স্বপন চৌধুরী : তিস্তা নদী মৌসুমের শুরুতেই শুকিয়ে কাঠ। তিস্তা নিজেও মরছে, হামাকও মারছে। নদীত এ্যালা পানি নাই, মাছও নাই। খ্যায়া-না খ্যায়া দিন কাটে হামার।’পানিশূন্য তিস্তাকে দেখিয়ে এভাবে ক্ষোভের সঙ্গে বলেন বাপ-দাদার পেশা আঁকড়ে নদীতে মাছ ধরেই সংসার চালানো নদীপারের মটুকপুর এলাকার ক্ষিতিশ চন্দ্র দাস।
দেশের অন্যতম নদী তিস্তার বুকে এখন জেগে উঠেছে বিশাল চর। কোথাও কোথাও সবজি ফলিয়েছেন স্থানীয়রা, কোথাও বিকেল হলে চরে বসে জমজমাট ফুটবল-ক্রিকেট ম্যাচ। বৃহত্তর রংপুরের পাঁচ জেলার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের জীবনরেখা হিসেবে ইতিহাসে তিস্তার সুনাম থাকলেও ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করায় সেই তিস্তাই এখন এই অঞ্চলের মানুষের দু:খের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে গত ৩৭ বছরে ভারত সোয়া দুই কোটি কিউসেক পানি থেকে বঞ্চিত করেছে তিস্তাকে। ঐতিহ্যগতভাবে নদীমাতৃক বাংলাদেশের উত্তরের অন্যতম প্রাণপ্রবাহের এ অবস্থায় উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরাও।
৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ খরস্রোতা তিস্তা নদী সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের দার্জিলিং-জলপাইগুড়ি হয়ে বাংলাদেশের নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা হয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারীর ভিতর দিয়ে ১২৪ কিলোমিটার অতিক্রম করে ব্রহ্মপুত্র নদে গিয়ে মিশেছে। সেই চিরযৌবনা তিস্তা ক্ষীণ হতে হতে মরে যাচ্ছে। তার বুকজুড়ে খরস্রোতা জলের ধারা আর নেই। তিস্তার বুকে বিস্তীর্ণ চর জেগে ওঠায় হুমকির মুখে পড়েছে জীব-বৈচিত্র। বিশেষ করে দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ থেকে ভাটিতে কুড়িগ্রাম পর্যন্ত নদীর এমন হতশ্রী চেহারা চোখে পড়ে। অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে গভীরতা না থাকায় দু’কুল উপচে তিস্তাপারে দেখা দেয় বন্যা।
চোখের সামনেই বসতভিটাসহ ঘরবাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে যায় তিস্তা। পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় তিস্তাই এখন এ অঞ্চলের মানুষের অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। এই নদীর ওপর নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলার ডালিয়া ও দোয়ানীতে নির্মিত তিস্তা ব্যারাজের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে এ অঞ্চলে কৃষিজমিতে যে সেচ দেওয়ার কথা, সেটাও এখন অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে কৃষি, মাছ, পরিবেশ ও নৌ যোগাযোগ ক্ষেত্রে। প্রকৃতি ক্রমাগত ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। ফলে এই তিস্তা নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে পানির স্তর নিম্নমুখী হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সূত্র জানায়, শুস্ক মৌসুমে নদীর স্বাভাবিক গতি ঠিক রাখতে তিস্তা ব্যারাজে প্রতিদিন পানির প্রয়োজন অন্তত ৭ থেকে ১০ হাজার কিউসেক। সেখানে পানি পাওয়া যায় মাত্র ৫’শ থেকে সর্বোচ্চ ১২’শ কিউসেক। প্রতিবছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত শুস্ক মৌসুম ধরা হলেও নভেম্বর থেকেই নদী শুকিয়ে যায়। তিস্তা ব্যারাজের উজানে ভারত ১৯৮৭ সালে গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার শুরু করে।
প্রয়োজনের ৮ ভাগের এক ভাগ পানি পাওয়ায় তিস্তা অববাহিকায় নেমে আসে ঘোর অমানিশা। শুষ্ক মৌসুমের ৩ মাসে পানির প্রয়োজন পড়ে গড়ে ৭ লাখ কিউসেকের বেশি। সেই হিসেবে ৩৭ বছরে পানি পাওয়ার কথা ছিল আড়াই কোটি কিউসেবের বেশি। মৌসুমে গড়ে এক হাজার কিউসেক করে পানি পাওয়া গেলে পানি পাওয়া গেছে ৩৪ লাখ কিউসেক। সেই হিসেবে সোয়া দুই কোটি কিউসেক পানি থেকে বঞ্চিত হয়েছে তিস্তাপারের মানুষ। আবার বর্ষা মৌসুমে পানি ছেড়ে দিয়ে দু’কূল ভাসায় ভারত।
এসময় পানির প্রবাহ থাকে প্রায় ১ লাখ কিউসেক। রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, এখন শুষ্ক মৌসুমে ১ হাজার কিউসেকের মত পানি পাওয়া যাচ্ছে। যদিও নদীর গতিপথ ঠিক রাখতে ৭ থেকে ১০ হাজার কিউসেক পানির প্রয়োজন। ১ হাজার কিউসেকের কম পানি থাকলে তিস্তা ব্যারাজের সবগুলো গেট বন্ধ করেও সেচ সুবিধা দিতে হিমসিম খেতে হয়। তখন ভাটি এলাকায় নদীতে এক ফোটা পানি ছাড়ারও সুযোগ থাকেনা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, তিস্তা ব্যারাজের পানি নিয়ন্ত্রণে তৈরি ৪৪টি জলকপাটের সবকটিই বন্ধ। নদীর ভাটিতে যত দূর চোখ যায়, চোখে পড়ে শুধু রাশি রাশি বালু। মাঝেমধ্যে পানির মৃদু ধারা। পানির অভাবে চলাচল করতে না পারায় বেঁধে রাখা হয়েছে নৌকাগুলো। অনেকে পায়ে হেঁটেই পার হচ্ছে তিস্তা। ব্যারাজ এলাকায় আসা পর্যটকদের নৌকায় ঘুরিয়ে প্রায় দুই দশক ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন ব্যারাজের পার্শ্ববর্তী বাইশপুকুর গ্রামের ছকমল হক।
তিনি বলেন, ‘এখন নদীতে পানি নেই তাই পর্যটকও আসে না। এখন আমার নৌকাও চলে না, সংসারও চলে না।’ পানির অভাবে ব্যারাজের ভাটিতে তিস্তার ছোট-বড় শতাধিক খেয়াঘাট বন্ধসহ নৌ-যোগাযোগের ক্ষেত্রে মারাত্মক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বেকার হয়ে পড়েছে বাপ-দাদার পেশা আঁকড়ে ধরে থাকা নৌকার মাঝিরা।
ব্যারাজের ভাটিতে রংপুরের গঙ্গাচড়ার মহিপুর ও কাউনিয়া রেল সেতুর নিচে ভুট্টা, আলু, চিনাবাদাম, মিষ্টি কুমড়াসহ রকমারি ফসলের চাষ হয়েছে। গঙ্গাচড়ার বিনবিনা চর এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম ও সেকেন্দার আলীসহ কৃষকরা জানান, ক’বছর ধরে তারা তিস্তার পলি পড়া চরে নানা ফসল ফলাতেন। নদীর পানিতে সেচ সুবিধা থাকায় উৎপাদন খরচ কম হতো।
কিন্তু এখন আর সেইদিন নেই, নদী শুকিয়ে মরুভূমি হয়েছে। নদীর বুকে সেচযন্ত্র বসিয়ে চাষকৃত ফসলে সেচ দিতে হচ্ছে। তিস্তাপারের লক্ষ্মীটারি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী জানান, তিস্তার বেহাল দশায় নানামুখী সমস্যায় পড়েছে নদীপারের মানুষ। নদীতে পানি না থাকায় মৎস্যজীবীরা বেকার হয়ে পড়েছে। চরাঞ্চলের জমিতে আলুসহ বিভিন্ন ফসলের চাষ করেও পানির অভাবে সেচ দিতে না পারায় কৃষকরা বছরের পর বছর ধরে লোকসান গুনছে। খেয়াঘাটগুলো বন্ধ হওয়ায় বেকায়দায় পড়েছে মাঝি-মাল্লারাও। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় গাছপালা মরে যাচ্ছে। চরাঞ্চলজুড়ে প্রায় মরুভূমির সৃষ্টি হয়েছে। নলকূপ কিংবা মাটির কুয়ায় ঠিকমতো পানি উঠছে না। এতে বিশুদ্ধ পানিরও সংকট দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, তিস্তার পানি নিয়ে ২০০৫ সালে জিআরসি’র মন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এর পরে ২০০৬ সালে বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও ভারত সরকারের আগ্রহ না থাকার কারণে বৈঠকটি হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বৈঠকের প্রক্রিয়া পুণরায় শুরু হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ভারত বাংলাদেশকে তার প্রাপ্য কখনোই দেয়নি।
শুষ্ক মৌসুমে ভারত একতরফা ভাবে পানি প্রত্যাহার করে এদেশের কৃষজ সম্পদসহ হাজার বছরের ঐতিহ্যকে ধবংস করছে। নদী গবেষক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, বন্যা-ভাঙনসহ পানিহীন তিস্তার বহুরুপ দেখেছে এই অঞ্চলের কয়েক প্রজন্ম। তিস্তাপারের মানুষের ছুটে চলার পথ কেবলমাত্র বসতভিটা আর তিস্তায় জেগে ওঠা চরের কৃষিজমি। সে কারণে সাধারণ মানুষের চাপ তৈরি করে নিজ দেশিয় ব্যবস্থাপনায় তিস্তা নদীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। আর এমন প্রতীক্ষায় দিন শেষ হয় এ অববাহিকার কোটি মানুষের।
