎসাহ জোগাতে হয়। আজকাল অনেক অভিভাবক সন্তানের হাতে বই তুলে দিয়েই চায় সে যেন কয়েক বছরের মধ্যেই বিসিএস ক্যাডার হয়ে যায়। তারা ভাবেন, ‘পড়ানো শুরু করলাম, এখন চাকরি যেন হাতে আসে দ্রুত।’ অথচ সন্তানের বেড়ে ওঠার প্রতিটি ধাপেই তাকে সময় দিতে হয়, শেখার সুযোগ দিতে হয়, ভুল করার স্বাধীনতা দিতে হয়। তেমনি অনেক রাজনীতিবিদও ভাবেন—একবার নির্বাচিত হলেই এলাকার দৃশ্যপট বদলে ফেলবেন, সবাই তাঁকে নেতা মেনে নেবে। বাস্তবতা হলো, একজন প্রকৃত নেতা হওয়ার জন্য মানুষের আস্থা অর্জনের ধারাবাহিক চেষ্টা প্রয়োজন হয়, যা সময়সাপেক্ষ।
এমনকি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিও এলেই উন্নয়ন হবে—এই ধারণাটিও স্বল্পদৃষ্টিসম্পন্ন। একটি এলাকা বা জনপদের টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সামাজিক সম্পৃক্ততা, জনগণের মনন পরিবর্তন, নিজস্বতা ও স্থায়ী কাঠামো তৈরি। এটা রাতারাতি সম্ভব নয়। উন্নয়ন বা পরিবর্তনের আসল মানে হলো—সময় দেওয়া, পরিবেশ তৈরি করা, মনন গঠনে বিনিয়োগ করা। একেকটি প্রতিষ্ঠান, একেকটি মানুষ, একেকটি চিন্তাধারা—সবকিছুর ভেতরেই সেই ‘সেগুন কাঠ’ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু তাকে সময় না দিলে, যত্ন না নিলে, সে কখনো পরিপূর্ণতায় পৌঁছাবে না। আমরা যদি সত্যিকার অর্থে সমাজ বদলাতে চাই, তবে আমাদের প্রয়োজন এই ‘সেগুন কাঠ’–সদৃশ ধৈর্য, দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ এবং ভিত গঠনের মানসিকতা। কারণ, তাড়াহুড়োর সমাজ কখনো স্থায়ী অর্জন উপহার দিতে পারে না। উন্নয়নের জন্য সময়, ধৈর্য, ও কৌশলী চর্চার কোনো বিকল্প নেই।

আরও পড়ুন – গাইবান্ধার উন্নয়ন: সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

শিক্ষায় বিনিয়োগ: ফল পেতে সময় লাগে
শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ এমন একটি ক্ষেত্র, যার সুফল কখনোই তৎক্ষণাৎ পাওয়া যায় না। এটি ধৈর্য, দূরদৃষ্টি এবং স্থায়ী পরিকল্পনার দাবি রাখে। আপনি আজ একটি বিদ্যালয়ে একটি লাইব্রেরি নির্মাণ করলেন, পাঠাগারে বই তুলে দিলেন, শিক্ষার্থীদের হাতে একটি করে মানসম্মত পাঠ্যবই পৌঁছে দিলেন কিংবা একজন অনুপ্রেরণাদায়ক আদর্শ শিক্ষক নিয়োগ দিলেন—এই পদক্ষেপগুলোর তাৎক্ষণিক চেহারাটা হয়তো খুব চোখে পড়বে না। শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে শেখে, গড়ে ওঠে, সময় নেয় বুঝতে ও অভ্যস্ত হতে। কিন্তু এই বিনিয়োগের প্রকৃত ফল সমাজে প্রতিফলিত হবে ১০ থেকে ১৫ বছর পর। তখন সেই শিক্ষার্থীরাই হবে ভবিষ্যৎ সমাজের চালক, নীতিনির্ধারক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, গবেষক কিংবা সচেতন নাগরিক।
একবার চিন্তা করুন—যে শিশুটি আজ তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে, তার বয়স এখন আনুমানিক ৮ বছর। সে যদি একটানা নিরবিচারে, সহায়ক পরিবেশে, যোগ্য শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে, পর্যাপ্ত বই-পত্র ও শিক্ষাসামগ্রীতে শেখার সুযোগ পায়, তাহলে ২০২৭ সালের মধ্যে সে মাধ্যমিক, ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমাধ্যমিক, ২০৩৫ সালের দিকে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। স্নাতক, স্নাতকোত্তর শেষ করে ২০৪০ থেকে ২০৪৫ সালের মধ্যে সে একজন দক্ষ, আত্মবিশ্বাসী ও দায়িত্বশীল কর্মজীবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। শুধু একজন নয়—যদি একটি বিদ্যালয়ের একশো শিক্ষার্থীকেও আমরা সঠিকভাবে গড়ে তুলতে পারি, তাহলে সেই একশো জনের চিন্তা, কাজ, মনোভাব, মূল্যবোধ, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে একটা ইতিবাচক ঢেউ তুলতে পারে। এই ঢেউই তৈরি করে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন। তবে, সেই ঢেউ তৈরি করতে হলে আমাদের প্রথমেই দরকার সময়োপযোগী বিনিয়োগ এবং ধৈর্য। সেগুন কাঠ যেমন একদিনে ফল দেয় না, তেমনি শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগও রাতারাতি ফল দেয় না—কিন্তু যখন দেয়, তা হয় সুগন্ধি, শক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী। একটি শিশু, একটি পরিবার, একটি বিদ্যালয়, একটি গ্রাম, একটি অঞ্চল—সবই বদলাতে পারে শুধু সঠিক শিক্ষার মাধ্যমে। কিন্তু এই পরিবর্তন দেখতে হলে আমাদের ‘দ্রুত ফল’ নয়, বরং ‘গভীর ফল’ এর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যে জাতি এই অপেক্ষার মানে বোঝে, সেই জাতিই একদিন ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন – রংপুর মেডিকেল কলেজে লাগামছাড়া অনিয়ম-দুর্নীতিতে রোগীরা পর্যদুস্ত

রাজনৈতিক শুদ্ধতা: রাতারাতি আসে না
রাজনৈতিক শুদ্ধতা কিংবা নেতৃত্বের গুণাবলি এমন কিছু নয় যা হঠাৎ একরাতে কারও মধ্যে জন্ম নেয়। এটা দীর্ঘদিনের সাধনা, শিক্ষা, পরিশ্রম, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার ফসল। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে—যে নেতারা জাতিকে সামনে এগিয়ে নিতে পেরেছেন, তাদের জীবনের পেছনে লুকিয়ে আছে ত্যাগ-তিতিক্ষার এক দীর্ঘ অধ্যায়। একজন আদর্শ রাজনীতিক হয়ে উঠতে হলে শুধু উচ্চস্বরে স্লোগান দিলেই হয় না, দরকার হয় সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে গভীর জ্ঞান, বাস্তবমুখী দৃষ্টিভঙ্গি এবং নৈতিক সাহস। রাজনীতিতে রাতারাতি জনপ্রিয়তা পাওয়া গেলেও রাতারাতি রাষ্ট্রনায়ক হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে উদাহরণস্বরূপ ধরা যেতে পারে দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলার মতো নেতাদের—যারা তাদের যৌবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় আন্দোলনে ব্যয় করেছেন, কারাবরণ করেছেন, মানুষের দুঃখ-কষ্ট নিজের অভিজ্ঞতার ভাঁজে জমিয়ে নিয়েছেন। সেখান থেকেই জন্ম নিয়েছে নেতৃত্বের দৃঢ়তা, আর জনগণের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক।
আমরা আজ তরুণ নেতৃত্ব চাই, যেটা সময়ের দাবি। কিন্তু এই নেতৃত্বকে গড়ে তুলতে চাই ধৈর্য, সহনশীলতা ও সঠিক দিকনির্দেশনা। তরুণদের মধ্যে অনেক মেধা ও শক্তি আছে, কিন্তু সেটা পরিপক্ব হয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন ধাপে ধাপে চলার সুযোগ, শেখার পরিবেশ, এবং সমাজের বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা। তরুণ নেতৃত্বকে ঘষেমেজে, সময় দিয়ে, তাদের ভিত মজবুত করে তুলতে হয়—ঠিক যেমনভাবে একটি সেগুন গাছের বেড়ে ওঠায় সময় লাগে, তবে একবার সেটি পুরোপুরি গড়ে উঠলে তা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, ছায়া দেয়, কাঠ দেয়, দৃঢ়তা ও আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক শুদ্ধতা মানে শুধু দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতি নয়, বরং এর মধ্যে থাকে আদর্শিক অবস্থান, সেবার মানসিকতা, গণতান্ত্রিক চর্চা, অন্যের মতকে শ্রদ্ধা করার মনোভাব, এবং নৈতিক দৃঢ়তা। এসব গুণ একসাথে ধারণ করতে গেলে সময় লাগে, শিক্ষা লাগে, এবং সর্বোপরি প্রয়োজন হয় আত্মসমালোচনার সাহস। রাজনৈতিক নেতাদের যদি আমরা আদর্শ হিসেবে দেখতে চাই, তাহলে আমাদের উচিত হবে তাদেরকে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ ও গণমুখী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে গড়ে তোলা। সুতরাং, রাজনৈতিক পরিশুদ্ধতা রাতারাতি আসে না। এটি আসে চিন্তার গভীরতা থেকে, বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে এবং সমাজের জন্য কিছু করার তাড়না থেকে। এ পথে ধৈর্য আর নিষ্ঠা ছাড়া এগোনো যায় না। এটি একপ্রকার মননচর্চা, নৈতিক সংগ্রাম এবং সময়সাপেক্ষ আত্মগঠনের ফল।

আরও পড়ুন – স্মার্ট প্রকল্পের স্মার্ট দুর্নীতি : বঞ্চিত শুধু কৃষক

ব্যক্তিজীবনেওসেগুন কাঠদর্শন
স্রেফ রাজনীতি বা সমাজ নয়, আমাদের ব্যক্তিজীবনেও ‘সেগুন কাঠ’ দর্শনটি সমানভাবে প্রযোজ্য। একজন মানুষের সফলতা, ব্যর্থতা, চরিত্র কিংবা পরিপক্বতা—এসব কিছুই হুট করে গড়ে ওঠে না। একজন প্রকৃত মানুষ যেমন দিনে দিনে গড়ে ওঠে, তেমনি তার গড়ে ওঠার পেছনে থাকে এক দীর্ঘ অধ্যবসায়ের ইতিহাস, অন্তহীন সংগ্রাম আর সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার গল্প। একটা ভালো ক্যারিয়ার যেমন দিনে গড়ে ওঠে না, তেমনি একটা সুখী ও স্থিতিশীল সংসার, কিংবা গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক—এসবই গঠিত হয় ধাপে ধাপে, ধৈর্য, সময় ও নিষ্ঠার মাধ্যমে। অনেকেই মনে করেন—একটা চাকরি পেয়ে গেলেই জীবনের সমস্যা মিটে যাবে, অথবা ভালো একজন জীবনসঙ্গী পেলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। বাস্তবে বিষয়টা এতটা সরল নয়। একটি ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে সময় লাগে বহু বছর। শুরুতে কাজ শেখা, ভুল করা, আবার সেই ভুল থেকে শেখা—এই প্রক্রিয়ায় একজন ব্যক্তি ধীরে ধীরে তার দক্ষতা অর্জন করে। এমনকি একসময় সে হয়তো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে, কিন্তু সেই আত্মবিশ্বাসের পেছনে লুকিয়ে থাকে অসংখ্য ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা।
একইভাবে সংসার জীবনও ঠিক সেগুন গাছের মতো। শুরুটা হয় প্রেম, আবেগ ও আশা নিয়ে। কিন্তু সময়ের সাথে সম্পর্কের আসল রূপ উন্মোচিত হয়—চ্যালেঞ্জ আসে, মতপার্থক্য তৈরি হয়, পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সহনশীলতার প্রয়োজন পড়ে। যারা ধৈর্য ধরে সম্পর্ক গড়ে তোলেন, একে অপরকে বুঝতে শেখেন, একসঙ্গে বেড়ে ওঠেন—তাদের সংসারই পরিণত হয় এক সেগুন কাঠের মতো শক্ত ও স্থায়ী কাঠামোয়। বন্ধুত্বও ঠিক তেমন। একবার দেখা হওয়া বা কয়েকটা আড্ডা দিয়ে সত্যিকারের বন্ধু পাওয়া যায় না। একজন প্রকৃত বন্ধু আবিষ্কৃত হয় সময়ের পরীক্ষায়—আপদে, বিপদে, সাফল্যে ও ব্যর্থতায়। তখনই বোঝা যায় কে আসল আর কে কেবল সময় কাটানোর সঙ্গী। আসলে জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ দিকেই ‘পরিপক্বতা’ বলে একটা ব্যাপার রয়েছে, যা সময় ছাড়া অর্জন সম্ভব নয়। আর পরিপক্বতাই মানুষকে স্থিতিশীলতা দেয়। হুট করে পাওয়া যশ, সাফল্য বা সুযোগ যদি সেই মানসিক প্রস্তুতির অভাব নিয়ে আসে, তাহলে তা বেশিদিন টেকে না। যেমন কাঁচা কাঠ সহজেই পচে, তেমনি অস্থায়ী সফলতাও সামান্য ঝড়েই ভেঙে পড়ে। তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের প্রয়োজন ‘সেগুন কাঠ’ হওয়ার মানসিকতা—ধৈর্যশীল, ধাপে ধাপে বিকশিত, ভিতর থেকে শক্ত এবং বহমান সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। সময়ের পরিপক্বতায় গড়ে ওঠা মানুষই শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে সত্যিকারের সফল ও সম্মানিত ব্যক্তি।

আরও পড়ুন – ‘শ্যামপুর চিনিকল’ আখ চাষিদের মাঝে শঙ্কা কাটছেনা

রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় দীর্ঘমেয়াদি ভাবনা প্রয়োজন
একটি রাষ্ট্র কিংবা অঞ্চলের উন্নয়ন যদি তাৎক্ষণিকতা ও আবেগনির্ভর চিন্তার ওপর গড়ে ওঠে, তবে সেই উন্নয়ন দীর্ঘস্থায়ী হয় না, বরং অনেক সময় তা নতুন সংকটের জন্ম দেয়। পরিকল্পনার ক্ষেত্রে স্থায়ী ও সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি থাকা অত্যন্ত জরুরি। উন্নয়নের প্রকৃত মাপকাঠি হলো—মানুষের জীবনমানের স্থায়ী পরিবর্তন, প্রজন্মের পর প্রজন্মের জন্য টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা। আজকের বিশ্বে যে দেশগুলো উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে—জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর কিংবা জার্মানি—তাদের দিকে তাকালেই দেখা যায়, এ সাফল্য একদিনে আসেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তুপ থেকে উঠে আসতে তাদের দশকজুড়ে কাজ করতে হয়েছে। তারা পরিকল্পনা করেছে ২০, ৩০ কিংবা ৫০ বছর মেয়াদি। প্রযুক্তির উন্নয়ন, মানবসম্পদ গড়ে তোলা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের স্থায়িত্ব—এই সবকিছুর পেছনে ছিল সময়নির্ভর ধাপে ধাপে অগ্রগতির চিত্র।
বাংলাদেশের বাস্তবতায়ও এই দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি এখন সবচেয়ে জরুরি। শিক্ষা খাতে সময়োপযোগী পাঠ্যক্রম, গবেষণায় বিনিয়োগ, কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, নদীশাসন ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় টেকসই উদ্যোগ, এবং কর্মসংস্থান তৈরিতে দক্ষতা ভিত্তিক পরিকল্পনা—এসবই দীর্ঘমেয়াদি পলিসির মাধ্যমে সফল হতে পারে। নির্বাচনী বছর কিংবা ৫ বছরের মেয়াদ মাথায় রেখে উন্নয়ন চিন্তা করলে অনেক ক্ষেত্রেই তা হয় কাগুজে সাফল্য—মাঠ পর্যায়ে যার প্রভাব পড়ে না। ঠিক যেমন একটি সেগুন গাছ বড় হয়ে কাঠ দিতে সময় নেয়, তেমনি একটি দেশকে সত্যিকার অর্থে উন্নত করতে হলে সময়, পরিকল্পনা, ধৈর্য এবং ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। পরিকল্পনায় আবেগ নয়, প্রয়োজন প্রজ্ঞা। তা না হলে আমরা বারবার ভাঙবো, আবার নতুন করে গড়তে হবে, এবং উন্নয়নের পথে পিছিয়ে পড়বে পুরো সমাজ ও রাষ্ট্র।

আরও পড়ুন – মাছ কাটা-ই যাদের পেশা

অপেক্ষা, যত্ন বিশ্বাসই উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি
‘ভালো সেগুন কাঠ পেতে হলেও চার দশক অপেক্ষা করতে হয়’—এই কথাটির মধ্যে লুকিয়ে আছে জাতির উন্নয়ন ও সমাজ গঠনের গভীর সত্য। আমরা প্রায়ই দ্রুত ফলাফল চেয়ে থাকি, অথচ প্রকৃত উন্নয়ন ধৈর্য, পরিকল্পনা এবং ধারাবাহিক প্রয়াসের মাধ্যমে হয়। যেমন একটি সেগুন গাছ দীর্ঘ সময় ধরে নিজেকে দৃঢ় করে, তেমনি একটি দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রশাসন ও সামাজিক চেতনাও সময় নিয়ে পরিপক্ব হয়। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ শতবর্ষের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাদের শিক্ষা, প্রযুক্তি ও মানবসম্পদ উন্নয়নে কাজ করে এসেছে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলো তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। অন্যদিকে, আমাদের দেশে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে প্রকৃত উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারের বদলিতে নানা প্রকল্প অসম্পূর্ণ থেকে যায়, যা সম্পদের অপচয় এবং দীর্ঘমেয়াদি অগ্রগতির ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।
তবুও আশার কথা হলো, বাংলাদেশ আজকাল অনেক বড় প্রকল্প ও উদ্যোগ নিচ্ছে যা ভবিষ্যতের জন্য ভিত্তি স্থাপন করছে—যেমন ডিজিটাল বাংলাদেশ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা বন্দর, পাতাল রেল ইত্যাদি। এগুলো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও সময়সাপেক্ষ বিনিয়োগের ফলাফল। এগুলো সফল করতে প্রয়োজন নীতি ও কর্মপরিকল্পনার ধারাবাহিকতা, দক্ষ মানবসম্পদ, সামাজিক সচেতনতা এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রজ্ঞা ও সদিচ্ছা।
একটি সেগুন গাছ যখন রোপণ করা হয়, তখন তাৎক্ষণিক ফলের আশা করা যায় না, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেটি শক্তিশালী কাঠে পরিণত হয়, যার মূল্য অপরিসীম। ঠিক তেমনি, জাতির উন্নয়নও সময় নেয়, ধৈর্য ও যত্নের প্রয়োজন হয়। যারা আজ কঠোর পরিশ্রম ও ধারাবাহিক চেষ্টায় কাজ করছেন, তারা হয়তো নিজেরাই ফলাফল দেখতে পাবেন না, কিন্তু ভবিষ্যতের প্রজন্ম তাদের প্রচেষ্টার সুফল ভোগ করবে। সুতরাং আমাদের এখন দরকার ধৈর্যশীল জাতি গঠনের মানসিকতা, দীর্ঘমেয়াদি নেতৃত্ব ও পরিকল্পনার প্রতি অঙ্গীকার, এবং নাগরিক মননে সজাগতা ও দায়িত্ববোধ। ‘ভালো সেগুন কাঠ’ পেতে চাইলে এখনই শুরু করতে হবে মাটি তৈরি করা, বীজ বপন করা এবং সময়ের পরিপক্বতার অপেক্ষায় থাকতে হবে। এই অপেক্ষা, যত্ন ও বিশ্বাসের মধ্য দিয়েই আমাদের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব।

আরও পড়ুন – ক্যান্সার মানেই জীবন শেষ নয়

লেখক: কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী ও সংগঠক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *