Sat. Jul 12th, 2025
বিশ্বের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ট্রাম্পের অভিযানডোনাল্ড ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু। ছবি : সংগৃহীত

বিশ্বের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ট্রাম্পের অভিযান। যে অভিযানের শেষ পরিণতি কি হবে; অথবা শেষ পর্যন্ত এই অভিযান তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে গড়াবে কি-না; তা ভাবার সময় নেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের। যদিও তাঁর দল রিপাবলিকান পাটিতে ফিলিস্তিনের গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার ক্ষেত্রে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় বইছে। অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোও কড়া নজর রাখছে ট্রাম্পের অভিযানের প্রতি। কিন্তু যুদ্ধবাজ জেনারেলদের চেয়েও তিনি নিজেকে বেশী দক্ষ মনে করেন। তাই তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় (!) এখন ট্রাম্পকে নির্বাচিত করা মার্কিনের ভোটার জনগণ এবং বিশ্বজনগণের ভাবার বিষয়।

তবে, যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকার ভোটার জনগণের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, তাঁরা হয়তো তাঁদের (ভোটারদের) চিন্তা-চেতনায় ও জাতীয়-আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ডেমোক্রাটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট বাইডেন-প্রশাসনের ব্যর্থতাকে কেন্দ্র করে, ট্রাম্পকে নির্র্বাচিত করেছেন। সে নিয়ে আমাদের বক্তব্য নয়। আমাদের বক্তব্য-‘বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের মানুষের কল্যাণে ও বিশ্ব শান্তির জন্য। রাষ্ট্রগুলোর জনগণ নিজস্ব চেতনায় ও দ্বান্দ্বিক বিশ্লেষণে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে যুদ্ধমুক্ত, আধিপত্যমুক্ত বিশ্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগিয়ে যাবেন। কেননা, ‘মানুষ’ মানুষের জন্য। আর ‘বিশ্ব’ মানুষেরই জন্য।

ইতিহাসের শিক্ষায় ও বাস্তবতার আলোকে আমাদের সহজ সরল বক্তব্য-‘সাম্রাজ্যবাদ মানেই যুদ্ধ, আর যুদ্ধ মানেই ধ্বংস’। তারপরও সাম্রাজ্যবাদকে সাম্রাজ্য বিস্তারে ও আধিপত্য বিস্তারে (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কৌশল পরিবর্তনের মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তারকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে) এবং বাজার দখলে বিশ্বের ছোট ও মাঝারি দেশগুলোকে টার্গেট করে আসছে। টার্গেট (লক্ষ্য) অনুসারে, কূটকৌশলী পরিকল্পনা মতে স্বার্থ উদ্ধারে এবং বিশ্বের সামনে নিজেদের গণতন্ত্রী, মানবদরদী ও বিশ্বের সকল দেশের ও বিশ্ব জনগণের কল্যাণকামী প্রমাণে, দাতা ও ঋণ সহায়তার ভূমিকা পালন করে আসছে। সেই সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র ভিত্তিতেই বিশ্বের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ট্রাম্পের অভিযান।

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এবং শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের পরিস্থিতিতে বিশ্ব যেমন নেই। তেমনি চিন্তা-চেতনা, দেশাত্ববোধ ও দেশপ্রেম দিন যত যাচ্ছে তত জাগ্রত হচ্ছে, দৃঢ় হচ্ছে। একইভাবে সর্বক্ষেত্রে পরিবর্তন আসছে এবং মানুষ নতুনকে বরণও করছেন। সেদিক থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (হিরোসীমা ও নাগাসীমা ধ্বংস করা) মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদ হিসেবে আত্মপ্রকাশকারী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকা এগিয়ে চলছে। এ লেখার বর্তমান সময়কালে বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সমূহের মধ্যে পরীক্ষিতভাবে (যুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত) প্রথম স্থানে। এমনকি “যুদ্ধাস্ত্র বিক্রি করে অর্থ উপার্জনসহ এবং যুদ্ধ বাঁধাতে অনুপ্রাণিত-উজ্জীবিত করতে, যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী করে বাজার দখলের কূটকৌশলেও প্রথম স্থান দখলকারি। এ কারণে বিশ্বের প্রগতিশীল দেশপ্রেমিক ও শান্তিকামী বিশ্ববাসীর কাছে সাম্রাজ্যবাদীদের মধ্যে ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদই’ বিশ্বের জানি দুষমন হিসেবে বিবেচিত। তারও স্বাক্ষ্য দিচ্ছে ফিলিস্তিনিদের অন্য দেশে স্থানান্তর ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নেতৃত্ব (প্রকারন্তরে কর্তৃত্ব) দাবি উত্থাপনকারি ট্রাম্প।

বিজ্ঞান প্রযুক্তির বর্তমান যুগে অগ্রসর প্রযুক্তির কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকাবাসী বিশ্বের কোথায় কখন কি ঘটেছে ও ঘটছে তা অবগত। সেই সাথে সাম্রাজ্যবাদের ভূমিকা প্রাসঙ্গিক উপরে আলোচিত কথাগুলো থেকেও জেনেছেন এবং ‘মানুষ, মানুষের জন্য’- এ সত্য উপলব্ধি থেকে যারা মনবতাবোধ সম্পন্ন তাঁরা নিশ্চয়ই একমতও হবেন। একমত হতেই হবে। কারণ, বাস্তবতার নিরিখে বিবেচ্য, বিশ্বের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে (কখনও বেশি, কখনও কম) শীতল যুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে ও হচ্ছে, সাম্রাজ্যবাদীরা অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বে লিপ্ত। এবং তা আধিপত্য বিস্তার ও বাজার দখলের জন্য। এসব যুদ্ধে নিহত-আহত হচ্ছেন মূলত: সাধারণ মানুষ এবং সম্পদও ধ্বংস হচ্ছে। বিশ্বের মানুষ জীবন দিয়ে তা উপলব্ধি করছেন।

এতে সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ এবং বিভিন্ন দেশে-(রাষ্ট্রে) থাকা তাদের দালাল সামন্ত-আমলা-মুৎসদ্দি-পুঁজির বিরুদ্ধে জনগণের চেতনা শানিত হচ্ছে, ক্ষুব্ধ হচ্ছেন জনগণ। এক সময় জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংসের আওয়াজ তুলে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন। ইতিহাস বলছে-‘যেখানে অত্যাচার সেখানেই প্রতিরোধ’। এছাড়া, শক্তিতে পিছিয়ে থাকা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ এক এক করে মার্কিন বিরোধী বিশ্ববাসীর সংগ্রামেই, বদলা নিতে সমর্থন-সহযোগীতার ভূমিকা নিতে পারে। তাই সময় থাকতে, ‘মানবতাবোধ সম্পন্ন শান্তিকামী যুক্তরাষ্ট্রবাসীকে এখনই ট্রাম্পের লাগাম টেনে ধরতে হবে’।

অন্যথায়, সার্বিক পরিস্থিতিতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে রূপ নিতে পারে। যে যুদ্ধ হবে ভয়াবহ। যা, বিশ্বের জন্য হবে মারাত্মক হুমকি। যদিও চীন বিপ্লবের মহানায়ক-চীনের চেয়ারম্যান মাও সেতুঙ এর কথার সূত্রে বলা যায়, ‘বিশ্ব জনগণই পারেন বিশ্বযুদ্ধকে ঠেকাতে বা মোকাবিলা করতে’।

বিশ্বের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ট্রাম্পের অভিযান বিষয়ক উপরোক্ত আলোচনা ট্রাম্পের কাছে বিবেচ্য নয়। কারণ ক্ষমতার ভার-ই বইতে অপারগ। কেননা, বিশ্বের একক কর্তৃত্বের প্রথম ধাপ ধরে নিয়েছেন, যুদ্ধের নামে গণহত্যাকারি ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট নেতানিয়াহু গাজা দখলের পর, মার্কিনকে দিয়ে দেয়ার কথাকে ধরে নিয়ে মাতোয়ারা হয়েছেন। এছাড়া তাঁর মেয়ে জামাতা সেখানকার দায়িত্ব পাবেন ট্রাম্পের মার্কিন এবং তাতে তাঁর ও তাঁর মেয়ে জামাতার স্বপ্ন পূরণ হবে, ইত্যাদি। মূলত; মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইতিহাস থেকে যেমন শিক্ষা নেয় না, তেমনি যুদ্ধ সম্পর্কে অনভিজ্ঞ, হয়েও জেনারেলদের চেয়ে অভিজ্ঞ দাবি করার মধ্য দিয়ে ভিত্তিহীন শান্তি পান।

ফিলিস্তিনে মার্কিন মদদপুষ্ট ইসরায়ের বাহিনীর অভিযান
ফিলিস্তিনে মার্কিন মদদপুষ্ট ইসরায়ের বাহিনীর অভিযান। ছবি : সংগৃহীত

কথায় আছে, ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’। ট্রাম্পের এখন ইতিহাসে প্রমাণিত এই সত্য উপলব্ধি করার ক্ষমতা আছে বলে মনে করিনা। ক্ষমতার মোহ গ্রস্থ ট্রাম্প বলেছিলেন, আমি যদি কখনও নির্বাচন করি, তা করবো রিপাবলিকান হিসেবে। কেননা, এ দলের সমর্থকরা দেশের সবচেয়ে বড় মূর্খ। আমি তা বলি না, বলছি না ও বলবোও না। কারণ, দলের এত মানুষকে ‘মুর্খ বলা’ হচ্ছে নির্বুদ্ধিতার সামিল।

এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকার নির্বাচনে ডেমোক্রাট প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উত্তরসূরি অনেক আলোচনার জন্মদাতা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচিত হওয়ার পর বিশ্লেষকরা যথাযথ মতামত প্রকাশ করতে যেন দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছিলেন। তার মধ্যেও লেখা অব্যাহত ছিল। আমি ফেব্রুয়ারিতে ‘মার্কিন প্রেসিডেন্টকে নিয়ে পণ্ডিতরাও কূল কিনারা পাচ্ছেন না’-শিরোনামে সাধারণ জ্ঞানে একটি লেখা লিখেছিলাম।

দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হয়েই বাণিজ্যযুদ্ধকে চাঙ্গা করেছেন। গাজা দখলের ইসরাইলকে সরাসরি নির্দেশ দিয়ে ফিলিস্তিনিদের অন্য দেশে স্থানান্তরের চেষ্টা করছেন এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নেতৃত্ব চেয়েছেন। সবমিলে, আমার মনে হচ্ছে-২০১৭ সালে ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিয়ে পণ্ডিতরাও কূলকিনারা পাচ্ছেন না’ শীর্ষক লেখাটি পাঠকের চিন্তা চেতনায় সহায়ক হবে বিবেচনায় হুবহু তুলে ধরছি। আশা করি পাঠকদের ভালো লাগবে। তাতে কৃতজ্ঞ হবো, পাঠকদের প্রতি। বিশ্ব শান্তির স্বার্থে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার চাওয়া-পাওয়ার পরিকল্পনা পরিবর্তন করবেন-এ আশাবাদ থাকছে। এবার লেখাটি তুলে ধরছি-

মার্কিন প্রেসিডেন্টকে নিয়ে বিশ্বের পণ্ডিতরাও কূল-কিনারা পাচ্ছেন না

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকা শব্দ তিনটি প্রচলিত। কেউ মার্কিন বলেন। কেউ যুক্তরাষ্ট্র বলেন। কেউ আমেরিকাও বলেন। এটা সাধারণত: আমার মত সাধারণ মানুষরাই বলে থাকেন। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গণে বিচরণ করেন বা রাজনীতি ও দেশ নিয়ে কিছু না কিছু ভাবেন, লেখালেখি করেন, আলোচনা-পর্যালোচনা করেন। এমন সাধারনদেরই আমাকে একজন মনে করি। আমরা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী বললেই উল্লেখিত তিন শব্দে পরিচিত দেশটিকেই বুঝি। এ নিয়ে আমাদের মাঝে বহুল আলোচিত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে আমি বলেই থাকি ও লিখেও থাকি যে, বিশ্বের জানি দুশমন-‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’। আবার সেই সাম্রাজ্যবাদী দেশটি অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের ‘নেতা দেশ’। এমন দেশের প্রেসিডেন্ট (রাষ্ট্রপতি) ডোনাল্ড ট্রাম্পকে লেখার ভূমিকায়ই লিখছিনা যে, ‘যেমন দেশ তেমন নেতা’।

তবে, আলোচনার এক পর্যায় লিখতে হবে ও লিখবো এ মুহূর্তে শুধু এটুকু বলে নিতে পারি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং নির্বাচিত উদ্ভট প্রেসিডেন্টের শাসন গর্জনসহ বিভিন্ন বিষয়ে মন্তব্যও আজকে পর্যন্ত সময়ের ভূমিকা নিয়ে; যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বে আলোচনা-পর্যালোচনা করে কিনারায় পৌছতে পারছেন না, খ্যাতনামা কূটনীতিক- রাজনৈতিক ব্যক্তিরা। এবং জ্ঞানী-মহাজ্ঞানী পন্ডিতেরা। সেক্ষেত্রে আমার মত মানুষকে আমাদের মত মানুষের জন্য লিখতে একটু বেগ পেতে হচ্ছে বলেই ভূমিকায়ই অনেক কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে হচ্ছে। এছাড়া আমাদের দেশসহ বিভিন্ন দেশের পন্ডিতজনরা প্রতিনিয়তই লিখছেন, বলছেন তাতে অনেকের অনেক মতামত ও উদ্বৃত কথাবার্তার মিলও খুঁজে পাওয়া যায়, যাচ্ছে ও যাবে এটাই স্বাভাবিক ।

সম্মানিত পাঠক, আমরা কমবেশী সবাই অতীতের দিকে হাল্কাভাবে মনযোগ দিলেই দেখি ও দেখবো যে-রাষ্ট্রীয় জীবন ব্যবস্থায় আমেরিকান সমাজকে এত বছর ধরে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান এই দুই শিবিরে বিভক্ত করেই বুর্জোয়া শাসক শ্রেণী শাসন- শোষণ করে চলে আসছিল। আর এজন্য নির্বাচনী যন্ত্রটাকে ব্যবহারে ‘পরিবর্তন’ শব্দটিকে হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগিয়ে আসছে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে এসব বুর্জোয়া নির্বাচনে জনগণের স্বার্থতো দূরের কথা মৌলিক কোন পরিবর্তন ঘটে না ও ঘটেনি।

প্রসঙ্গত: বিশ্বের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ট্রাম্পের অভিযান প্রাসঙ্গিক আজকের এই উপবিষয়ক (সাব হেড) লেখার ‘অনেক আলোচনা-সমালোচনার জন্মদাতা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প’ নিয়ে আলোচনা।

একটা বিষয় নিশ্চিত যে, দু’পক্ষই (দুটি দল) দেশের বিশাল বড় ধনীদের শাসন (রাজত্ব) বহাল রেখে আসছে ও থাকবে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে বলে মনে করি না। দেখি আট বছর আগে ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী ওবামাও পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েই নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু আমেরিকার জনগণের উদাহরণ দেয়ার মত তেমন কোন পরিবর্তন হয়েছে বলে আমার জানা নেই।

মূলত: ‘পরিবর্তন’ হচ্ছে বুর্জোয়া নির্বাচনে জয়ী হওয়ার একটা কৌশল মাত্র। ওবামা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং ট্রাম্পও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। জনগণের যা হবার তাই হবে। অর্থাৎ জনগণ যেখানে ছিলেন সেখানেই ঘুরতে থাকবেন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শাসক শ্রেণী ভুলে গেছে যে, পৃথিবীও ঘুরছে এবং তাতে দিন-রাত হচ্ছে। ঘুরতে ঘুরতে কিন্তু একদিন জনগণের মুখোমুখি হতে হবে। তারপরও নড়াচড়া করলে যেটুকু যা-ই পচ্ছেন, সেটাও হারানোর সম্ভাবনা থাকবে। কারণ আমার ধারণায়, শাসকগোষ্ঠি তার সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র মতে, একটু স্বাধীন ও আত্মনির্ভরশীলভাবে চলা বা চলার চেষ্টা করা-যে কোন ছোট-মাঝারী দেশে সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্ব, শোষণ-লুণ্ঠন, হত্যা-গণহত্যা, ষড়যন্ত্র-আগ্রাসন, লুটপাট, মিথ্যা প্রতারণা, অন্যায় যুদ্ধে পররাজ্য গ্রাস ও পরিবেশ ধ্বংসে নিয়োজিত করবে মার্কিন সেনাদের। এতে মার্কিন জনগণ আর নড়াচড়া করবে না ।

কারণ, যেটুকু যা পাচ্ছেন তাতো সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র পালনের মাধ্যমেই অর্জিত। তা সত্ত্বেও তাদের নিজ শ্রেণীর মাঝে একটা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থা বজায় ছিল। যার ভিত্তি এবারের নির্বাচনে ভেঙ্গে গেল। এটার স্বাক্ষী লাখ লাখ মানুষ নির্বাচনী ফলাফল মেনে না নিয়ে রাজপথ কাপালো ও কাঁপাচ্ছে আজও। ডেমোক্র্যাটদের অভিযুক্ত করার তেমন ফাঁক নেই। যার জন্য দায়ী করা হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। এবার দেখি উদ্ভট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে কি অভিযোগ এবং অভিযুক্ত করার মতই-বা কি করেছেন ও করছেন।

দেখাদেখির ক্ষেত্রে, প্রথম আলোর হাসান ফেরদৌসের খোলাচোখের একটি লেখার তথ্যসূত্র উল্লেখ করে লেখাটাই বেশী গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে করি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেরা ভাষ্যকারদের মধ্যে হেনরি লুইস মেঞ্চেন ১৯২০ সালে উদ্বেগ প্রকাশ করে লিখেছিলেন, একটা সময় আসবে, যখন দেশের সাধারণ মানুষ তাদের পছন্দমত এমন একজন নেতাকে হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচন করবে, যে শুধু আস্ত বোকাই (গবেট) নয়, রীতিমত গর্দভ হবে।

ষোলোর নির্বাচনে আমেরিকার সাধারণ মানুষ ১৯২০ সালে ভাষ্যকার ‘মেঞ্চেনের ভাষ্যের সত্যতা’ প্রমাণ করলেন; সাম্রাজ্যবাদী- পুঁজিবাদী বিশ্বের শিরোমনি আমেরিকার অন্যতম সেরা ধনী উদ্ভট ট্রাম্পকে নির্বাচিত করে। যা বুর্জোয়া গণতন্ত্রের আকাশে, সেই ট্রাম্পের ঘাড়ে বসে বুর্জোয়া ফ্যাসিবাদের আগমন ঘটলো।

এখানে আমাদের মত মানুষের বোঝার সুবিধার্তে বলে রাখা ভাল যে, ১৯৯৮ সালে এই গর্দভ লোকটি (ট্রাম্প) পিপল সাময়িকীকে বলেছিলেন, ‘আমি যদি কখনও নির্বাচন করি, তাহলে অবশ্যই তা করবো একজন রিপাবলিকান হিসেবে। কারণ হিসেবে এই নির্লজ্জ লোকটি বলেছিলেন, এই রিপাবলিকান দলের সমর্থকেরা এই দেশের সবচেয়ে মূর্খ। এছাড়া ‘ফক্স নিউজ’ যে কথা বলে, তারা তা-ই বিশ্বাস করে। আরো বলেছেন, আমি হড়বড় করে যত মিথ্যা কথাই বলি তারা তা বিশ্বাস করবে’। যে কারণে তিনি নিশ্চিত ছিলেন নির্বাচনে তিনি বিজয়ী হবেন। সত্যি সত্যি হয়েছেনও তাই। নির্লজ্জ এই লোকটি বেহায়াও বটে।

তা-না হলে, নিজেকে মস্ত তারকা দাবী করে বলতে পারে কি, যখন তখন সে মেয়েদের গায়ে হাত দিতে পারে, তাতে কোন সমস্যা হয় না। বিবেকসম্পন্ন কোন সুস্থ্য মানুষ এমন কথা বলতে পারে না। কারণ মেয়ে বা নারী অর্থই যেমন স্ত্রী, তার আগে নারী মানেই মা, মেয়ে, বোন, ফুফু, খালা, চাচী এবং নানী ও দাদী (মা এর মা ও বাবার মা)। এ কথাতেই শেষ নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প এ দাবীও করেছে যে, তিনি জেনারেল না হলেও তিনি জেনারেলদের চেয়েও বেশী যুদ্ধ জানেন। একইভাবে কখনো কোন বই না পড়েই সবার চেয়ে বেশী জানার দাবীও তার। সর্বজান্তা- সর্ববোদ্ধা ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হবেন এ বিশ্বাস তার ছিল।

যদিও নির্বাচনী সভা- সমাবেশে প্রকাশ্যে এবং ফেসবুকের মাধ্যমে মুসলমানদের বলেছেন ‘সন্ত্রাসী, হিস্পানিকদের ঢালাওভাবে বলেছেন ধর্ষক ও মাদক ব্যবসায়ী এবং আফ্রিকান আমেরিকানদের বলেছেন ব্যর্থ মানুষের দল। সেই সাথে এও বলেছেন, আমেরিকা এক পরাজিত ও দুর্দশাগ্রস্থ দেশ’। একমাত্র তিনিই পারেন, দেশটিকে তার পুরোনো গৌরব ফিরিয়ে দিতে। তিনি ক্ষমতাসীন হওয়ার পরদিন, ‘ওবামা কেয়ার’ নামের স্বাস্থ্য বীমা আইন বাতিল করে নতুন আইন চালু করবেন, হিলারী ক্লিনটনের অপরাধ তদন্তে নতুন তদন্তকারী নিয়োগ করবেন, অবৈধ অভিবাসীদের বহিষ্কার করবেন, মেক্সিকোর সাথে দেয়াল নির্মাণ কাজ শুরু করবেন।

অপরদিকে, অধিকাংশ বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করবেন । ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তি নাকচ করবেন এবং জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তির প্রতি মার্কিন সমর্থন প্রত্যাহার করবেন। সুপ্রীমকোর্টে একজন রক্ষণশীল বিচারক নিয়োগ করবেন। এসব প্রতিশ্রুতি মানুষের মনের ভীতকে উসকে দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হলেও ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সেসব থেকে পিছু হটার পথে। সে পথেই তিনি থাকতে থাকতে আমরা হিলারীকে ডেমোক্র্যাটদের প্রার্থী নির্বাচনে মনোনীত করা এবং বিজয়ী হওয়ার আশাবাদের মূলে সমস্যাটা কোথায় সেদিকের দু’চারটা বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করি।

এক্ষেত্রে ছোট্ট নির্বাচনী হিসাব-নিকাশের তুলনাটা করেও লাভ নেই। তাহলে আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারা অন্ততঃ কিছুটা বুঝে নিতে পারবো। আমাদের বোঝাবুঝিতো মার্কিনের উপর কোন প্রভাব ফেলবে না। আমাদের দেশের শাসক শ্রেণীরও কোন যায় আসে না । এমনকি সমর্থন বা বিরোধীতার প্রশ্নও আসে না। তবে শাসক শ্রেণীর সেবাদাসের ভূমিকা পালনকারীদের দু’চারজনে ধিক্কার জানাতে পারেন মাত্র।

যদিও শাসক শ্রেণীর প্রভূ শক্তি সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদ। যারা সবসময় যে কোন ক্ষেত্রে ‘বাম গন্ধ পেলেই বন্দুকের নল সেদিকে’। এ কাজটা আবার শুরু যে যে দেশে বা সমাজে গন্ধ পাবেন, সেদিকেই নল ঘুরাতে নির্দেশ দিবেন, সেই দেশের সেবাদাস সরকারকে। এভাবেই মিথ্যা অজুহাতে অন্যায়ভাবে আগ্রাসন, সিরিয়ায় অসামরিক জনগণকে বোমা মেরে হত্যা। ওবামা প্রশাসনের চার বছর এই গণতন্ত্রীরাই পৃথিবীর বহু জায়গায় ও দেশে যুদ্ধ বাঁধিয়েছে। এখন আমরা হিলারীর দিকে দেখি। হিলারী নির্বাচিত হলেও বুর্জোয়া-স্বর্গ আমেরিকা জনগণের স্বর্গ হতো না ।

পর পর দু’বার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট ওবামার কথা দিয়ে শুরু করি-হিলারীকে নিয়ে কিছু কিছু কথা হিলারী ক্লিন্টনকে নিয়ে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছিলেন, তার মত এমন অভিজ্ঞ ও যোগ্য প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী আগে কখনো দেখা যায়নি। এতো গেল নিজ দলের ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ওবামার কথা। মিডিয়া প্রচার, জরিপ ও বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদীদের প্রধান অংশটির আকাঙ্খা, এমনকি রিপাবলিকান শিবিরের শীর্ষস্তরে আংশিক বিদ্রোহ থেকেও ধারণা করা হয়েছিল যে, শাসক শ্রেণীর বেশী অংশরই হিলারীর পক্ষে মদদ ছিল। এটা তার নির্বাচনী ফান্ড স্ফীতি থেকেও বোঝা যায়। যার প্রায় পুরোটারই যোগান দিয়েছে আমেরিকার ধনীরা।

কিন্তু বুর্জোয়া শাসক শ্রেণী বিশেষত বড় বড় ধনীরা অন্তত ৫০% ভাগ রিপাবলিকানদের পক্ষে। যার প্রমাণ হিসাবে বলা যায়, কেন শেষ মুহূর্তে এফ.বি.আই তাদের হিলারী বিরোধী তরুপের তাসটি চালতে পেরেছিল। কার্যত জনমতকে এই শাসক শ্রেণীই গঠন করে এবং পুরো একটি বছর ধরে প্রার্থী মনোনয়ন নির্বাচনী বিতর্ক ও প্রচারাভিযানে তারা তাদের পছন্দ মত জনগণকে প্রস্তুত করে, নিজেরাও নিজেদের শ্রেণীর জন্য সর্বাধিক উপযোগী সিদ্ধান্তটি নিয়ে থাকে। নির্বাচনী হিসাব-নিকাশে দেখা যায় কালো মানুষেরা হিলারীকে ভোট দিয়েছেন ৮৮% ভাগ। ল্যাটিনো আর এশিয়ানরাও প্রায় সেইরকমই করেছেন ৬৫% ভোট দিয়েছেন। সামগ্রিকভাবে নারীরা প্রায় ৬% বেশী ভোট দিয়েছেন হিলারীকে। এতে করে দেখা যায়, ভোটার গ্রুপগুলো প্রত্যাশিতভাবেই হিলারীকে ভোট দিয়েছেন।

এখানে আবারো বলে রাখা ভাল যে, ট্রাম্প সুস্পষ্টভাবে নারী, ল্যাটিনো, এশিয়ান বিশেষত মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছিল। তাদের জীবনে অনেক অনিশ্চয়তা ও আগাম বিপদের ইঙ্গিত করেছিল। কালোদের বিরুদ্ধেও তার বর্ণবাদী মনোভাব তবুও হিলারী পরাজিত হয়েছে। এমনকি পপুলার ভোটেও প্রায় সমান ভোট পেয়েছে ট্রাম্প। কারণ, ট্রাম্প সাদা মানুষের ভোট অন্তত ২০% ভাগ বেশী পেয়েছে ট্রাম্প ৫৯% ও হিলারী ৩৯% ভাগ যেখানে সাদা মানুষ আমেরিকার সমাজের প্রায় ৭০% ভাগ গঠন করে’ সেখানে অন্য গ্রুপগুলোর ভোট বিরাটভাবে কম পাবে জেনেও ট্রাম্প দৃঢ়ভাবে বিজয়ের আশা করেছে।

এক্ষেত্রে বলা যায়, বুর্জোয়া মিডিয়ার ব্যাপক পক্ষপাতিত্ব, বুর্জোয়া সুশীল বুদ্ধিজীবী ও জরিপকারী বিশেষজ্ঞদের সকল ভবিষ্যতবাণীকে মিথ্যা প্রমাণ করে হিলারী বিজয় অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু শাসক শ্রেণীর কট্টর ডেমোক্র্যাট বিরোধী অংশটির রয়েছে সাম্রাজ্যের পুনর্গঠনে ভিন্ন এজেন্ডা। এটার জন্ম হয়েছে মার্কিন শাসক শ্রেণীর বিগত কয়েক বছর ধরে চলা সংকট মোচনের বুর্জোয়া বিকল্প পথ হিসেবে। একদিকে খোদ মার্কিন সাধারণ জনগণের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতে ব্যর্থতা এবং দেশে ও বিদেশে মার্কিনের অপরিবর্তিত দমনমূলক ও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী ভূমিকা জনগণের একটা বড় অংশকে ডেমোক্র্যাটদের মন ভুলানো রাজনীতির প্রতি হতাশ করে তুলেছিল।

অপরদিকে, ১৯৯০ সালে সোভিয়েতের পতনের পর, যে একচ্ছত্র আধিপত্য বিশ্বপরিমন্ডলে তার স্থাপিত হয়েছিল তার অধোগতি, ইউরোপে ও মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষত ইউক্রেন সিরিয়া ও ইরানে সাম্রাজ্যবাদী প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়ার আক্রমণাত্মক ভূমিকা এবং অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে চীনের উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকার ‘এক নম্বর’ চরিত্র প্রশ্নের মুখে পড়তে থাকে। এমন অবস্থায় শাসক শ্রেণীর ‘ক্ষ্যাপাটে’ আক্রমণাত্মক অংশটি ফ্যাসিবাদের ‘স্লোগান’ জোরে তোলার যোগ্য এক ব্যক্তিত্বের খোঁজ পায় কুৎসিত চরিত্র, অসংস্কৃত ‘যৌন নিপীড়ক’ ধনকুবেরটি জনগণের বিক্ষুব্ধ ও পশ্চাদপদ অংশটিকে জয় করতে পেরেছে। এসব থেকে আমরা সারসংক্ষেপে বলতে পারি, আট বছর ক্ষমতায় থাকাকালে ডেমোক্র্যাটরা জনগণের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন করতে পারেনি।

তারপরও নারী, কালো মানুষ, ল্যাটিনো, এশিয়ান মুসলিমসহ অভিবাসী, সমকামী, ট্যাক্স পলিসি-এসব প্রশ্নে কিছু কিছু সংস্কারমূলক কর্মসূচী বা স্লোগান দ্বারা তাদেরকে টানার রাজনীতি ডেমোক্র্যাটদের হিলারীর ছিল। মিডিয়া প্রচার, জরিপও হিলারীসহ ডেমোক্রাটদের আশান্বিত করেছিল। বিপরীতে রিপাবলিকান বা জনগণকে তাদের পক্ষে টানার প্রক্রিয়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য উত্তম পন্থা ছিল জনগণের সকল প্রকার দুর্গতির জন্য ৮ বছর ক্ষমতায় থাকা ডেমোক্র্যাটকে দায়ী করা। এটা করলে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা যে দায়ী তাকে আড়াল করা যায়। পাশাপাশি ব্যবস্থাটিকে পুনর্গঠন করা যায় পুঁজিবাদেরই অনুকূলে। এ লক্ষ্যেই পরিবর্তনের স্লোগান তোলা। যা সাদা জনগণের চাওয়া। তাহলে চাওয়াটা ইতিবাচক।

একইভাবে নির্বাচন আমেরিকানদের যখন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে এফ.বি.আই হিলারীর বিরুদ্ধে যে ইমেইল কেলেঙ্কারীর অভিযোগ আনে, সেটা দোদুল্যমান ভোটারদের একটা অংশকে নিশ্চিতভাবেই হিলারী বিরোধী করে এবং আরেকটি অংশ ভোট না দেয়ার মানসিকতা গড়ে তোলে। নির্বাচনে মহেন্দ্রক্ষণে এমনটা না হলে অল্প ভোটের ব্যবধানে হিলারীই বিজয়ী হয়ে যেতো। কারণ কালো মানুষরা ৮৮% ভাগ হিলারীকে ভোট দিয়েছেন। ল্যাটিনো আর এশিয়ানরাও ৬৫% ভাগ ভোট দিয়েছেন। নারীরাও আশাপ্রদ ভোট না দিলেও ৬% ভাগ বেশী ভোট দিয়েছেন হিলারীকে।

সবমিলে বলা যায়, ভোটার গ্রুপগুলো প্রত্যাশিতভাবেই ভোট দিয়েছেন হিলারীকে। পপুলার ভোটে ট্রাম্প। স্বল্প ব্যবধানে ভোট পেয়েছেন। সাদা মানুষের ভোটের ক্ষেত্রে ট্রাম্পের পাওয়া ভোট ২০% ভাগ বেশী। ট্রাম্প ৫৯% ও হিলারী ৩৯%। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, রিপাবলিকানদের ‘পরিবর্তন’ প্রগতিশীল লক্ষ্যে নয়, বরং ফ্যাসিস্ট দ্বারা স্নাত। বেকারত্ব, দারিদ্র, গৃহহীনতা, নিপীড়িত জীবন ইত্যাদির জন্য ডেমোক্রাটদের দায়ী করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে ‘পুনরায় মহান’ বানানোর জন্য সংকটে আবর্তিত সাদা মানুষদের সামনে ‘মুলা’ ঝুলিয়েছেন। এতে সাদা চামড়ার হোক আর কালো চামড়ার হোক সাধারণ জনগণের ভাগ্যে উন্নয়ন ঘটবে কি। ট্রাম্পের দেয়া প্রতিশ্রুতি কতটা সাধারণ মানুষের স্বার্থে তা নিয়ে ভাবতে হবে-এখনই, কারণ ডেমোক্র্যাট সরকারকে যেসবের জন্য দায়ী করা হলো’ তার সবগুলোর সমাধান করে বিশ্বের সামনে তুলে ধরবেন মর্মে শপথ করে বলবেন কি ট্রাম্প? না, তা পারবেন না।

তবে উঁচু স্তরের সাদা মানুষদের জন্য দেয়া অর্থাৎ অভিবাসী, মুসলমান, ওবামার কিছু কর্মসূচী বাতিল করতে পারবেন। অথচ যেসব হুমকিমূলক প্রতিশ্রুতির ঘোষণা আকারে দাম্ভিকতার সাথে বলেছেন, তা কিন্তু মূলত …… ‘মূলা’ ছাড়া আর কিছু বলা যায় কি। না, কারণ ইতিহাস বলে, ফ্যাসিবাদ নিঃসন্দেহেই বুর্জোয়া/ পুঁজিবাদেরই একটি রূপ। কিন্তু জনগণেরও একটা অংশকে, কখনো এমনকি প্রধান অংশকে ফ্যাসিবাদে কুলষিত না করে ফ্যাসিবাদ এগুতে পারে না।

ইসরায়েলী হামলায় ধ্বংসস্তুপের নিচে লাশের সারি
ইসরায়েলী হামলায় ধ্বংসস্তুপের নিচে লাশের সারি। ছবি : সংগৃহীত

প্রসঙ্গত বলতে হচ্ছে যে, ট্রাম্পের আক্রমণাত্মক ও স্থূল অভিবাসী-মুসলিম নারী বিরোধী বক্তব্যগুলোকে কেউ পাগলামী-ক্ষাপাটে বলে যতই উপহাস করা হোক, বাস্তবে সেগুলো সুচিন্তিত স্লোগান। তবে প্রশ্ন আসে, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি আর নির্বাচিত হওয়ার পর সেসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারবে কি পারবে না, তা বলা এখনই সম্ভব নয়। এটা নির্ভর করবে ফ্যাসিবাদের পথে কতটা সে এগুতে পারবে বা শাসক শ্রেণীর প্রধান অংশ কতটা অনুমোদন করবে তার উপর নির্ভর করবে। তবে কিছুতো পরিবর্তন সে করবেই। কারণ কথাগুলো নিছক কথার কথা নয়।

আমরা দেখে আসছি আমেরিকার সমাজকে, বিশেষত একদিকে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের সংকটকে মোকাবেলার জন্য তাদের প্রধান অংশকে এবং অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাদা জনগণ, বিশেষত তার নীচু অংশটিকে ফ্যাসিবাদের মতাদর্শে আরো বেশী করে সজ্জিত করে যে তুলবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমেরিকার সমাজে নিশ্চয়ই এর নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিবে। যার প্রভাব পড়বে সারা বিশ্বে। এর কারণ আমেরিকা এখনো প্রধানতম বিশ্ব শক্তি।

ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় যে, জার্মানীর প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর বুর্জোয়া সংকটকে মোকাবিলায় হিটলার ইহুদী বিরোধী হিস্টিরিয়া তুলে সে জনপ্রিয় হয়েছিল এবং নির্বাচনে বিজয়ী হয়েই ক্ষতায় গিয়েছিল। বুর্জোয়া সংকট তাকে সেই পথকে বিকশিত করতে বাধ্য করেছিল ইহুদি নিধনে যেতে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেতে। এতে শেষ পর্যন্ত নিজ স্বার্থমত তা না পারলেও পুরো সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বকে পুনর্গঠনে ভূমিকা রেখেছে। মার্কিন সমাজ, তথা সমগ্র সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী বিশ্ব সেরকম এক সন্ধিক্ষণেই রয়েছে। আমরা বলছি না ট্রাম্প মার্কিনী হিটলার। তবে এ পথটি সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার চলমান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক সাংস্কৃতিক সংকটে তাকে উদ্ধার করতে একটি বিকল্প হিসেবে যে সামনে আসছে তা যত দিন যাচ্ছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে।

ইতিহাস থেকে আর দু’একটা উদাহরণ তুলে ধরে উপসংহারে যাবো। যেমন, ব্রিটেনের নির্বাচন নিয়েও সারা দুনিয়ার ‘গণতান্ত্রিক’ বুর্জোয়াদের বোকা বানিয়ে জনগণ ভিন্ন রায় দিয়েছিল। যা থেকে বুঝতে কষ্ট হয় না যে, সে রায়টা সেখানকার উগ্রজাতীয়তাবাদের শক্তিশালী একটা প্রকাশ ছিল। ট্রাম্পের বিজয়ের পর আমেরিকান পন্ডিত-বুদ্ধিজীবীরা তার বিজয় নিয়ে কুল-কিনারা পাচ্ছেন না। বরং নাস্তানাবুদ হচ্ছেন। একইভাবে বিশ্ব মিডিয়া খতিয়ে দেখা শুর করেছে কীভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিবাদী রাজনীতি কিভাবে পুণরায় শক্তিশালী হচ্ছে।

সাম্রাজ্যবাদই মধ্যপ্রাচ্যে লিবিয়া থেকে শুরু করে পাকিস্তান পর্যন্ত চরম অস্থিরতা, অমানবিক অবস্থা, যুদ্ধ ও ধ্বংস যা সৃষ্টি করেছে। তারই প্রতিক্রিয়া হিসেবে গোটা ইউরোপে অভিবাসী সমস্যা মানবিক ইস্যু হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। যার প্রতিক্রিয়াশীল ফ্যাসিবাদ বিকশিত হচ্ছে। সে পথেই ট্রাম্পকেও যেতে হবে বলে দুর্বল মন্তব্য করছি। সেই সাথে এও মনে করি যে এর সত্যিকার বিকল্প বিশ্ব জনগণকে পুনরায় অনুসন্ধান করতে হবে।

উপসংহারে বলা যায়, আমেরিকার সাদা মানুষদের নিচুস্তরের নিপীড়িত বঞ্চিত সংকটগ্রস্থ জনগণের আসার কথা প্রগতিশীলতা, সমাজতন্ত্রের দিকে। সেটাই তাদের মুক্তির পথ। কিন্তু আমেরিকার সমাজে এ আদর্শ আড়াল করার হাজারো উপায়ে অব্যাহত। এই সুযোগে উগ্রজাতীয়াবাদী স্লোগানকে শাসক শ্রেনি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। যদিও আমেরিকার মাওবাদীরা জনগণের সামনে একটা স্লোগান তুলে ধরেন- এই ব্যবস্থার জন্য ভোট দেবেন না, তাকে উচ্ছেদ করুন। ভুলে যাওয়া যাবে না যে, যেভাবে চলছে তাতে কিন্তু জনগণকে অধিকতর অবর্ণনীয় দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হতে হবে। বিশ্ব ও বিশ্বজনগণকে রক্ষার জন্য এমন পরিণতিকে অবশ্যই প্রতিরোধ করতে হবে। বাস্তবতা বলছে, পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদকে উচ্ছেদ করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিজেদের সার্বিক মুক্তির পথে এগুতে হবে বলে মনে করি।

পরিশেষে, মার্কিনের সর্বস্তরের জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণে আবারো বলতে চাই, ‘বিশ্বের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ট্রাম্পের অভিযান’ মানবিক দিক থেকে ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মারাত্মক অন্তরায় সৃষ্টি করবে। এবং একইবাবে সাম্রাজ্যবাদী দীক্ষাগুরু মার্কিনের নেতৃত্বের ভূমিকা ন্যুনতমভাবে হলেও দ্বিধা বিভক্ত হবে। আর যদি ২০১৭ সালের ভোটে ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে মার্কিনী জনগণ তুলনামুলক বিশ্লেষণ করলেও হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই এখনই সময় ট্রাম্পের অভিযানের ও শীতল বাণিজ্যিক যুদ্ধের লাগাম টেনে ধরতে হবে। নয়তো পর্যায়ক্রমে যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকার জনগণ সব ভোদভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন। প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া শাসন ব্যবস্থাই ভেঙে পড়তে পারে ও পর্যায়ক্রমে পড়বে। প্রমাণিত জনগণ যা চাবে তা-ই হয় এবং বিশ্বজনগণ যা চায় তা বিশ্বজনশক্তি বলেই সফল হবে। সমাজ পরিবর্তন ইতিহাসের রায়ও বটে।

By SK Mazid Mukul

প্রধান সম্পাদক, গণপ্রহরী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *