নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আইসিসিরি গ্রেফতারি পরোয়ানা সত্বেও যুদ্ধ থামেনি। যুদ্ধ শুরু থেকে লেখার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত ফিলিস্তিনে নারী শিশুসহ ৪৪ হাজার ছাড়িয়ে যেন অর্ধ-লক্ষ মানব সন্তান হত্যার সংখ্যা দ্রুত পূরণ করতে যুদ্ধ চলছে। এতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধার আগ পর্যন্ত চলতি হারেই বর্বোরচিত হত্যা চলতে থাকবে, নাকি প্রতি দিন-রাতে এত সংখ্যক মানুষ হত্যার মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিকে জনশুণ্য করে ইসরাইলি ভূখন্ড বিস্তৃত করবে; তা সময়ই বলে দিবে। ইতিমধ্যে আন্তার্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) নেতানিয়াহুসহ দু’জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমসহ গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুসারে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োব গ্যালান্টের বিরুদ্ধে আন্তার্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) মানবতা বিরোধী অপরাধসহ যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গত ২১ নভেম্বর বৃহস্পতিবার গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। হামাসের সামরিক কমাণ্ডার মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগে আইসিসি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। এই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারিতে ইসরাইলি আগ্রাসী আক্রমণের যুদ্ধে কোনো প্রভাব পড়েনি। ফলে জনমতে, নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আইসিসির গ্রেফাতরি পরোয়ানা সত্বেও যুদ্ধ থামেনি। বিশ্বের মুক্তিকামী-স্বাধীনতাকামী মানুষ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি বা জাতিসংঘের বিরোধীতায় যুদ্ধ বন্ধের সম্ভাবনা দেখছেন না।
কেননা, বিশ্বাবাসীর সামনে রয়েছে-মার্কিনের ইরাক আক্রমনে ও ইরাকের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের হত্যাকান্ড। সামনে রয়েছে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করতে আফগানিস্তানে আক্রমেণের ঘটনা। যে ভিত্তিতে জাতিসংঘের আপত্তি-নিষেধাজ্ঞা কতটা কার্যকর তা দেখে আসছেন। তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহের সমর্থিত বা উদ্যোগের আক্রমণে, আশাব্যাঞ্জক কোন ফলাফল পাওয়ার আশা নেই। তবুও আশার দিক হচ্ছে, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির ঘটনায় ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জোবাইডেন বলেছেন, ইসরায়েলের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি মোকাবিলায়, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পাশে থাকবে সব সময়। পক্ষান্তরে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইতালি ও নেদারল্যান্ডস, আইসিসি জারিকৃত গ্রেফতারি পরোয়ানাকে স্বাগত জানিয়েছে।
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আইসিসির গ্রেফতারি পরোয়ানা সত্বেও যুদ্ধ থামেনি’ শিরোনাম শীর্ষক আলোচনার এ পর্যায়ে আমাদের আহ্বান-‘মুসলিম-ইহুদিসহ সকল জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তুলুন, সাম্রাজ্যবাদমুক্ত ধর্ম নিরপেক্ষ অখণ্ড স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করুন’। ইতিহাসের আলোকে বিশ্লেষণমুলক যৌক্তিক আলোচনায় বলাবাহুল্য যে, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রে ইহুদিদের বসবাসের পৃথক স্থান (বর্তমান ইসরাইল) নির্ধারণ করার সিদ্ধান্তই ছিল ‘গোড়ায় গলদ’ রাখা। যদি গোড়ায় এই গলদ না থাকতো, তাহলে ফিলিস্তিনি নবজাতক শিশুকে মায়ের বুকের এক ফোটা দুধের জন্য চিৎকার করতে করতে এবং কেওবা এক ফোটা পানির জন্য করুন আর্তনাদ জানিয়েই অনেককে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়েছে। যুদ্ধাহতসহ জীবন থাকতেই কতনা মানব সন্তানকে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে ধ্বংসস্তুপের নীচে চাপা পড়ে। মসজিদ, গীর্জাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ত্রান শিবিরসহ সকল অবকাঠামো গুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। গোড়ায় গলদ না থাকলে এমনটা হতো না। বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্রও তৈরী হতো না ফিলিস্তিনি। তবে এটা নিশ্চিত ফিলিস্তিন যুক্ত হবেই, হবে। স্বাধীন স্বত্ত্বা নিয়ে বিশ্বের সামনে দাঁড়াবে। তবে ইতিহাসের শিক্ষায় গোড়ার গলদকে ভুল প্রমাণ করে বিজয় অর্জন করতে হবে।
এবার ইতিহাসের আলোকে যৌক্তিক পর্যালোচনায় ইতিহাসের শিক্ষা গ্রহণের পালা। শুরুতেই বলে নেই, নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আইসিসির গ্রেফতারি পরোয়ানা সত্বেও যুদ্ধ থামেনি। ইতিহাস যেমনি বাস্তব তেমনি রুঢ়। সেই ইতিহাসের স্বাক্ষ্য মতে ১৯১৮ সালের আগে ফিলিস্তিনে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদিরা মিলেমিশে শান্তিতে বসবাস করতেন। আজ কেন তারা পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে যুেদ্ধ লিপ্ত? আন্তঃ-সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বে মার্র্র্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের সাথে -রাশিয়া সাম্রাজ্যবাদ ও চীন সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বব্যাপী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার দ্বন্দ্বে লিপ্ত।
ফলশ্রুতিতে বিশ্ব ইতিমধ্যেই সংকটের মধ্য দিয়ে সময় অতিক্রমকালে একটি বিশ্বযুদ্ধ বিকাশমান, সে পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ কেন? এর উত্তরের জন্য অতীতে ফিরতে হবে। সে জন্য ‘েগাড়ায় গলদ’ চিহ্নিত করতে হবে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পরিকল্পনায় ভারতবষর্কে বিভক্ত করে যেমন-ধর্মবাদী ভারতÑপাকিস্তান রাষ্ট্র বানিয়েছিল। তেমনি ফিলিস্তিনি মুসলমান ও ইসরাইলের ইহুদীদের জন্য দুটি ধর্মবাদী রাষ্ট্র বানানোর সাম্রাজ্যবাদী নীল নক্শার ছদ্মাবরণে অপতৎপরতা?
তারই ফলশ্রুতিতে, নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আইসিসির গ্রেফতারি পরোয়ানা সত্বেও যুদ্ধ থামেনি-থামছে না। ফিলিস্তিনের ও ইসরাইলের শ্রমিক কৃষক ও সাধারন মাধ্যবিত্তসহ সাধারণ জনগণ মাধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক ও ধর্মবাদী ফ্যাসিবাদী শাসনে শাসিত হচ্ছেন। এই শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের কোন সম্ভাবনা নেই। কেননা, ইসারাইল রাষ্ট্রের উৎপত্তি বিশ্ব ইতিহাসের ধারাবাহিকতার রায়েÑ ইসরাইলি রাষ্ট্র স্থাপন ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সে ভুলের দিকে ফিরে যাওয়ারও সিদ্ধান্ত হবে মারাত্মক ভুল। মুলত ঃ ফিলিস্তিন ও ইসরালের শাসক শ্রেণীর একপক্ষ মার্কিন মদদপুষ্ট এবং হামাস সহ ফিলিস্তিনি শাসক গোষ্ঠী রুশ-চীন মদদপুষ্ট আঞ্চলিক শক্তি ইরান সমর্থিত অর্থাৎ শ্রেনী চরিত্র এক।
তাই বাস্তবতার নিরিখে শাসিত সাধারন জনগণকে জীবন দিয়ে অর্জিত শিক্ষার সাথে ইতিহাসের শিক্ষা থেকে শিক্ষা নিয়ে ১৯১৮ সালের আগের মতো মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদি জনগণকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার নেতৃতা¡ধীন পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দালাল শাসক শ্রেণীসহ ধর্মবাদী সংগঠনের এবং রাশিয়া ও চীন সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দালাল শাসক শ্রেণীসহ ধর্মবাদী সকল সংগঠনের আওতামুক্ত থেকে ধর্ম নিরপেক্ষ স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে, এগিয়ে যেতে হবে সামন থেকে আরও সামনে।
সে ঐক্য না থাকায়ই নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আইসিসির গ্রেফতারি পরোয়ানা সত্বেও যুদ্ধ থামেনি। যেহেতু, ফিলিস্তিনের জনসংখ্যার প্রায় সমান সংখ্যক অর্থাৎ এক কোটি ইহুদি ইসরাইলে বসবাস করেন, তারাও শাসিত। তাদের শত্রু শিবিরে ঠেলে না দিয়ে তাদের পক্ষে আনতে হবে, ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। ইতিহাস আলোচনার স্থান এটি নয়। তবে দুটি বিষয়ে সম্মানিত পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেই আলোচনার সুবিধার্তে বিশ্বপরিস্থিতি নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনার মাধ্যমে শিরোনাম প্রাসঙ্গিক আলোচনা করবো। তার আগে বলতে হচ্ছে ও হবে- মুসলিম ইহুদিসহ সকল জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তুলুন; সাম্রাজ্যবাদমুক্ত ধর্ম নিরপেক্ষ অখণ্ড স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করুন।
প্রথমত ঃ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে জার্মানিতে হিটলার বিজ্ঞানী, সমাজ বিজ্ঞানী ও প্রকৃতি বিজ্ঞানীসহ শতসহস্র ইহুদিকে নিষ্ঠুরভাবে গ্যাস চেম্বারে পুড়িয়ে হত্যা করায় মানুষের মধ্যে ইহুদিদের প্রতি সহানুভুতির সৃষ্টি হয়েছিল। বিজ্ঞানী ও পণ্ডিতজনদের হত্যা করায় মানবজাতি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বটে। তবে সেটাকে পুঁজি করে অস্ত্রের জোরে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের অভিবাসন নিশ্চিত করা হয়। ১৯১৮ সালে ‘বেলফুর’ ঘোষণায় ইহুদিদের একটি বাসস্থানের প্রয়োজনীয়তারও তাগিদ দেয়া হয়েছিল।
দ্বিতীয়ত ঃ তৎপরবর্তীতে ৭৬ বছর ধরে দিন দিন ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্ভোগ ও দুর্গতি বেড়েই চলেছে। তবে আশার দিক হলো তাঁরা নিজ ভূমি উদ্ধার ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন। পক্ষান্তরে ইসরাইল প্রথমদিকে বিচারহীনভাবে মুসলমানদের উপর নির্মম নির্যাতন চালানোর মধ্য দিয়ে সম্প্রসারণবাদী ভূমিকা পালন করায় মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো একাধিক যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের সাথে যোগ দিয়েছিল। মার্কিনের প্রত্যক্ষ সামরিক হস্তক্ষেপে ৮০ দশকের প্রথম দিকে ফিলিস্তিনি জনগণের মুক্তি সংগ্রাম বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। বরং এক পর্যায়ে ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের ক্ষুদে বুর্জোয়া নেতৃত্ব মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রস্তাবে আপস করতে বাধ্য হন। যারা ধারাবাহিকতায় বর্তমান মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমতীর। অর্থাৎ ফ্যাসিস্ট ইসরাইল রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যবাদীরা গাজা ও পশ্চিমতীর- এ দুটো স্বল্প পরিসরের জায়গায় ফিলিস্তিন জনগণকে বিভক্ত করে ফেলে। এটাই গোড়ায় গলদের প্রায়শ্চিত্ত।
চলমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পাশাপাশি ইসরাইল-ফিলিস্তিনি যুদ্ধ, ইসরাইল ও ফিলিস্তিন হামাস বাহিনীর যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের দেশে দেশে ইতিমধ্যে গাজা উপত্যকা ইসরাইলী বিমান হামলায় মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে এবং হাসপাতাল, মসজিদ, গির্জা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ ইসরাইলী বিমান হামলায় বোমা বিস্ফোরণে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হতে যাচ্ছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইসরাইলী হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর হচ্ছে এবং যার যতটা সম্ভব সাহায্য সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যে চিকিৎসা সামগ্রীসহ ত্রাণসামগ্রী পাঠিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে অতি সংক্ষেপে হলেও বিশ্ব পরিস্থিতি এবং ইসরাইলের আগ্রাসন ও ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব ভূমি উদ্ধারসহ রক্ষায় ইসরাইলের অভ্যন্তরে ঢুকে আক্রমণ করার মধ্য দিয়ে সৃষ্ট যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা ও করণীয় বিষয়ের প্রতি প্রথমে আলোকপাত করা প্রয়োজন বোধ করছি।
বিশ্ব পরিস্থিতি ঃ সাম্রাজ্যবাদ মানেই যুদ্ধ আর যুুদ্ধ মানেই ধ্বংস। ইতিহাসের স্বাক্ষ্য মতে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল। বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকা হাইড্রোজেন ও নাইট্রোজেন বোমা মেরে জাপান সাম্রাজ্যবাদের হিরোসীমা ও নাগসীমা ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে শক্তিতে বলিয়ান হয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের সামনে আসে মার্কিন স্রামাজ্যবাদ। অতঃপর মার্কিনের এক বিশ্ব অর্থনীতিকে গ্রহন করা সাম্রাজ্যবাদী দেশ সমূহের ঐক্যবদ্ধ শক্তির উপর নির্ভর করে বিশ্বব্যাপী একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় মনোনিবেশ করে মার্কিন।
আরেক দিকে, মহান লেনিনের নেতৃত্বে ও মার্কসবাদ ভিত্তিতে সোভিয়েত রাশিয়া সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত রাশিয়া ব্রেজনেভ-কোসিগিনের নেতৃত্বে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার মধ্য দিয়ে রাশিয়া সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হয়। ভেঙ্গে যায় সোভিয়েত।
এদিকে সামজতান্ত্রিক চীনে কমরেড মাওসেতুঙ-এর মৃত্যুর পর ক্যুদেতার মাধ্যমে মহান সর্বহারা সাংষ্কৃতিক বিপ্লবের পরাজিত শক্তি চীনের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্রটি পুঁজিবাদের পথ অনুসরণ করে এবং চীনা রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে সমাজতান্ত্রিক সকল অর্জনগুলোকে ধ্বংস করে সাম্রাজ্যবাদী বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জন রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিমালকানার পুুঁজির বিকাশের মধ্য দিয়ে বিশ্ববাজারে অন্য সকল সাম্রাজ্যবাদকে অতিক্রম করে মার্কিনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।
মার্কিন-চীন দ্বন্দ্ব এখন আর নিছক বাণিজ্য যুদ্ধের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সেহেতু বিশ্ববাজার নিয়ন্ত্রণ ও পুনর্বন্টনের লক্ষ্যে দেশে দেশে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের পক্রিয়া শুরু করেছে। আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে রাশিয়া সাম্রাজ্যবাদের সাথে চীনের দ্বন্দ্ব থাকলেও বর্তমানে গৌণ হয়েছে অর্থাৎ এ মূহুর্তে নেই বরং পক্ষে। যেমন রাশিয়া-ইউক্রন যুদ্ধে ইউক্রেনের ঘাড়ে বন্দুক রেখে তার পক্ষে, তার সাথে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী শক্তিসমূহ।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে বিশ্বে নানা ক্ষেত্রে সংকট দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনি হামাসের মধ্যেকার যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ার অবশ্যম্ভাবী সম্ভাবনা সত্বেও মার্কিনের মদদপুষ্ট ইসরাইল, হামাসের আক্রমণের বিরুদ্ধে বিমান হামলা করে ধ্বংসযজ্ঞের পরিণত করেও ক্ষান্ত হচ্ছে না, বরং গাজা উপত্যকাকে মৃত্যু পুরিতে পরিণত করেছে ও ফিলিস্তিনিদের গাজা ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ জারি করেছে এবং গাজা এখন মানবিক বিপর্যের মুখে।
এমনকি হাসপাতাল, মসজিদ, গির্জা ও আবাসস্থলে গোলাবর্ষণ করে নিরাপরাধ শিশু ও নারীসহ হাজার হাজার মানুষ হত্যা করে চলেছে। যেখানে ঔষধ, খাদ্যসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও কাফনের কাপড়ের সংকট দেখা দিয়েছে। বোমা বিস্ফোরণের হাত থেকে রক্ষায় মানুষ দিক-বেদিক ছুটেছেন। আর ইসরাইলীরা পরিত্যক্ত ও ধ্বংস হওয়া এবং উচ্ছেদ করা স্থান ইসরাইলীদের দখলে নিচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ এ পরিস্থিতিতে মার্কিন ও তার পক্ষ ইসরাইলের পক্ষে এবং ইরানও হামাসের সহায়তায় এগিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। সে পরিস্থিতিতে বিশ্বযুদ্ধ দরজায় যেন কড়া নাড়ছে। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে সেভাবে ছড়িয়ে পড়লে চীন-রাশিয়া তাদেরই পক্ষ অবলম্বন করবে।

এদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আকস্মিকভাবে ইতিপূর্বে ইসরাইল সফরে গিয়েছিলেন এবং তার প্রতিনিধিরা যাচ্ছেন ও যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে সহযোগীতা করছে ইসরাইলকে। এতে করে ইসরাইল ব্যাপক উদ্দিপনা নিয়ে স্থল পথে আক্রমণের জন্য ট্যাংকসহ অত্যাধুনিক মারনাস্ত্রে সজ্জিত। হাজারো সেনাবাহিনী গাজা সীমান্তের অন্যপাশে ইসরাইল অংশের ছোট ছোট শহর, মাঠ আর শস্যক্ষেতে সমবেত করা হয়েছে কিছু সংখ্যক আক্রমণও করছে বলে গণমাধ্যম সহ নানা মাধ্যমে জানা গেছে। সেহেতু নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আইসিসির গ্রেফতারি পরোয়ানা সত্বেও যুদ্ধ থামেনি এবং থামছে না।
অপরদিকে ইরান স্পষ্ট হুমকি দিয়ে বলেছে, গাজায় ইসরাইল যে ঘৃণ্য হামলা চালাচ্ছে তার যথাযথ উত্তর দেওয়া হবে। ইরান মহড়া দিয়েছে। ইসরাইলে পাল্টা আঘাত হেনেছে। সূত্রে প্রকাশ, ইরান মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন শিয়া সশস্ত্র-গোষ্ঠিকে অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকছে, যাদের নিয়ন্ত্রণও ইরানের হাতে। তন্মধ্যে ইসরাইলের উত্তর সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থান করা লেবাননের হিজবুল্লাহ। যারা ২০০৬ সালে ইসরাইলের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে সফলই হয়েছিল। ২০২৪-এর এই সময়ে সর্বশেষ খবর মতে, আবারও হিজবুল্লাহ ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।
সবমিলে জানমালের ক্ষতিসহ ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির অর্থাৎ ধ্বংসের সম্ভাবনা বিদ্যমান। এক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী ও ব্যাপক ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের পরিণতি হবেÑএক, বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা এবং দ্বিতীয়ত ঃ সাম্রাজ্যবাদীদের অস্ত্র বেচা-কেনাসহ সার্বিক লাভবান হবে ও হচ্ছে। তাদেরই প্রাধান্যে জাতিসংঘ এবং আইসিসি। সেহেতু নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আইসিসির গ্রেফতারি পরোয়ানা সত্বেও যুদ্ধ থামেনি এবং থামছে না। পক্ষান্তরে ফিলিস্তিনিবাসীর প্রাণ যাবে ও সহায় সম্পত্তি ধ্বংস হবে। তৃতীয়ত ঃ সাম্রাজ্যবাদীদের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার হাসির খোরাক হবে এবং তারা তিরস্কৃত হবে। চতুর্থ ঃ বিশ্ব মহাসংকটে পড়বে।
সে প্রেক্ষিতে বিশ্বের দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে নতুন ধরণের জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে, যা সাম্রাজ্যবাদকেই ধ্বংস করবে। এ পরিস্থিতিতে করণীয় কি? তার আগে বলে নেয়া দরকার, সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় সাম্রাজ্যবাদীরা যুদ্ধ ব্যতিরেকে কিভাবে আধিপত্য বিস্তার করে ও বাজার দখল করে। তাদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়াতে আওয়াজ তুলতে হবে ‘মুসলিম-ইহুদিসহ সকল জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তুলুন, সাম্রাজ্যবাদমুক্ত ধর্ম নিরপেক্ষ অখণ্ড স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করুন।
ইতিমধ্যেই অতিসংক্ষেপে হলেও আলোচিত হয়েছে যে, বিশ্ব বাজার নিয়ন্ত্রণ ও পুনর্বন্টনের লক্ষ্যে দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদীরা সে সব দেশের শাসক শ্রেনী ও আমলাদের দালালে পরিণত করে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়া শুরু করে সফলতা অজর্নত করছে। ফলে দু’দশক আগে থেকে শুরু করা মার্কিনের নেতৃত্বে আগ্রাসন ও ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এখন গতিপথ পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। কারণ এই যুদ্ধের অর্জনে এখন আর মার্কিনের এক চেটিয়া নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব নয়।
চীন ও রুশ সাম্রাজ্যবাদ হস্তক্ষেপ করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ২০১২ সালের ইউরোপ সফর ও জি-৭ এর সভায় চীনকে প্রতিরোধ ও মোকাবিলার ঘোষণা করেছে। চীনও বলেছে এখন আর সেদিন নেই, গুটি কয়েক দেশের সিদ্ধান্তে যে কোন দেশের ওপর আক্রমণ চালানোর। ১ জুলাই’ ২১ বেইজিংয়ের তিয়েন আনমেন স্কয়ারে চীনের তথাকথিত কমিউনিস্ট পার্টির শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বলেছেনÑ কোনো বিদেশী শক্তি চীনকে দমন করতে চাইলে নিদারুণ পরিণতি ভোগ করতে হবে।
সাম্রাজ্যবাদীরা শাসক শ্রেণীর ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রাম ও রাষ্ট্রক্ষমতা দখল এখন এই, না হয় ওই, সাম্রাজ্যবাদের কবলে পড়ছে। আর সাম্রাজ্যবাদীরা এই আন্দোলনকে কোথাও দ্বিরাষ্ট্র, কোথাও সামরিক শাসন, কোথাও গণতন্ত্রের নামে সংসদীয় স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সমাধান করছে। পক্ষান্তরে নিপীড়িত জাতি-জনগণ জীবন ও জীবিকার লড়াই করে চলছেন। মুক্তির পথ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনিদের ঘিরে বিশ্বযুদ্ধ ঠেকাতে আসুন একযোগে বলি মুসলিম-ইহুদিসহ সকল জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তুলন; সাম্রাজ্যবাদমুক্ত ধর্ম নিরপেক্ষ অখণ্ড স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করুন। বিশ্বশান্তি কায়েম করুন।
আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ ও নয়া উপনিবেশিক দেশ সমূহে নীচু মাত্রার যুদ্ধ পরিচালনার নীতির কারণে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আকারে প্রকাশিত না হলেও রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোতে ফ্যাসিবাদ বিকাশ লাভ করছে। বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বের মহড়াও চলছে। এ পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপে নয়, সাম্রাজ্যবাদমুক্ত ধর্ম নিরপেক্ষ অখণ্ড স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিম-ইহুদিসহ সকল জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তোলা অপিরিহার্য হয়ে পড়েছে। এ জন্য মানবাধিকার-গণতন্ত্র-স্বাধীনতা ও ‘মানুষ’ সৃষ্টির সেরা কারণেই ‘মানুষ মানুষের জন্য’ বিশ্বাসী বিবেকবানদের দখলদার ইসরাইলীদের হাত থেকে ফিলিস্তিনিদের ও তাঁদের ভূমি মুক্ত করতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। নয়তো গাজার লাশের গন্ধের ভারি বাতাস বিশ্বকে বিশ্বযুদ্ধে ঠেলে দিবে, যদি যুদ্ধ বন্ধ না করতে পারেন। ইতিহাসের স্বাক্ষ্য বিশ্বযুদ্ধ ঠেকাতে পারে বিশ্ব জনগণ এবং তাঁদের ঐক্যবদ্ধ শক্তি।

প্রধান সম্পাদক, গণপ্রহরী