স্বপন চৌধুরী : ‘দুর্গে’ নিভু নিভু জাতীয় পার্টি। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারে সংলাপে জাতীয় পার্টিকে না ডাকা ও বিগত সরকারের দোসর হিসেবে আখ্যা দেওয়ায় কোণঠাসা হয়ে পড়েছে দলটির নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। বিশেষ করে রংপুরে নিজ দুর্গেই চরম দুর্গতিতে পড়েছে জাতীয় পার্টি। নেই কোনো দলীয় কর্মকাণ্ড।
দেশের পট পরিবর্তনের পর কো চেয়ারম্যান ও সাবেক সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার ডাকে দুই দফা কর্মী সমাবেশসহ প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করেছে দলটির নেতাকর্মীরা। তবে কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, দলকে সুসংগঠিত করার পাশাপাশি বিশেষ করে রংপুরে তাদের ‘দুর্গ’ পুনরুদ্ধারে কাজ করছেন তারা।
জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বাড়ি রংপুর। সে কারণে এই অঞ্চল এক সময় ‘লাঙ্গলের ঘাঁটি’তে পরিণত হয়। জাতীয় পার্টির দখলে ছিল বৃহত্তর রংপুরের পাঁচ জেলার ২২টি আসন। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সেখানে ভাগ বসায় আওয়ামী লীগ।
সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে রংপুরের ৬টি আসনের মধ্যে ৫টিই আওয়ামী লীগ দখলে নেয়। শুধুমাত্র রংপুর-৩ (সদর) আসনে পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের জয়ী হয়েছিলেন ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে। নেতাকর্মীরা জানান, নির্বাচন এলেই আওয়ামী লীগ সরকার নিজেদের স্বার্থে জাতীয় পার্টির গলা টিপে ধরতো, দলের ভেতরে কোন্দল সৃষ্টি করে ফায়দা লুটতো।
তাই ‘কলঙ্ক’ মাথায় নিয়ে কেনরকমে টিকে আছে জাতীয় পার্টি, তাও কো চেয়ারম্যান মোস্তফার জনপ্রিয়তার কারণে। দুর্গ পুনরুদ্ধারই আগামীতে রংপুরে মোস্তফানির্ভর দলটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে জানান তারা। পার্টির সাধারণ সমর্থক নগরীর জুম্মাপাড়া এলাকার মাহমুদ আলী, হনুমানতলা এলাকার আবুল হোসেন বলেন, ‘দলমত বুজিনা বাপু, মোস্তফা যেখানে থাকপে-হামরাও সেখানে থাকমো।’
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের রংপুর মহানগর কমিটির সভাপতি ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, মাঠপর্যায়ে সাংগঠনিক কাঠামো ও কার্যক্রম গতিশীল না থাকায় জাতীয় পার্টির একের পর এক পরাজয় হয়েছে। তাছাড়া বিগত সরকারের সঙ্গে থাকায় আগামীতে সাধারণ ভোটাররা দলটিকে প্রত্যাখ্যান করবে।
জেলা জাতীয় পার্টির নেতা রহমত আলী, আব্দুল গণি, মহানগরের নেতা আনিছুর রহমান ও সাদেক হোসেন জানান, পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বেঁচে থাকাকালেও নিজেদের মধ্যে নানা নাটকীয়তায় টানাপোড়েনে পড়ে দলটি। তাঁর মৃত্যুর পরও আধিপত্য নিয়ে নানা সংকটে পড়তে হয়।
দুর্গে’ নিভু নিভু জাতীয় পার্টি
সর্বশেষ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের কুট-কৌশল জাতীয় পার্টিকে তছনছ করে দিয়েছে। তার পরও জাতীয় পার্টি মানেই রংপুর, এখানে কো চেয়ারম্যানসহ কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব, প্রেসিডিয়াম সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, সাংগঠনিক সম্পাদক, সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক ও নির্বাহী সদস্য রয়েছেন। কিন্তু ৫ আগষ্টের পর দেশের পট পরিবর্তনে নেতাকর্মীসহ সমর্থকরা অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছেন, আগ্রহ নেই দলের প্রতি। তবে কো চেয়ারম্যান মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার জনপ্রিয়তা আছে। তার নেতৃত্বেই রংপুরে জাতীয় পার্টি এখনো অবস্থান ধরে রেখেছে।
জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক সম্পাদক লোকমান হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগের জালে জামানত হারানোর হিড়িকে দুর্গেই দুগর্তি ডেকে এনেছে পার্টির প্রার্থীরা। দলের এমন পরিণতিতে ভবিষ্যত রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান নিয়ে শঙ্কিত পার্টির নেতাকর্মীরাও। ঘাঁটি রক্ষার চেষ্টা চলছে।
যুগ্ম মহাসচিব হাজি আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সরকার পতনের পর জাতীয় পার্টির ঝিমিয়ে পড়া নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হয়েছেন। এই মূহুর্তে আমরা দলকে সুসংগঠিত করাসহ পরিবেশ তৈরি করছি। প্রস্তুতি নিচ্ছি যে কোন সময়ে নির্বাচনের ঘোষণা এলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার। প্রেসিডিয়াম সদস্য এসএম ইয়াসির বলেন, ছাত্রদের আন্দোলনে দেশের মানুষ নতুন করে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে। তেমনি জাতীয় পার্টিও কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। এতদিন আওয়ামী লীগ সরকার নানা কুট-কৌশলে জাতীয় পার্টিকে কোণঠাসা করে রেখেছিল।
দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আমাদের আস্থা আছে। আগামীতে নির্বাচন হবে এবং বিগত নির্বাচনগুলোর ধারাকে পিছনে ফেলে সাধারণ মানুষ ফের ভোট উৎসবে মেতে উঠবে। তখন এক সময়ের জাতীয় পার্টির ঘাঁটি রংপুর ফিরবে তার পুরনো ঐতিহ্যে।
এ ব্যপারে কথা হলে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও রংপুর সিটির সাবেক মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে কথা বলার স্বাধীনতাটুকুও ছিলনা। কিন্তু এখন সেদিন আর নেই, মাথার ওপর থেকে কালো মেঘ সরে গেছে। দলকে সুসংগঠিত করতে তৃণমুল পর্যায়ে নেতাকর্মীরা স্বতস্ফুর্তভাবে কাজ করছেন। ফের সময় এসেছে পার্টির আসনগুলো পুনরুদ্ধার করার। রংপুর জাতীয় পার্টির ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে।
দুর্গে,
