Sat. Jul 12th, 2025
বামনডাঙ্গা ডাকবাংলো শত বছরের ঐতিহ্যবামনডাঙ্গা ডাকবাংলো শত বছরের ঐতিহ্য

বামনডাঙ্গা ডাকবাংলো শত বছরের ঐতিহ্য। গাইবান্ধা জেলার মধ্যে শত বছর পেরিয়ে ঐতিহ্যের বামনডাঙ্গা ডাকবাংলো আজও কালের স্বাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে। আড়াই শতাধিক বছর আগে ইংরেজ শাসনামলে উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কলকাতা বন্দরের সাথে পূর্ববঙ্গের যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য রিভার স্টিম নেভিগেশন কোম্পানী ও ইন্ডিয়ান জেনারেল নেভিগেশনের উদ্যোগে বাষ্প চালিত নৌযান চলাচল শুরু হয়।

ঠিক সমসাময়িক কালে ১৭৬৫ সালে রংপুরকে জেলা ১৮৫৮ সালে গাইবান্ধা (তৎকালীন ভবানীগঞ্জ) মহুকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। জেলা শহর থেকে মহুকুমায় যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল ঘাঘট নদীর সর্পিল নৌপথ। সেই সুপ্রাচীনকাল থেকে তাই ঘাঘট নদীর তীর ঘেঁেষ গড়ে উঠতে থাকে জনপথ। ঘাঘট নদী বিধৌত তেমনি এক প্রাচীন জনপদ বামনডাঙ্গা। ঘাঘটের দক্ষিণ তীরে নগর কাঠগড়া ঘাট, উত্তরে ন্যাড়া গোয়ালের ঘাট (বর্তমানে বামনডাঙ্গা মহাশ্বশান) এবং শিববাড়ী ঘাট গড়ে ওঠার মধ্যদিয়ে প্রচীন বামনডাঙ্গা বন্দরের গোড়াপত্তন ঘটে।

বামনডাঙ্গা বন্দরের প্রাচীন এ তিন নৌঘাট অঞ্চলের অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে রূপান্তরিত হতে থাকে। দেশ-বিদেশি বণিকেরা পাট, গম, আলু, সরিষা, আখ প্রভৃতি কেনা-বেচা করতো। এ অঞ্চলের পাটের খ্যাতি ছিল সুদূর ইংল্যান্ড পর্যন্ত। তাই বনিকেরা নৌপথে বামনডাঙ্গা বন্দরে আসতো বাণিজ্য করতে। বণিকদের মধ্যে মারোয়ারিরা এখানে বসতি স্থাপন করে নৌপথে নারায়নগঞ্জ, খুলনাসহ দেশের বিভিনড়ব অঞ্চলে পাট পরিবহন করতো।

১৯০৫ সালে বামনডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন চালু হলে লালমনিরহাটের মোঘলহাট হয়ে ভারতের গিতলদহ থেকে বামনহাট হয়ে পাটেশ্বরী-ভুরুঙ্গামারি-সোনাহাট হয়ে ভারতের গোলকগঞ্জ দিয়ে কলকাতার শিয়ালদহ, রানাঘাট পর্যন্ত রেলপথে সরসরি পণ্য ও যাত্রী পরিবহন শুরু হয়। আর এরই মধ্যেদিয়ে বামনডাঙ্গা বন্দর রেল যুগে প্রবেশ করে আর গড়ে ওঠে ভিনদেশীদের অনেক কলোনী।

ঠিক তার পরবর্তী সময়ে সরকারী কর্মচারী বা ভ্রমনকারী অথবা ‘ডাক’-বাহী ঘোড়ার ও আরোহীর বিশ্রাম ও রাত্রি যাপনের জন্য ঘাঘটের তীরে শিববাড়ী ঘাটে স্থাপন করা হয় বামনডাঙ্গা ডাকঘর ও ডাকবাংলা। ডাকঘরটি বর্তমানে বামনডাঙ্গা কলেজ রোড অবস্থিত। আর বামনডাঙ্গা শিববাড়ী মোড় সংলগ্ন স্থানে ১৯১৫ সালে নির্মাণ করা হয় তিন কক্ষ বিশিষ্ট একটি ছাদপেটা ঘর, অতিথিদের রন্ধনশালা, স্টাফ কোয়াটার যা আজও দৃশ্যমান ।

নদীর গতিপথ পরিবর্তন এবং সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠায় কালের পরিক্রমায় বামনডাঙ্গা নদীবন্দর বর্তমানে গুরুত্ব হারিয়েছে। ঘাঘট ধীরে ধীরে সংকীর্ন হয়ে মরা নদীতে পরিণত হয়ে এর জৌলুস হারিয়েছে অনেক আগেই। শুধু শতবছরের কালের স্বাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে বামনডাঙ্গা ডাকবাংলোর লালখয়েরি রঙের বিল্ডিংটি।

তথ্য-প্রযুক্তির অগ্রসরতা ও সড়ক পথের ব্যাপক উন্নয়নের ফলে বামনডাঙ্গা ডাকবাংলোর প্রয়োজনীয়তা গুরুত্বহীন হয়ে পড়লে অত্র এলাকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে এ ডাকবাংলোর মূল ভবনটি প্রথমে বামনডাঙ্গা পুলিশ ফাঁড়ি এবং পরবর্তীতে বামনডাঙ্গা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আগের স্থাপনা অক্ষুন্ন রেখে পাশে গড়ে তোলা হয়েছে সুউচ্চ বামনডাঙ্গা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ভবন।

বামনডাঙ্গা বন্দরে পাশে প্রকৃতির নিবিড় সানিধ্য পেতে অনেকেই ঘুড়তে আসেন ঐতিহ্যের বামনডাঙ্গা ডাকবাংলোয়। শতবর্ষী লিচু, আম, কাঁঠাল, কদম, মেহগনি গাছের সুনিবির ছায়ায় ঘেরা। পশ্চিমে ঘাঘটনদী, পূর্বে ট্রেন লাইন। কিছুক্ষণ পরপর কু ঝিকঝিক করে ট্রেন যাচ্ছে। এখানে সূর্যের সোনালী রোদ গাছের সবুজ পাতা ছুঁয়ে যায়। গোধূলীর শেষ ছটাটুকু দিয়ে ডুব দেয় মেঘ বালিকারা। শত বছর পরেও নানা স্মৃতি-বিস্মৃতি, ট্রাজেডি নিয়ে কালের স্বাক্ষী হয়ে আজও আছে বামনডাঙ্গা ডাকবাংলো।

-লেখক: হাবিবুর রহমান হবি, গণমাধ্যমকর্মী ও সংগঠক।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *