ভাষ্যকার : স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্বদানকারীদের যথাযথ মর্যাদাদান আবশ্যক। শিরোনাম যেন প্রশ্ন নিয়েই হাজির। যেকোনো দেশের স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্বদানকারীদের যথাযথ মর্যাদাদান কি আবশ্যক (?) শিরোনাম ভিত্তিতে প্রশ্নটি স্বাভাবিক। কেননা, লেখার ভিত্তিতে শিরোনাম নয়। শিরোনাম ভিত্তিতে লেখা। সেহেতু প্রশ্নটি স্বাভাবিক হলেও, এ মুহুর্তে আলোচনা নিজ দেশের স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্বাদানকারীদের যথাযথ মর্যাদাদান বিষয় নিয়ে। এক্ষেত্রেও লেখার অগ্রগতির পথেই যে প্রশ্ন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। তাহলো তেপ্পান্ন বছরেও কি মর্যাদা দেয়া হয়নি?
না, তা দেয়া হলেতো শিরোনাম এভাবে ‘স্থান’ দখল করতো না। সম্মানিত পাঠকরা অবগত যে, পাঠকদের সাথে আলাপচারিতার মাধ্যমে সংগৃহীত মতামত ভিত্তিক তথ্য নিয়েই এই ভাষ্যকারের ‘ভাষ্য’। তবে দোহাই পাঠকবৃন্দ, রাগ করা যাবে না, গাল দেয়া যাবে না। কারণ, বিষয়টি সম্প্রতি আধা প্রকাশ্য-আধা গোপন। কারণ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের নেতৃত্বে জুলাই আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন-সংগ্রাম ‘গণঅভূত্থানে’ রূপ নিলে পতন ঘটে স্বৈরশাসনের। তাহলে আমাদের একাত্তরের স্বাধীন দেশ কি স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলেছিল? পাঠকের বিবেকের উপর ন্যস্ত থাকছে প্রশ্নাত্তর।
তবে নিশ্চিত, স্বৈরশাসনের শোষণ-নিপীড়ন, অত্যাচার-নির্যাতন, ঘুষ-দুর্নীতি ও অর্থ-পাচারে অতিষ্ট দেশের সতেরো কোটি মানুষ। চব্বিশের ৫ আগস্ট পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। তার পতনের মধ্য দিয়ে প্রায় সবার মুখেই যেন এক কথা, এক মন্তব্য-‘দেশ নতুনভাবে স্বাধীন হয়েছে’। দেশটি আমাদের ‘নতুন দেশ’। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে পরিচালিত আন্দোলনে নেতৃত্বাদানকারীরা পুলিশ-র্যাব-ছাত্রলীগ-যুবলীগের গুলির মুখে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং রক্তের বিনিময়েই গণঅভ্যূত্থানকে সফল করেছেন। এক্ষেত্রে জ্ঞানী-গুনী পাঠকদের মন্তব্য কাম্য।
সম্মানিত পাঠকদের সদয় অবগতির জন্য আবারো বলছি, ভাষ্যকারের সংগ্রহীত পাঠক জনসাধারণের মতামত ভিত্তিক তথ্য মতে একাত্তর পূর্ব থেকে স্বাধীনতা অর্জনে নানাজন নানাভাবে নানা স্থান থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বটে। কিন্তু সেভাবে ইতিহাস লেখা হয়নি। তবে গবেষণা চলছে। যে আলোকে নতুনরা বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্ব দিয়েছেন চব্বিশের গণঅভ্যূত্থানে। আগামীতে নিশ্চয়ই নেতৃত্বদানকারীদের পরিচিতি ও ভূমিকা আলোকপাত করেই ইতিহাস রচিত হবে। সেই ইতিহাস অবশ্যই ভিন্ন মতকেও উপস্থাপন করবে। যা ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করবে জ্ঞান অজর্নে। যে ইতিহাস নিজেও তাগিদ দিবে-‘স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্বদানকারীদের যথাযথ মর্যাদাদান আবশ্যক’।
এবার যার যার দৃষ্টিকোণ থেকে নিজ নিজ চিন্তায় ছাত্র-যুব-জনতাসহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষের ভেসে বেড়ানো মতামতকে ভাষ্যকারের ভাষ্য হিসেবে পাঠকের সামনে তুলে ধরার পালা। তাতে, এশিয়া-আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার স্বীকৃত মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানীকে ‘স্বাধীনতার প্রবক্তা’। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘স্বাধীনতার নেতা’। মেজর জিয়াউর রহমান ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ এবং স্বাধীনতা অর্জনে জিয়া ঘোষিত যুদ্ধ পরিচালনাকারী মুক্তিযোদ্ধাদের সেনাপতি কর্ণেল আতাউল গনি ওসমানী (এম এ জি ওসমানী)। অর্থাৎ স্বাধীনতার প্রবক্তা ভাসানী, স্বাধীনতার নেতা মুজিব, ঘোষক জিয়া ও সেনাপতি ওসমানী। ভাষ্যকার, গণপ্রহরী পক্ষে সকল শহীদদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের সাথে স্বাধীনতার এই নেতাদের প্রতিও জানাচ্ছি শ্রদ্ধা।
এতদসঙ্গে কিছু কিছু পুরানো বইপুস্তক ও পত্রপত্রিকার পাতা থেকে ভাষ্যকার জেনেছেন, মওলানা ভাসানীর বিশ্বস্ত ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন (ভাষা মতিন) ও কৃষক নেতা আলাউদ্দিন প্রমুখ পূর্ববাংলা কমিউনিষ্ট পার্টি (মাওবাদী-লেনিনবাদী-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার) ষাট দশকের শেষ দিকে স্বাধীন পূর্ববাংলার কর্মসূচি নিয়ে কৃষক-শ্রমিক জনতার উপর নির্ভর করে দেশের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ তৎপরতা শুরু করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত যুদ্ধরত ছিলেন। বরিশালের পেয়ারাবাগানকে ঘাটি হিসেবে গড়ে তুলে মার্কসবাদ- লেনিনবাদ-ও মাওসেতুঙ-এর চিন্তাধারায় সজ্জিত হয়ে শ্রমিক আন্দোলন (পূর্ব বাংলায় সর্বহারা পার্টি) নামে পূর্ববাংলাকে মুক্ত করার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করেন। অপরদিকে পূর্ববাংলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি (শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ) ষাট দশকে প্রখ্যাত ছাত্র নেতা মাহবুব উল্লাহ ১৯৭২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পল্টনের এক বিশাল ছাত্র জনসভায় স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা ঘোষণার সাথে ‘কর্মসূচি’ ঘোষণা করেন। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন কৃষক-সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন এবং পূর্ববাংলা ছাত্র ইউনিয়নসহ ছাত্র ইউনিয়ন ও ন্যাপ ভাসানী দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী গড়ে তুলে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। এক পর্যায় প্রায় সকলেই জেনারেল ওসমানী নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা বাহিনী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ করেন।
তবে হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের উগ্র বাঙ্গালী জাতীয়তাবদী কর্মসূচি নিয়ে পরিচালিত রাজনৈতিক তৎপরতায় বাঙালি জাগরণের সৃষ্টি হওয়ায়, পাকিস্তানী স্বৈরশাসক ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারের শর্ত সাপেক্ষের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ বিজয়ী হয়। এবং পাকিস্তানের সরকার গঠনের জন্য সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খানের সাথে শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিব তার প্রতিনিধি দল নিয়ে আলোচনা করতে থাকেন। এমন পর্যায়ে ২৫ মার্চ ১৯৭১ রাত প্রায় ৮টা পর্যন্ত ভারতে আশ্রিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী (তখনও সরকার গঠিত হয়নি) তাজউদ্দিন আহমেদ ধানমন্ডিস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাস ভবনে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে (লিখে নিয়ে যাওয়া) স্বাক্ষরের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান। শেখ মুজিব পাকিস্তানী সামরিক জান্তাদের হেফাজতে পাকিস্তান চলে যান।
পরবর্তীতে পাকিস্তানের সরকার গঠনে নির্বাচিত আওয়ামীলীগের এম এন এ এমপিরা বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত না হলেও বাংলাদেশের সরকার গঠন করেন । ৭ মার্চের ভাষনেও স্বাধীনতা ঘোষণার কথা উল্লেখ করা হয়নি। কেননা, উল্লেখ করলে ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনা হতো না। তাই মওলানা ভাসানী গোল টেবিল বৈঠক বর্জনের ডাক দিলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বৈঠক করতে থাকেন। আর এই গোল টেবিল বৈঠক চলাকালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে এবং সেনানিবাস, পিলখানা এসবের দপ্তর নিয়ন্ত্রণে নেয়। ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া বিদ্রোহ ঘোষণার মধ্য দিয়ে ‘স্বাধীনতা ঘোষণা’ করেন। দেশব্যাপী বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বে সেনা নিয়ন্ত্রণে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিজয় অর্জন করে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীকে বাদ রেখে, মিত্রবাহিনীর ভূমিকা পালনকারী ভারতীয় বাহিনীর কাছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পন করে। এ ঘটনাতেই নিহিত রয়েছে নতুন করে স্বাধীনতার এবং ‘স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্বদানকারীদের যথাযথ মর্যাদান আবশ্যক’ বিষয় নিয়ে গবেষণা ও নতুন করে লেখা প্রয়োজন ইতিহাস। যে ইতিহাস যার যেটুকু মর্যাদা প্রাপ্য তাকে সেটুকু মর্যাদা দেয়া অর্থাৎ যথাযথ মর্যাদানের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের জানার জন্মগত অধিকার। পরিশেষে স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্বদানকারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
