গণপ্রহরী রিপোর্ট : উনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান প্রেক্ষিতে জানুয়ারির সতর্কবার্তা। বাংলাদেশী বাঙালি জাতির স্বাধীকারের আন্দোলনের মাইলফলক হিসাবে ইতিহাসের চিহ্নিত অধ্যায় উনসত্তরের জানুয়ারি আন্দোলন। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা কর্মসূর্চী ভিত্তিক গণআন্দোলনকে ঐতিহাসিক গণঅভ্যূত্থানে পরিণত করার দ্বার উন্মোচিত হয় ২০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শহীদ আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান আসাদের জীবনদানের মধ্যদিয়ে। আর সফল গণঅভ্যূত্থানকে নিশ্চিত করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে পরিচালিত ছাত্র-গণআন্দোলনের সকল গণতান্ত্রিক দল ও বিভিন্ন পেশাজীবি সংগঠনসহ সাধারণ জনগণের স্বত:স্ফুর্ত অংশগ্রহণে এগিয়ে চলা আন্দোলন-সংগ্রামের গণমিছিল। এই জানুয়ারির আন্দোলনই ‘বিশ্বগণ আন্দোলনে’র ইতিহাসের একটি অধ্যায়ও বটে।
উনিশ শ’ উনসত্তর সালের ২৪ জানুয়ারি। পাকিস্তানের লৌহমানব খ্যাত প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের ছদ্মাবরনে স্বৈরশাসনের ভীত কেঁপে উঠেছে ছাত্রজনতার গণআন্দোলনের মিছিলের গর্জনে।
তারপরও আইয়ুব শাহীর শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে ‘সান্ধ্য আইন’ জারি। ‘সান্ধ্য আইন’ ভঙ্গ করে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে বাধভাঙ্গা শ্লোগানে মুখর ছাত্র জনতার গণমিছিল এগিয়ে চলছে সামন থেকে আরও সামনে। মিছিল চলছে। মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন নবম শ্রেনীর ছাত্র মতিয়ুর রহমান। শহীদ হন মনির, ড. জোহা ও রুস্তমসহ অনেকে। মূহুর্তেই দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে খবর; আগুণে ঘি ঢেলে দেয়ার মতোই সর্বত্র মিছিল আরও বেগবান হয়ে ওঠে। অকাতরে জীবন দেয়ার প্রতিযোগীতায় স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্য অর্জনে, সূচনা হয় নতুন দিগন্তের। এই সূচনা সৃষ্টিকারি ‘উনসত্তরের গণআন্দোলন প্রক্ষিতে জানুয়ারির সতর্কবার্তা আমরা জেনে নিবো নীচের আলোচনা থেকে।
তৎসময়ের পূর্বপাকিস্তান (পূর্ববাংলা থেকে বাংলাদেশ) অঞ্চলের ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক জনতার সপ্তাহ কালের স্বত:স্ফূর্ত-দুর্বার আন্দোলন, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের পদত্যাগ অনিবার্য করে তোলে ও পিছু হটে স্বৈরশাসক। পিছু হটলেও, আরেক সামরিক জান্তা সেনাপতি ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায়। ক্ষমতা নিয়ে সামরিক শাসনের আওতায়ই ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারন নির্বাচন ঘোষনা করে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ আগরতলা মামলার অন্যান্য আসামিদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তবে সত্তর সাল থেকেই ২৪ জানুয়ারি ঐতিহাসিক গণঅভ্যূত্থান দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। সেই ‘উনসওরের গণঅভ্যূত্থান প্রেক্ষিতে জানুয়ারির সতর্কবার্তা’ দিয়ে জাতীয় জীবন থেকে এক বছরের জন্য বিদায় নিচ্ছে ।
২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যূত্থান দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তাঁর বাণীতে বলেছেন ’জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যূত্থানসহ দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে উনসওরের গণঅভ্যুত্থান জুগিয়েছে অমিত প্রেরণা।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস তাঁর পৃথক বাণীতে উনসত্তরের গণঅভ্যূত্থানকে বংলাদেশের ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রবাস থেকে এবং দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও গণঅভ্যূত্থান দিবস স্মরণে বাণী দিয়েছে
‘উনসত্তরের গনঅভ্যূত্থান প্রেক্ষিতে জানুয়ারির সতর্কবার্তা’-কি জানান দিচ্ছে সেদিকে দৃষ্টি দেয়া আবশ্যক। যেহেতু বিশ্বের গণআন্দোলনের ইতিহাসে উনসত্তরের জানুয়ারি আন্দোলন (জানুয়ারি-মার্চ) একটি অধ্যায়। সে অধ্যায় থেকে জানার আছে, শিক্ষার আছে ও অনুকরণীয় বিষয়ও রয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সময় সুযোগ অভাবে আজকের এই প্রতিবেদনে আলোচনা সম্ভব না হলেও পরবতীতে আলোচনার আশা রেখে বিদায় লগ্নে জানুয়ারির সতকবার্তা জানাটাই গুরুত্ববহ। কেননা, স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতন ঘটেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে পরিচালিত চব্বিশের জুলাই-আগষ্টের ছাত্র আন্দোলনের-গণঅভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে। উনসত্তরের গণঅভ্যূত্থানের শহীদদের রক্তপথ বেয়েই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। অত:পর দীর্ঘ ৫৩ বছরের ঘটনা বহুল ইতিহাস। আর ১৬ বছর কালের স্বৈরশাসকের পতনের পর জনসমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায়। সেহেতু জানুয়ারির সতর্কবার্তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে।

জানুয়ারির সতর্কর্তা যেন প্রথমে জানান দিচ্ছে, ‘দেশ ও জনগণকে সংকটে রেখে কারো কোন স্বপ্নই পূরণ হবে না’। বর্ণনায় আলোচ্য-(ক) বিশ্ব ব্যবস্থা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী। আর এই ব্যবস্থায় বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও জোট সমূহ বিশ্বে আধিপত্য ও বাজার দখলে একক কর্র্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দ্বন্দ্বে লিপ্ত। এমন দ্বন্দ্ব থেকে দূরে থাকতে হবে এবং দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে অক্ষুণ রাখতে কারও অনুগত নয়, সবার সাথেই স্বীকৃত আন্তর্জাতিক নীতিমালায় বন্ধুত হবে সমঅধিকার ভিত্তিতে। (খ) প্রতিবেশী সম্প্রসারণবাদী ভারতের উগ্রহিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপি জোটের ভারত সরকার ভারতকে সাম্রাজ্যবাদ হিসেবে পরিণত করার অপতৎপরতায়-শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাসীন করার মধ্য দিয়ে রক্তার্জিত স্বাধীন এই দেশকে, ভারতের অনুগত রাষ্ট্রে পরিণত করে ‘দুর্গ’ হিসেবে ব্যবহার করে আসছিল। চব্বিশের গণঅভ্যূত্থানে সেই সরকারের পতন হয়।
সতর্কবার্তা বলছে-‘একদিকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব বিদ্যমান থাকাকালে, ভারতের হারানো স্বর্গ (বাংলাদেশ) ফিরে পেতে পতিত স্বৈরাচার হাসিনাকেই ক্ষমতাসীন করতে বদ্ধ পরিকর। সেজন্য আমাদের দেশের আভ্যন্তরে ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা’ সৃষ্টির অপতৎপরতার অব্যাহত রেখেই সীমান্তে ক্ষমতা প্রয়োগ করে চলছে। এতে হয়তো অনুগত রাষ্ট্র পুন:প্রতিষ্ঠা নয়তো, উগ্রহিন্দুত্ববাদী ধ্যান ধারনায় রামের অখন্ড ভারত গড়ার স্বপ্ন পূরণে পথ প্রশস্ত করা। সেহেতু সব রকম অপতৎপরতা অপচেষ্টার সাথে নানা কূট-কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। যা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি এবং এ পরিস্থিতিতে দেশের ও জনগনের নিরাপত্তা ও হুমকির মুখে।
উপরন্ত দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধিসহ বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট জনজীবনে মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জন- আকাঙ্খা পূরণ হচ্ছেনা। এমতাবস্থায় সতর্কবার্তায় উল্লেখিত সংকট -ও হুমকি থেকে দেশ ও জনগণকে মুক্ত করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্ব পালন সর্বাগ্রে বিবেচ্য। এ প্রেক্ষিতে সরকার ও রাজনৈতিক দলসহ সবার ভূমিকা-বক্তৃতা-বিবৃতি জনগণ বিচার-বিশ্লেষণ করছেন। তাই উনসত্তরের গনঅভ্যূত্থান প্রেক্ষিতে জানুয়ারির সতর্কবার্তা জানান দিচ্ছে-দেশ ও জনগণকে সংকটে রেখে কোনো স্বপ্নই পূরণ হবে না কারও।
আরও পড়ুন-
মুক্তিযুদ্ধের বিজয় কি সত্যিই দূরে (?
চব্বিশের বিজয়ের পর জাতির সামনে একাত্তরের বিজয় দিবস
