সুকান্ত : কবি ও মানুষ। সুকান্তের মৃত্যুকে নিজেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। হৃদ স্পন্দন থেকে আসার সংবাদ অনুভব করেছিলেন নিজেই। তাঁর রচনায়ও সে ঘাতক মৃত্যুর কথা বাদ পড়েনি। তাই তাঁর প্রশ্ন,
“দ্বারে মৃত্যু,
বনে বনে লেগেছে জোয়ার,
পিছনে কি পথ নেই আর?”
অবৈধ কবিতায় বলেছেন,
“সহসা একদিন আমার দরজায় নেমে
এল
নি:শব্দে উড়ন্ত গৃধিনীরা।
সেই দিন বসন্তের পাখি উড়ে গেল
যেখানে দিগন্ত ঘনায়িত।”
‘হে পৃথিবী’ কবিতায় সুকান্ত আমাদের
পূর্বাভাস দিয়েছেন-
“হে পৃথিবী, আজিকে বিদায়
এ দুর্ভাগা চায়,
যদি কভু শুধু, ভুল করে
মনে রাখো মোরে,
বিলুপ্তি সার্থক মনে হবে
দুর্ভাগার।……
প্রভাত পাখির কলস্বরে
যে লগ্নে করেছি অভিযান,
আজ তার তিক্ত অবসান।”
‘সহসা’ কবিতায় সুকান্ত লিখেছেন
“আমার গোপন সূর্য হল অস্তগামী,
এ পারে মর্মরধ্বনি শুনি,
নিস্পন্দ শরের রাজ্য হতে ক্লান্ত চোখে তাকাল শকুনি।
গোধুলি আকাশ বলে দিল,
তোমার মরণ অতি কাছে,”
‘সুতরাং’ কবিতায় ও মৃত্যুর হাতছানি পরিলক্ষিত হয়:
“এতদিন ছিল বাঁধা সড়ক,
আজ চোখে দেখি শুধু মরক!
এত আঘাত কি সইবে,
যদি না বাঁচি দৈবে?”
কেননা (‘বুদ্বুমাত্র’ কবিতায় সুকান্ত বলেন-)
“জন্মের প্রথম কাল হতে,
আমরা বুদ্বুমাত্র জীবনের স্রোতে।”
“আমার মৃত্যুর পর” কবিতায় মৃত্যু
সম্পর্কে সুকান্ত যে মত ব্যক্ত করেছেন তা হল-
“আমার মৃত্যুর পর থেকে যাবে কথার
গুজন,
আমার মৃত্যুর পর, জীবনের যত অনাদর
লাঞ্ছনার বেদনায়,
স্পষ্ট হবে প্রত্যেক
অন্তর”।
……মুহুর্ত কবিতায় সুকান্ত বলেন,
“মুহুর্তকে ভুলে থাকা বৃথা, যে মুহুর্ত
তোমার আমার অন্য সকলের মৃত্যু সূচনা,
‘মরণের তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান’- পূর্বসূরির
এই তত্ত্ব নিয়ে সুকান্ত একটি গাণ রচনা করেছিলেন, যেখানে মৃত্যুকে তিনি বরণ করে নিয়েছেন। মরণকে বলেছেন-‘নীরব চুমি করিও হরণ’। এখানে এসে যেন সুকান্তর সাথে মৃত্যুর সাক্ষাৎ ঘটেছিল।
“হে মোর মরণ, হে মোর মরণ।
বিদায় বেলা আজকে একেলা দাওগো
শরণ!
……………………………………..
তোমার বুকে অজানা স্বাদ,
ক্লান্তি আনো, দাও অবসাদ;
তোমায় আমি দিবস যামী করিনু বরণ।
আমায় তুমি নীরব চুমি করি ও হরণ”।
ক্লান্ত কবি আর পারছে না জীবনের ভাব বইতে। তিনি মুক্তি চেয়ে বলেছেন,
“ক্লান্ত আমি, ক্লান্ত আমি, কর ক্ষমা;
মুক্তি দাও হে এ-মরু তরুরে,
প্রিয়তমা”।
কবি যে ঝড়ে যাবেন তা তাঁর অন্তর জেনেছিল। জেনেছিল বলেই তাঁর এত কাজ, এত তাড়া। সবকিছু বুঝেই যেন সুকান্তর উচ্চারণ,
“আজ মোর ঝরিবার পালা,
সব মধু হয়ে গেছে ঢালা;
আজ মোরে চলে যেও দলি”।
শেষ নিয়তি (গান) তে কবি বলেন,
“আমি কেঁদেই কই যেওনা কোথাও
সে যে হেসে কয় মোরে যেতে দাও”।
আয়োজন (বর্ণনা)-এ দেখা যায় কবি মৃত্যুকে চিরন্তর সত্য এবং শ্বাশ্বতের সুর বলে আখ্যায়িত করেছেন আবহমান কালের সুর বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন।
“বিশ্ব বীনার তারে
আজ কোনো সুর বেজে উঠেছে,
জানো?
সে তোমারই বিদায়-
বেদনায় সকরুণ ওপারের সুর”।
‘যাত্রা’ (আবৃত্তি)য় মৃত্যুর জন্য সুকান্তকে ধীরে ধীরে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে দেখা যায়-
“অমৃত লোকের যাত্রী
হে অমর কবি,
কোন প্রস্থানের পথে তোমার
একাকী অভিযান।
প্রতিদিন তাই
নিজেরে করেছ মুক্ত
বিদায়ের নিত্য আশঙ্কায়,”
“মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভূবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই”।
বিশ্ব কবির এই বাণী সুকান্ত যেন মর্মে উপলব্ধি করে ‘বিদায়’ (গান) তে বলেছেন,
“বিদায় নিতে চায় কে ওরে
বাঁধরে তারে বজ্র ডোরে”
সুকান্ত যেন মৃত্যুপথ যাত্রী হরিণী, রাখাল ছেলেকে বলছে-
“বাঁশি তোমার বাজাও বন্ধু আমার
মরণকালে,
মরণ আমার আসুক আজি বাঁশির তালে তালে”।
আবার যেন হরিণীকে হারিয়ে রাখাল ছেলেরূপী সুকান্ত গাইছেন-
“বিদায় দাওগো, বনের পাখি!
বিদায় নদীর ধার,…..
….আর কখনো হেথায় আমি
বাজাবনা এমন বাঁশি”
আবার যেন বলেছে-
“ডেকো না গো তোমরা
আমার চলে যাবার বেলা,”
মরণের ইঙ্গিত শুধু কবিতা বা গানেই সীমাবদ্ধ রাখেননি সুকান্ত। তাঁর কাজে, আচার-ব্যবহারে এবং চিঠি পত্রের জবানীতেও সেই ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া যায়। ২৪ পৌষ, ৪৮ তাঁর বন্ধু অরুণকে লেখা এক চিঠিতে সুকান্ত বলেছেন……।
“একদিন হয়তো এ পৃথিবীতে থাকবো না…
সত্যি অরুণ বড় ভালো লেগেছিল
পৃথিবীর স্নেহ
আমার ছোট্ট পৃথিবীর করুণা।
বাঁচতে ইচ্ছা করে,….
মরিতে চাইনা আমি সুন্দর ভুবনে।
কিন্তু মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে…
আবার পৃথিবীতে বসন্ত আসবে,
গাছে ফুল ফুটবে।
শুধু তখন থাকবো না আমি”।
অন্য একটা চিঠিতে সুকান্ত লিখেছেন তাঁর বন্ধু অরুণকে, ‘ডাক্তার আমাকে শয্যাগত করে রেখেছে,…. আমি নিরূপায়’। ২৮/১০/৪৪ সুকান্ত লিখেছেন যে ম্যালেরিয়া তোকে প্রায় নির্জীব করে তুলেছে, আমি এখানে (বেনারস সিটি) আসার পঞ্চম দিনে তারই কবলে,… তোকে রীতিমতো কষ্ট করেই লিখতে হচ্ছে। আর লিখতে পারছি না”।
সুকান্ত : কবি ও মানুষ
সুকান্তের মৃত্যুকে নিজেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। হৃদ স্পন্দন থেকে আসার সংবাদ অনুভব করেছিলেন নিজেই। তাঁর রচনায়ও সে ঘাতক মৃত্যুর কথা বাদ পড়েনি। তাই তাঁর প্রশ্ন,
“দ্বারে মৃত্যু,
বনে বনে লেগেছে জোয়ার,
পিছনে কি পথ নেই আর?”
অবৈধ কবিতায় বলেছেন,
“সহসা একদিন আমার দরজায় নেমে
এল
নি:শব্দে উড়ন্ত গৃধিনীরা।
সেই দিন বসন্তের পাখি উড়ে গেল
যেখানে দিগন্ত ঘনায়িত।”
‘হে পৃথিবী’ কবিতায় সুকান্ত আমাদের
পূর্বাভাস দিয়েছেন-
“হে পৃথিবী, আজিকে বিদায়
এ দুর্ভাগা চায়,
যদি কভু শুধু, ভুল করে
মনে রাখো মোরে,
বিলুপ্তি সার্থক মনে হবে
দুর্ভাগার।……
প্রভাত পাখির কলস্বরে
যে লগ্নে করেছি অভিযান,
আজ তার তিক্ত অবসান।”
‘সহসা’ কবিতায় সুকান্ত লিখেছেন
“আমার গোপন সূর্য হল অস্তগামী,
এ পারে মর্মরধ্বনি শুনি,
নিস্পন্দ শরের রাজ্য হতে ক্লান্ত চোখে তাকাল শকুনি।
গোধুলি আকাশ বলে দিল,
তোমার মরণ অতি কাছে,”
‘সুতরাং’ কবিতায় ও মৃত্যুর হাতছানি পরিলক্ষিত হয়:
“এতদিন ছিল বাঁধা সড়ক,
আজ চোখে দেখি শুধু মরক!
এত আঘাত কি সইবে,
যদি না বাঁচি দৈবে?”
কেননা (‘বুদ্বুমাত্র’ কবিতায় সুকান্ত বলেন-)
“জন্মের প্রথম কাল হতে,
আমরা বুদ্বুমাত্র জীবনের স্রোতে।”
“আমার মৃত্যুর পর” কবিতায় মৃত্যু
সম্পর্কে সুকান্ত যে মত ব্যক্ত করেছেন তা হল-
“আমার মৃত্যুর পর থেকে যাবে কথার
গুজন,
আমার মৃত্যুর পর, জীবনের যত অনাদর
লাঞ্ছনার বেদনায়,
স্পষ্ট হবে প্রত্যেক
অন্তর”।
……মুহুর্ত কবিতায় সুকান্ত বলেন,
“মুহুর্তকে ভুলে থাকা বৃথা, যে মুহুর্ত
তোমার আমার অন্য সকলের মৃত্যু সূচনা,
‘মরণের তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান’- পূর্বসূরির
এই তত্ত্ব নিয়ে সুকান্ত একটি গাণ রচনা করেছিলেন, যেখানে মৃত্যুকে তিনি বরণ করে নিয়েছেন। মরণকে বলেছেন-‘নীরব চুমি করিও হরণ’। এখানে এসে যেন সুকান্তর সাথে মৃত্যুর সাক্ষাৎ ঘটেছিল।
“হে মোর মরণ, হে মোর মরণ।
বিদায় বেলা আজকে একেলা দাওগো
শরণ!
……………………………………..
তোমার বুকে অজানা স্বাদ,
ক্লান্তি আনো, দাও অবসাদ;
তোমায় আমি দিবস যামী করিনু বরণ।
আমায় তুমি নীরব চুমি করি ও হরণ”।
ক্লান্ত কবি আর পারছে না জীবনের ভাব বইতে। তিনি মুক্তি চেয়ে বলেছেন,
“ক্লান্ত আমি, ক্লান্ত আমি, কর ক্ষমা;
মুক্তি দাও হে এ-মরু তরুরে,
প্রিয়তমা”।
কবি যে ঝড়ে যাবেন তা তাঁর অন্তর জেনেছিল। জেনেছিল বলেই তাঁর এত কাজ, এত তাড়া। সবকিছু বুঝেই যেন সুকান্তর উচ্চারণ,
“আজ মোর ঝরিবার পালা,
সব মধু হয়ে গেছে ঢালা;
আজ মোরে চলে যেও দলি”।
শেষ নিয়তি (গান) তে কবি বলেন,
“আমি কেঁদেই কই যেওনা কোথাও
সে যে হেসে কয় মোরে যেতে দাও”।
আয়োজন (বর্ণনা)-এ দেখা যায় কবি মৃত্যুকে চিরন্তর সত্য এবং শ্বাশ্বতের সুর বলে আখ্যায়িত করেছেন আবহমান কালের সুর বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন।
“বিশ্ব বীনার তারে
আজ কোনো সুর বেজে উঠেছে,
জানো?
সে তোমারই বিদায়-
বেদনায় সকরুণ ওপারের সুর”।
‘যাত্রা’ (আবৃত্তি)য় মৃত্যুর জন্য সুকান্তকে ধীরে ধীরে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে দেখা যায়-
“অমৃত লোকের যাত্রী
হে অমর কবি,
কোন প্রস্থানের পথে তোমার
একাকী অভিযান।
প্রতিদিন তাই
নিজেরে করেছ মুক্ত
বিদায়ের নিত্য আশঙ্কায়,”
“মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভূবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই”।
বিশ্ব কবির এই বাণী সুকান্ত যেন মর্মে উপলব্ধি করে ‘বিদায়’ (গান) তে বলেছেন,
“বিদায় নিতে চায় কে ওরে
বাঁধরে তারে বজ্র ডোরে”
সুকান্ত যেন মৃত্যুপথ যাত্রী হরিণী, রাখাল ছেলেকে বলছে-
“বাঁশি তোমার বাজাও বন্ধু আমার
মরণকালে,
মরণ আমার আসুক আজি বাঁশির তালে তালে”।
আবার যেন হরিণীকে হারিয়ে রাখাল ছেলেরূপী সুকান্ত গাইছেন-
“বিদায় দাওগো, বনের পাখি!
বিদায় নদীর ধার,…..
….আর কখনো হেথায় আমি
বাজাবনা এমন বাঁশি”
আবার যেন বলেছে-
“ডেকো না গো তোমরা
আমার চলে যাবার বেলা,”
মরণের ইঙ্গিত শুধু কবিতা বা গানেই সীমাবদ্ধ রাখেননি সুকান্ত। তাঁর কাজে, আচার-ব্যবহারে এবং চিঠি পত্রের জবানীতেও সেই ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া যায়। ২৪ পৌষ, ৪৮ তাঁর বন্ধু অরুণকে লেখা এক চিঠিতে সুকান্ত বলেছেন……।
“একদিন হয়তো এ পৃথিবীতে থাকবো না…
সত্যি অরুণ বড় ভালো লেগেছিল
পৃথিবীর স্নেহ
আমার ছোট্ট পৃথিবীর করুণা।
বাঁচতে ইচ্ছা করে,….
মরিতে চাইনা আমি সুন্দর ভুবনে।
কিন্তু মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে…
আবার পৃথিবীতে বসন্ত আসবে,
গাছে ফুল ফুটবে।
শুধু তখন থাকবো না আমি”।
অন্য একটা চিঠিতে সুকান্ত লিখেছেন তাঁর বন্ধু অরুণকে, ‘ডাক্তার আমাকে শয্যাগত করে রেখেছে,…. আমি নিরূপায়’। ২৮/১০/৪৪ সুকান্ত লিখেছেন যে ম্যালেরিয়া তোকে প্রায় নির্জীব করে তুলেছে, আমি এখানে (বেনারস সিটি) আসার পঞ্চম দিনে তারই কবলে,… তোকে রীতিমতো কষ্ট করেই লিখতে হচ্ছে। আর লিখতে পারছি না”।
আরও পড়ুন- ঝাড়ুদার থেকে লেখিকা
