Thu. Jul 10th, 2025
৭১ মুক্তিযুদ্ধ বিপ্লব : স্মৃতির পাতায়এস এম হল

নাজমুল হক নান্নু : ৭১ মুক্তিযুদ্ধ বিপ্লব : স্মৃতির পাতায়। ২৬ মার্চ এস.এম. হল, ঢা.বি। খুব ভোরবেলা ঘুম ভেঙ্গে গেল। সাধারণত: এত ভোরে ঘুম ভাঙ্গে না। অনেক রাতে সকলেই ঘুমাই। ১৬৬ নং রুম, দোতলা। দক্ষিণ দিকের বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়ালাম। অদূরে রাস্তা। পলাশীর রেলগেট থেকে শহীদ মিনারের দিকে গিয়েছে, নির্জন রাস্তা, এস.এম হলের রাস্তার দু’পাশে অনেক বড় বড় গাছ। শাল, সেগুন, মেহগনি ও নাম না জানা উঁচু গাছ। শত বছরের পুরোনোও হতে পারে। পলাশীর রেলগেট থেকে পূর্ব দিকে শহীদ মিনারের দিকে যেতে পুরো এসএম হল এরিয়া পার হতে রাস্তার সূর্যের কোন আলোই পরে না। এক ঘন গাছের দিকে তাকিয়ে আছি বসন্ত বিদায়ের সময় ।

একটু শীত শীত করছে, নানা দুশ্চিন্তা, কি হবে! কি হবে! রাস্তার একটা- দুটো মানুষ দেখা যায়, মনে হয় প্রেতআত্মা । চারদিকে নিঝুম। শান্ত প্রকৃতি। কয়েক মিনিট পর রুমে ফিরে আবার বিছানায় শুয়ে পরলাম । ঘুম আসে না। অন্য বন্ধুরা ঘুমাচ্ছে, ভোরের ঘুম, গভীর ঘুম। বিছানা ছেড়ে উঠে পরলাম। ধীরে ধীরে সকলেই উঠলো। এসএম হলের এই রুমে আমরা যারা ছাত্র রাজনীতি করতাম, ১০ থেকে ১৫ জন থাকতাম ।

১৯৭০ সালে এই এসএম হলের মধ্যেই সম্মেলনের মাধ্যমে মাহবুবউল্লাহকে সভাপতি ও আমাকে (নজমুল হক নান্নু) সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। সংগঠনের নাম কিছুটা সংশোধন করে রাখা হয় ‘পূর্ববাংলা ছাত্র ইউনিয়ন’। যেহেতু পল্টন ময়দানের জনসভায় কিছুদিন আগে মাহবুবউল্লাহ স্বাধীন গণতান্ত্রিক পূর্ববাংলার দাবী জানিয়ে বক্তৃতা দেন।

স্বাধীন পূর্ববাংলার দাবির সেই কারণে ইয়াহিয়া সরকার তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করে এবং তাকে গ্রেফতার করে। সেজন্য সেই সময় ছাত্র ইউনিয়ন এবং ১১ দফা আন্দোলনের প্রখ্যাত ছাত্রনেতা নূর মোহাম্মদ খানকে কার্যকরী সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।

আমরা ১০/১২ জন একত্রে দক্ষিণ-পশ্চিমে হলের ক্যান্টিনে তাড়াতাড়ি নাস্তা করে মধুর ক্যান্টিনের দিকে রওয়ানা হলাম। অন্যান্য দিনের চেয়ে আজকের দিনটা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাটা একটু অন্যরকম। ছাত্র-ছাত্রীদের সকলের মধ্যেই এক নিরব জিজ্ঞাসা কি হবে আজ? কিছু কি হবে? আসলে সবগুলো রাজনৈতিক দল। ছাত্র সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন, কৃষক সমিতি সহ প্রতিটি মানুষের মধ্যেই দৃঢ় প্রত্যয়, সংগ্রামী চেতনা, বিপ্লবী সংকল্প উচ্চতর। সেই সংকল্পেই ৭১ মুক্তিযুদ্ধ বিপ্লব

৭১ মুক্তিযুদ্ধ বিপ্লব : স্মৃতির পাতায়
৭১ মুক্তিযুদ্ধ বিপ্লব স্মৃতির পাতায়

৭১ মুক্তিযুদ্ধ বিপ্লব : স্মৃতির পাতায় লেখার এ পর্যায়ে এক অর্থে বলা যায়, মধুর ক্যান্টিন ছিল আমাদের ছাত্র রাজনীতির প্রধান কেন্দ্র। দিনের অধিকাংশ সময়ই এখানে কেটে যেত। ক্যান্টিনের এক পাশে লোহার চেয়ারগুলো টেনে নিয়ে গোল হয়ে সকলেই বসলাম। মফস্বল, জেলা-মহকুমা থেকেও অনেক ছাত্রনেতা ও কর্মী এসেছিলেন। সকলেরই একই প্রশ্ন দেশে কি হবে? আমাদের কি করতে হবে? আসলে এটা ছিল আঘোষিত একটি সভা।

আমরা আমাদের রাজনৈতিক বক্তব্যটাই তুলে ধরলাম। আলোচনায় সকলেই অংশগ্রহণ করলো। রাজনীতির মূল বিষয় হলো আমরা স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলা-মুসদ্দী-পুঁজিবাদ (একচেটিয়া পুঁজিবাদ) এর ধারক-বাহক আয়ুব-ইয়াহিয়া চক্রকে উৎখাত করে পাকিস্তানের কবল থেকে পূর্ববাংলাকে মুক্ত করতে হবে। পূর্ববাংলা হবে স্বাধীন সার্বভৌম জনগণের গণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা।

আর এই সশস্ত্র বিপ্লবের নেতৃত্ব দিবে শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী পার্টি, কৃষক বিপ্লবের প্রধান সৈনিক। দেশ কৃষি প্রধান। কৃষকরাই বেশী শোষিত । আর প্রধান সহযোগী থাকবে শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষ, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, চাকুরীজীবী, ব্যবসায়ী, ছাত্র সমাজ, দেশের বিরাট অংশ মহিলা। মহিলারাও থাকবে বিপ্লবের অন্যতম প্রধান শক্তি। চুড়ান্ত লক্ষ্য হবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ধীরে ধীরে সমাজতন্ত্রের পথে অগ্রসর হওয়া। শোষণমুক্ত সমাজই হবে আমাদের জনগণের আরাধ্য সমাজ।

আমাদের আলোচনায় একটি বিষয় বার বার উঠে আসলো আর তা হচ্ছে ১৯৪৭ সালে মুসলমানদের জন্য স্বাধীন আবাস ভূমি অর্থাৎ স্বাধীন পাকিস্তান নামক একটি স্বতন্ত্র আবাস ভূমি স্থাপন করতে হবে। মুসলিম লীগ নেতাদের তাই দাবী ছিল মূলত: পাঞ্জাবের বড় বড় সামন্ত প্রভু, ভূ-স্বামী, বিকাশমান পুঁজিপতি শ্রেণী যারা টাটা, বিড়লা ও গোয়েস্কাদের সাথে প্রতিযোগীতায় পেরে উঠছিল না তাদের প্রতিনিধিত্ব করা।

তার ফলশ্রুতিতে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার ২২ বছরের মধ্যে আমরা পেলাম ২২ পরিবার। আদমজী, বাওয়ানী, ইসলামী, দাউদ, সায়গল ইত্যাদি । এরা ছিল একচেটিয়া বা বড় পুঁজিপতি শ্রেণী (আমলা-মুৎসদ্দি-পুঁজিপতি)। সুতরাং পূর্ববাংলা স্বাধীন হওয়ার পর বাঙালীদের জন্য স্বাধীন আবাস ভূমি বলে যদি শোষক শ্রেণী ক্ষমতায় থাকে তাহলে একই ঘটনার পূণরাবৃত্তি ঘটবে। শোষক শ্রেণী পুঁজিপতির সংখ্যা আরও বহু গুণ বাড়বে। দুর্নীতি অনেক বৃদ্ধি পাবে। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকবে না।

বুর্জোয়া আইনও প্রয়োগ হবে না। হবে ভয়াবহ অরাজকতা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বেলা ১১ টার সময় আমাদের মধ্যে এইসব বিক্ষিপ্ত আলোচনা হয়েছিল। অনেকেই প্রশ্ন করেছিল পাক আর্মি আক্রমণ করলে কিভাবে প্রতিহত করবো? আমাদের অস্ত্র কোথায়? আমাদের প্রস্তুতি কি? যেসব কর্মীদের আন্ডার গ্রাউন্ড বিপ্লবী পার্টির সাথে সংযোগ ছিল, তাদের আত্মবিশ্বাস প্রখর ছিল, তাদের এসব প্রশ্ন ছিল না, তাদের শপথ ছিল ‘জয়’ অথবা ‘মৃত্যু’ এর বিকল্প নেই।

তবে কেউই হতাশ ছিল না। বিপ্লব ও লড়াইতে কারও উৎসাহ কম ছিল না। নূর মোহাম্মদ খান ও আমি মধুর ক্যান্টিনের উপস্থিত সকল কর্মী বন্ধুদের নিকট থেকে বিদায় নিলাম। সিরাজ ভাই খবর দিয়েছেন আমাদের দু’জনকে জরুরী ভিত্তিতে দেখা করতে হবে। আমরা দু’জন সিরাজ ভাইয়ের (সিরাজুল হোসনে খান প্রখ্যাত সাংবাদিক ও শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক) সাথে দেখা করার জন্য বিজয় নগর ইস্টার্ন নিউজ এজেন্সির (এনা) দিকে রওয়ানা হলাম। সিরাজ ভাই ছিলেন এনার নির্বাহী ও বার্তা সম্পাদক। গোলাম রসুল মল্লিক ছিলেন এনার মালিক। বিজয় নগরে এনার অফিসে সিরাজ ভাইয়ের সাথে দেখা হলো। তিনি বাইরে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত । তিনি বললেন, টঙ্গী যেতে হবে শ্রমিকদের মধ্যে কি একটা উত্তেজনার সমস্যা। টেলিফোনে জরুরী খবর পেয়েছেন । এনার দোতলা অফিস থেকে সিরাজ ভাইয়ের সাথে নীচে নেমে এলাম । তাঁর একটা গাড়ি ছিল। তিনি নিজেই ড্রাইভ করতেন ।

বললেন তোমরা দু’জন উঠ, নামিয়ে দেব। তিনি ওই সময়ের মধ্যেই বললেন, আজ পাক আর্মি অ্যাকশনে নামবে। তোমরা সেল্টারে চলে যাও। আর পারলে ৩টার সময় বাসায় এসো। তখন সিরাজ ভাইয়ের বাসা ছিল কাকরাইলে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের বাসার বিপরীত দিকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট-বড় সকল ছাত্র সংগঠন মিটিং-মিছিল করছে । রাস্তা- ঘাটেও একই অবস্থা।

আবার মধুর ক্যান্টিনে এলাম। সেখানে সকলেই সকলের নিকট থেকে বিদায় নিলাম এবং যাই ঘটুক আমাদের মধ্যে যোগাযোগ থাকবে আমরা বললাম। আমাদের ১১ দফা আন্দোলনের কত সংগ্রামী নেতা, কর্মী, মিলু হক, গোলাম নাইজুদ্দিন খান, রাব্বি, সিহাবুদ্দিন নাদা, শফিক আরও অনেকেই ইতিহাসে প্রগতিশীল সংগ্রামী নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে। সকালের দিকে কর্মীরা অনেকেই আগেই বিদায় নিয়েছিল হায়। তখন কি জানতাম অনেক সংগ্রামী বন্ধু-সাথী চিরকালের মত বিদায় নিয়েছিল ।

৭১ মুক্তিযুদ্ধ বিপ্লব : স্মৃতির পাতায় শীর্ষক আজরে এই লেখায় যখন সেইসব শহীদ বিপ্লবী বন্ধুদের কথা স্মরণ করি তখন হৃদয় ভেঙ্গে যায়। কি ত্যাগী, আদর্শবান, দেশপ্রেমিক, মানুষ ছিল সেইসব বন্ধুরা। চিরকালের মত হারিয়ে গেছে। আমরা ওদের জন্য কিছুই করতে পরিনি। এরপর নূর মোহাম্মদ খান আর আমি এস.এম হলের দিকে এলাম; তখন বিকাল ৪টা।

বিঃদ্রঃ গণপ্রহরী পত্রিকার প্রধান সম্পাদক এসকে মজিদ মুকুল ও আমি একই ছাত্র সংগঠন ‘পূর্ববাংলা ছাত্র ইউনিয়ন’ করতাম। আমাদের একই আদর্শ শোষণমুক্ত সমাজ। তিনি একজন সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা। তার সংগঠিত ও ঘোষিত রৌমারী মুক্তাঞ্চল রক্ষা করেই মুক্তাঞ্চলবাসীল সার্বিক সহযোগিতায় পরিচালিত সম্মুখ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। তার প্রকাশিত পত্রিকায় লিখতে পেরে আমি খুব আনন্দিত।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *